অস্ত্র সেভাবেই তার কাজ করবে, যেভাবে তার মালিক চাইবে। কাজেই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, মারাত্মক সেই অস্ত্রটি কার হাতে আছে। সারা পৃথিবীর মাথা ব্যথার একটি বিশেষ কারণ পরমাণু অস্ত্র। এই মাথা ব্যথা সবসময়ই ছিল। তবে এর গুরুত্ব বেড়ে যায় যখন প্রমাণিত হয় পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হয়েছে কোনো কোনো দায়িত্বহীন রাষ্ট্র। আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, পৃথিবীতে মোট ১৫ হাজার পরমাণু অস্ত্র রয়েছে যার বেশিরভাগই রাশিয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের দখলে। কিন্তু বিপজ্জনক খবরটি হলো, মোট ১০ হাজারেরও কম পরমাণু অস্ত্র রয়েছে মিলিটারি সার্ভিসের হাতে। রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্য এই পাঁচটি দেশের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকার বিষয়টি স্বীকৃত। স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুসারে রাশিয়ার কাছে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র রয়েছে।
দেশটিতে পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা ৭ হাজার। দ্বিতীয় স্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে রয়েছে ৬ হাজার ৮০০টি পারমাণবিক বোমা। তৃতীয় অবস্থানে থাকা ফ্রান্সের কাছে আছে ৩০০ পারমাণবিক বোমা । চতুর্থ স্থানে আছে চীন। তাদের কাছে আছে ২৭০টি পারমাণবিক বোমা। পঞ্চম স্থানে অবস্থিত যুক্তরাজ্যের হাতে আছে ২১৫টি পারমাণবিক বোমা। এই পাঁচটি প্রধান দেশের বাইরেও আরো কিছু দেশে পারমাণবিক অস্ত্রের ভাণ্ডার আছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আণবিক অস্ত্রের ভাণ্ডার আছে পাকিস্তানে। ১৩০ থেকে ১৪০টি পারমাণবিক বোমা আছে পাকিস্তানের হাতে। ভারতের হাতে আছে ১২০ থেকে ১৩০টি। ইসরাইলের কাছে আছে ৮০টির মতো পারমাণবিক ওয়ারহেড। উত্তর কোরিয়ার কাছে আছে ১০ থেকে ২০টির মতো পারমাণবিক বোমা।
একটি গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে থাকা সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বোমা বি-৮৩ কোনো জায়গায় আঘাত হানলে প্রথম ২৪ ঘণ্টাতেই ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষের মৃত্যু হবে। এর বাইরে ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ তেজস্ত্রিয় বিকিরণের কারণে আহত হবে। রাশিয়ার ‘টিসা’ নামের বোমা যদি নিউইয়র্ক শহরে আঘাত করে তাহলে ৭ কোটি ৭০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটার সম্ভাবনা থাকবে; আহত হবে আরো ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ।আশঙ্কার কথা, সম্প্রতি পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে জাতিসংঘের দুই-তৃতীয়াংশ দেশ সম্মতি জানালেও এ চুক্তি বয়কট করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সসহ অন্য কিছু দেশ।
ভোটে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিল পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ নয়টি দেশ। বেশ কিছুদিন ধরে পরমাণু অস্ত্র ইস্যুতে সারা বিশ্বের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে উত্তর কোরিয়া। গত জুলাই মাসেও দুটি আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে উত্তর কোরিয়া। গত ডিসেম্বরে পরমাণু অস্ত্র ইস্যুতে বেশ উত্তেজনাকর বক্তব্য দিয়েছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পরমাণু অস্ত্রসমৃদ্ধ দেশ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। নিজ দেশের প্রতিরক্ষা প্রধানদের সঙ্গে এক বৈঠকে পুতিন বলেছিলেন, ‘পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডার বাড়ানোই ২০১৭ সালের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে আবির্ভূত হবে।’
বিশ্ববাসীর পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা নিয়ে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে বার বার। কারণ, যে পরিমাণ অস্ত্রভাণ্ডার পৃথিবীতে মজুদ আছে, তা দিয়ে পুরো পৃথিবীকে বেশ কয়েকবার ধ্বংস করা সম্ভব।পারমাণবিক অস্ত্র সমৃদ্ধতে শান্তিকামী মানুষের আজ আশঙ্কা পারমাণবিক বোমাসমৃদ্ধ কোরিয়া বা পাকিস্তান পাশে থাকা রাষ্ট্রগুলোর জন্য কি এসব অস্ত্র হুমকি হয়ে দাঁড়াবে অদূর ভবিষ্যতে? যদি তারও চেয়ে বেশি কিছু হয়? যদি ওই পারমাণবিক অস্ত্র তৃতীয় কোনো অসাধু আর ভয়ানক কোনো দেশের হাতে পড়ে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দগদগে ক্ষত নিয়েও বিশ্ব তো বেঁচে গিয়েছিল অনেক ক্ষতির পর।
কিন্তু আগামীর বিশ্ব কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বাঁচবে- যদি সত্যিই যুদ্ধের দামাবা বাজানো কোনো খারাপ হাতে পড়ে যায় বড় বড় পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ? বেশ কিছুদিন ধরেই পরমাণু অস্ত্রের ইস্যুতে সারা বিশ্বের দৃষ্টি উত্তর কোরিয়ার দিকে। উত্তর কোরিয়া নিয়ে মাঠ বেশি করে গরম করছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন যুক্তরাষ্ট্র। হুমকির পর হুমকি, হুমকির পরিবর্তে হুমকি- এমনটাই উত্তর কোরিয়া আর ট্রাম্পের বর্তমান অবস্থান।পাকিস্তান নিয়েও ভাবনার মাত্রা বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছে করলেই একের পর এক পারমাণবিক বোমা ছুড়ে দিতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে, রাশিয়ার দিকে, উত্তর কোরিয়ার দিকে। তার উত্তরে উত্তর কোরিয়া, রাশিয়াও নিশ্চয় চুপ করে বসে থাকবে না। পারমাণবিক অস্ত্রের উত্তর তারা পারমাণবিক অস্ত্রের ভাষাতেই দিবে এটা একেবারেই নিশ্চিত।
কিন্তু হুমকির ভাষা পৃথিবীতে থাকলেও কখনো পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়নি যুক্তরাষ্ট্র কিংবা রাশিয়ার কাছ থেকে এখনো। বিশ্বের মানুষের ভরসাটাও তাদের প্রতি আছে। কারণ যা-ই হোক, তারা কোটি কোটি মানুষ ধ্বংসের পথ বেছে নিতে পারে না। কিন্তু উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান, ইসরাইল- এদের কাছ থেকে ভরসা পাওয়ার মতো যথেষ্ট যুক্তি কি বিশ্ব খুঁজে পেয়েছে আজ অবধি? যদি কেউ ভুল করে বসে? লোভের আশায়, আস্ফালন চরিতার্থ করার আশায় যদি কোনো অর্বাচীন রাষ্ট্রনায়ক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে? ভাবতেও কাঁটা দিয়ে ওঠে শরীরে। তাহলে আজকের বিশ্বগ্রামে কে হবে ভরসার পুলিশ? জাতিসংঘ তো ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই, নিধিরাম সরদার’।
যুক্তরাষ্ট্র কি কিছু করতে পারবে? রাশিয়া কি কিছু করতে পারবে? তেমন করে ভাবার কোনো সুযোগ পাচ্ছি না। কারণ পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে সই করা তো দূরে থাক, বয়কট করে বেরিয়ে গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে ভরসা কোথায়? মানুষকে পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহ পরিণতি কিংবা হুমকি থেকে বাঁচাবার পথটি তাহলে কোথায়? মানুষ খুনের রক্তনেশা রাষ্ট্রের ছোড়া দায়িত্বহীন দানব পারমাণবিক বোমার অশালীন গতিকে চাবুক মেরে ফিরিয়ে দেবে কোন শক্তি? পৃথিবী আর পৃথিবীর মানুষ চিন্তামুক্ত দিনযাপনে দাঁড়াবে কার দুয়ারে? জাতিসংঘ কি নতুন করে এই মহাসংকটের সমাধানে আরো একটু এগিয়ে আসবে? জাতিসংঘ কি ঢাল হাতে পাবে কোনো একদিন?
মেজর (অব.) সুধীর সাহা
লেখক: কলামিস্ট
পাঠক মন্তব্য
আমেরিকাকে কেন ভালো বলা হলো? আমেরিকা হলো একমাত্র দেশ, যারা পরমাণু অস্ত্র কখনো ব্যবহার করেছে। আর ভারত কি আতপ চাল? ধবধবে সাদা?
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন