|
অজয় দাশ গুপ্ত
dasguptajoy@hotmail.com |
|
আইনের শাসন: প্রধানমন্ত্রীর জরিমানা যেখানে বৈধ
17 January 2018, Wednesday
যা খুশি তা করে পার পাওয়ার দেশ বাংলাদেশ। নানা বিষয়ে আকাশচুম্বী উন্নতি হলেও আমাদের স্বভাব বদলায় না। এ লেখা যখন লিখছি সাধারণ মানুষ আতঙ্কে আছেন বিখ্যাত যশোর রোডের গাছকাটা নিয়ে। এখনো পরিষ্কার না কাটা হবে কি হবে না গাছগুলো। তবে মনে হচ্ছে পাগলা কারো কথা শোনে না। আর যখন তা হয়ে যায় হায় হায় করার বাইরে কিছুই থাকে না মানুষের। সব বিষয়ে কেমন জানি বেপরোয়া ভাব। আর এই বেপরোয়া ভাবই শুষে নিচ্ছে উন্নয়নের সুফল। মানুষ ভেবেছিল আওয়ামী লীগ বিগত বিএনপি আমল থেকে শিখবে। গোড়ায় কিছুটা শিখলেও আবার তথৈবচ। এর মূল কারণ আইন ও শাসনের শিথিলতা। আপনি কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেন আমাদের দেশের কোনো মন্ত্রীকে কেউ ফাইন বা জরিমানা করতে পারে? তারা যা খুশি তা করতে পারেন। করলেও কোনো বিচার নেই। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ এদের জ্বালায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিপদে পড়লেও চুপ করে থাকার বিকল্প নেই। কতবার কত ঘটনায় মানুষ রাস্তায় বিপাকে পড়ে কে তার খবর রাখে? আইনের প্রয়োগ যদি ব্যক্তিভেদে আলাদা হয় তো এমন হবেই। আমরা উন্নয়ন বলতে বুঝছি হাতে টাকা আর দেদার খরচ। সুষম উন্নয়নের মূল জায়গাটা বড় অবহেলিত। তার একটা প্রমাণ নিয়েই আজ লিখছি।
এই সেদিন আমাদের বর্তমান আবাসভূমি অস্ট্রেলিয়ায় প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল পড়েছেন ফাইনের বিপদে। আমরা যারা সাধারণ নাগরিক তারা মাঝে মাঝে এমন বিপদে পড়ি বৈকি। বিশেষত বেপরোয়া তারুণ্য প্রায়ই ফাইন খায়। খায় বলতে ফাইনের বিষ হজম করে। ধরুন আপনি জোরে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন ভাবছেন আশপাশে কেউ নেই কি আর হবে। অথবা মধ্যরাতে নিঝুম রাস্তায় স্পিড যখন ৫০ আপনি চলে গেলেন ৬০ কিলোমিটার বেগে। না। কেউ কিচ্ছু বলবে না। বলার লোক এত রাতে রাস্তায় আছে নাকি? মহাআনন্দে বাড়ি ফিরে ভাবলেন বেশ আগেই চলে এলাম। দু একদিন পর লেটারবক্স খুলেই আপনার মেজাজ সপ্তমে। কয়েকশ’ ডলারের চড়া ফাইনের কাগজ মুখ বাড়িয়ে ব্যঙ্গ হাসি দিয়ে বলছে, খুব তো খেল দেখালে সে রাতে। আমাকে অবজ্ঞা করে দ্রুত চলে এলে। ভাবছিলে কেউ দেখছে না। গোপন ক্যামেরা ঠিকই দেখেছে বাপু। ধরো নাও। এবার জরিমানা দিয়ে আবার গাড়ি চালাও। আইনের শাসনে আপনি পুলিশকে হাতে কিছু ধরিয়ে দেয়া বা গোপনে সমঝোতা করার নিয়ম নেই। কোনো মামা চাচা মন্ত্রী মিনিস্টারে যে কাজ হয় না তারই বড় প্রমাণ প্রধানমন্ত্রীর জরিমানা।
তার আগে দেশের একটা গল্প বলি। গল্পটা সত্যও বটে। ঢাকার রাস্তায় ভিআইপিকে নিয়ে চলমান কয়েকটা গাড়ি নিয়ম ভেঙ্গে ভেঁপু বাজাতে বাজাতে যে গলি দিয়ে ঢুকেছিল তার পিছে পিছে আসতে থাকা গরিব নিরীহ রিকশাচালকটিও সে পথের যাত্রী। পুলিশের গাড়িকে আইন মনে করে সে পথ অনুসরণ করে স্বীয় কীর্তি ধ্বজা ধরে সেও এসেছিল বরণীয় হতে। আর যায় কোথা। পুলিশের লোকেরা তাকে পাকড়াও করে এই মারে তো সেই মারে হাল। বেচারা রিকশাওয়ালা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না কী তার অপরাধ? প্রশ্নের জবাবে সে জানাল পুলিশ ও সরকারি গাড়ি যেতে দেখে সে ভেবেছে এটাই পথ। তাই গলিতে ঢুকেছে। তার অবস্থা বুঝতে পেরে অফিসার হাঁক পাড়লেন এই বলে, ব্যাটা বেকুব আইন যে গড়ে আইন যার হাতে সেই পারে আইন ভাঙতে। তুই কোথাকার কে? আর একবার এভাবে আসবি তো কপালে খারাপি আছে। বেচারা রিকশাওয়ালা পালিয়ে বেঁচেছিল সেবারে।
এই নিয়ম সভ্য দেশে চলে না। আইন যার হাতে তিনি আইন ভাঙলে তারও কপালে দুর্ভোগ আছে। প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল গিয়েছিলেন বাড়ির পেছনের হ্রদে ডিঙ্গি চালাতে। হাউজবোট জাতীয় কিছু একটা। জলে নেমেছেন অথচ সেফটি জ্যাকেট গায়ে দেননি। বাড়ির যত কাছে হোক আর আপনি যেই হোন না কেন নিয়ম তো নিয়মই। ওঁৎ পেতে থাকা অফিসার পাকড়াও করে ধরিয়ে দিয়েছেন আড়াইশ’ ডলারের জরিমানাপত্র। টাকার অঙ্কে কিছুই না। কিন্তু খেয়াল করুন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে ফাইন করতে বুক কাঁপেনি সামান্য অফিসারের এবং হাতেনাতে ধরে ফেলা অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ নেতাও এতে রেগেমেগে এমন কিছু করেননি যা তিনি চাইলেই করতে পারতেন। ভাবুন তো আমাদের দেশের শীর্ষ নেতা দূরে থাক মন্ত্রীদের কাউকে ফাইন করা হলে কি হতো? আমাদের যৌবনে ছড়া লিখিয়ে বাপী শাহরিয়ারকে হয়তো অনেকের মনে আছে। বেচারা এক মন্ত্রীর ছেলের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর শিকার হয়ে আজীবন পঙ্গু হয়ে একসময় দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিল। কোনো বিচার কোনো আইন কাউকে কিছু করতে পারেনি। আমাদের দেশে আইন আছে নিয়মও আছে। কিন্তু বিচার নাই। কারো বুকের পাটা নাই মন্ত্রীকে ফাইন করে। আর এদেশে?
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ফাইনের খবর পেয়ে মানে ধরা খাবার পর বলেছেন, কাগজ আসার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তার জরিমানা শোধ করে দেবেন। এটাও মুখের কথা না। তিনি যে দেবেন সেটা কাগজে কলমে না দেখানো অবধি তার যেমন শান্তি নাই রাজনীতিও শান্তি পাবে না। তবে আজীবন তাকে এর দায় বহন করতে হবে। এখন থেকে তোপের মুখে পড়লেই শুনতে হবে, তুমি তো সেই নেতা যে সেফটি জ্যাকেট ছাড়া বোট চালাতে গিয়ে ফাইন দিয়েছিলে। তোমার কাছে জাতির নিরাপত্তা কোথায়? এর নাম স্বচ্ছতা। এর নাম জবাবদিহিতা। আমাদের সমাজে আমরা রাজনৈতিক নেতাদের ড্যামি গড বানিয়ে রেখেছি। যতদিন তারা গদিতে ততদিন তাদের কেউ ছুঁতে পারে না। আর যারা গদির বাইরে তারাও সিন্ডিকেট সদস্য। ছুঁলে খবর আছে। এমন দেশে সমাজে পুলিশ বা আইন কিভাবে তার দায়িত্ব পালন করবে?
কথায় কথায় আমরা বলি আমরা গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাচ্ছি। কথাটা সত্য হলে সমাজে সবার জন্য এক আইন এক নিয়ম আর এক ব্যবস্থা থাকত। সেটা যখন হয় না তখন এও মানতে হবে আমরা আসলে গণতান্ত্রিক হতে পারিনি। যে কারণে যানবাহন থেকে সর্বত্র শ্রেণিবিভাগ চালু রয়েছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম রুটে ফ্লাইট বিলম্বের কারণ শুনে আমি থ। জানা গেল ভিআইপি মুভমেন্টের কারণে না কি ফ্লাইট দেরি। কারা এই ভিআইপি? তাদের কি এমন মুভমেন্ট যে বাকি মানুষদের ভুগতে হবে? বাইরে এসে দেখুন ভিআইপিরাই তটস্থ। তাদের মনে ভয় তাদের জন্য যেন কারো কোনো অসুবিধে না হয়। আমরা এসব বিষয়ে এখনো মান্ধাতার আমলে আছি। মাথার ওপর বিলবোর্ড আর সাইনগুলো দেখলেই বোঝা যায় সভ্যতা এখনো ধরা দেয়নি। আমরা বড় হয়ে ওঠার সময় দেখেছি রাজনীতি বা সমাজে পোস্টারে বিলবোর্ডে বড়জোর দু একজন মানুষের ছবি থাকত যারা নমস্য। যাদের ব্যাপারে কারো কোনো কথা নেই। আজ এমন হাল যার খুশি সে দিচ্ছে তার ছবি। মাথার ওপর দেশবরেণ্য কাউকে রেখে দেদার চলছে আত্মপ্রচার।
এভাবে গড়ে উঠছে বলয়। সে বলয়ে আপনি কাউকে স্পর্শ করতে পারবেন না। পারলে আপনার খবর আছে। সমাজে দেশে মিডিয়ায় মানুষ দিনরাত আলোচনা শুনছে। এত আলোচনা দুনিয়ার আর কোনো দেশে চলে না। চ্যানেলে চ্যানেলে বা মিডিয়ায় এত মানুষের এত আলাপের পরও সমস্যা ঘুচেছে না। ঘুচবে না এই কারণে যিনি প্রতিবাদ করে টিভি থেকে বেরুলেন তিনিই তার ড্রাইভারকে বলবেন রাত হয়েছে লাল লাইটে চলে যাও। কেউ কিছু বললে আমি আছি। যিনি আইনের পাহারাদার তিনিও এমন করেন। ফলে কেউ কারো কথা মানে না। সভ্য হওয়ার মূল শর্ত নিয়ম মানা। উন্নয়নের প্রাথমিক শর্ত পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা। এর কোনোটাই আমরা মানি না। দেশের তারুণ্য বা শিশু কিশোরেরা মিডিয়ায় বড়দের ঝগড়া দেখে বড় হয়। তারা জেনে যায় কেউ কাউকে না মানার দেশের নাম বাংলাদেশ। তারা জানে আইন ভাঙলে শাস্তি নেই। আর শাস্তি হলেও প্রয়োগ নেই। থাকলেও মাথার ওপর গডফাদার আছে বাঁচানোর। এমন সমাজে কে কষ্ট করে নিয়ম মানবে বলুন।
অথচ আমাদের সাধারণ মানুষেরা নিয়ম মানতে চায়। তারা এমন কোনো অপরাধ করে না যা পরদিন দেশবাসীকে ভয়ের মুখে ঠেলে দেয়। সাধারণ মানুষের অসাধারণ জীবনবোধে উদ্দীপ্ত দেশে আইন কানুন বা নিয়ম না মানা মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা। তারপরও আমরা তাদের কোণঠাসা করতে পারিনি। উল্টো তারাই কোণঠাসা করে চলেছে দেশকে। এই যে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী জরিমানা বা ফাইন পেলেন আর তা দেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেন এতে তিনি একটুও ছোট হননি। বরং চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন আইনের চোখে সবাই সমান। এমন নজির এমন উদাহরণ তৈরি হলে আমাদের দেশেও মানুষ নড়েচড়ে বসবে। সমাজে শান্তি আর নিয়মের প্রতি আনুগত্য বাড়বে। মানুষ জানবে অন্যায় করে স্বয়ং মন্ত্রীও পার পায় না। ফলে সবাইকে সাবধানে চলতে হবে।
সেটা আদৌ হবে কি না জানি না। তবে ম্যালকম টার্নবুলের জরিমানার খবরে আরো একবার মনে হলো আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ ভালো করতে আইনের শাসন, আইনের প্রয়োগ দুটোই জরুরি। আমরা কি তা দেখতে পাব কোনোদিন?
লেখক : সিডনি প্রবাসী
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন