আবদুল লতিফ মন্ডল
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, জাতিসংঘের ৭২তম অধিবেশনে অংশ নিতে নিউইয়র্কে অবস্থানকালে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতা নয়। যারা সন্ত্রাস ও হত্যার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তিনি তাদের কাছে ফিরে যেতে আগ্রহী নন। যারা বঙ্গবন্ধুর বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড এবং দেশকে ধ্বংসে বিশ্বাসী, তাদের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক সমঝোতা হতে পারে না। তাই বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার প্রস্তাব দেয়া কারও উচিত হবে না। এরপর আর কেউ কখনও এ বিষয়টি তার কাছে তুলবেন না। প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য ও মনোভাব যে দেশের দুর্বল গণতন্ত্রের উন্নয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়- এ বিষয়টি তুলে ধরাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
‘রাজনীতিতে চিরস্থায়ী শত্রু-মিত্র বলে কেউ নেই’ কথাটি দেশের দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ক্ষেত্রে বোধহয় প্রযোজ্য নয়। আশির দশকের শেষদিকে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৯২ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের আমলে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার পদ্ধতির পরিবর্তে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের ক্ষেত্র ছাড়া এ দুটি দলের মধ্যে আর কোনোদিন কোনো বিষয়ে ন্যূনতম সমঝোতা হয়নি। তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যতটা না বিভেদ, তার চেয়ে অনেক বেশি বিভেদ শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব নিয়ে। এর পেছনে অবশ্য কারণ রয়েছে। আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া সাড়ে তিন দশক ধরে তাদের নিজ নিজ দলের নেতৃত্বে রয়েছেন। তারা উভয়ে তিনবার করে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দলীয় স্বার্থ রক্ষার সঙ্গে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো জড়িত তার একটি হল, এ দুই নেত্রীর মধ্যকার ক্ষমতায় আরোহণ অথবা ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রশ্ন। এ প্রশ্নকে ঘিরেই দল দুটি পরস্পর পরস্পরকে নানা বিষয়ে দোষারোপ করে থাকে, এমনকি মুজিব ও জিয়া হত্যার ব্যাপারেও। ভারতীয় গবেষক শ্রীরাধা দত্ত তার ‘Bangladesh: A Fragile Democracy’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘Much of their animosity revolves around the assassinations of Mujib and Zia. If the latter's lenience to Mujib's assassins kindled the Awami League's hostility towards the BNP, the Awami League was accused of tacitly backing Zia's assassination in May 1981.’ এর অর্থ দাঁড়ায়, তাদের মধ্যকার শত্রুতা মুজিব ও জিয়া হত্যাকে ঘিরে। মুজিব হত্যাকারীদের প্রতি জিয়ার সহানুভূতি প্রদর্শনে যেমন বিএনপির প্রতি আওয়ামী লীগের শত্রুতা বৃদ্ধি পায়, তেমনি ১৯৮১ সালের মে মাসে জিয়া হত্যায় পরোক্ষ সমর্থনের জন্য বিএনপি আওয়ামী লীগকে অভিযুক্ত করে। তাই অনেকে মনে করেন, শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যকার ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব এ দুই দলের কোনো ধরনের সমঝোতায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রে এক বিরাট বাধা।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে যেসব বিষয়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা দরকার সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল- নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নির্ধারণ করা, নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া, নির্বাচনের সময় নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অংশ হিসেবে সেনা মোতায়েন করা এবং সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণ করা।
রাজনীতিকদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস থেকে দাবি ওঠে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। ১৯৯৬ সালের মার্চে বিএনপির শাসনামলে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হলেও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অবসান ঘটে এ ব্যবস্থার বড় দাবিদার আওয়ামী লীগের শাসনামলে। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে। বিএনপি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। বিএনপির সঙ্গে তাদের সহযোগী ১৮ দল এবং সমমনা ৯টি দলও এ নির্বাচন বর্জন করে। অনেকটা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একক অংশগ্রহণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দশম সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় দেশে গণতন্ত্র পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় দেশে ও বিদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিলেও অল্পদিনের মধ্যে তিনি সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেন। বর্তমানে জাতীয় সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবি থেকে সরে এসে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের কথা বলছে, যদিও তারা এখন পর্যন্ত সহায়ক সরকারের রূপরেখা প্রকাশ করেননি। সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে বিষয়টি নিয়ে সরকার এবং বিএনপি ও অন্যসব রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলোচনা ও কার্যকর সমঝোতা হওয়া দরকার।
পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদে সংশোধনী এনে আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে সংসদের অবস্থান বিষয়ে আমূল পরিবর্তন আনে। সংশোধনীতে বলা হয়, মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ সংশোধনীর অব্যবহিত পূর্বে উল্লিখিত অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদে আনা সংশোধনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ হল, সংসদীয় সরকার পদ্ধতির অনুসারী পৃথিবীর কোনো দেশে সংসদ বহাল বা কার্যকর রেখে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের নজির নেই। সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুসারী হয়ে বাংলাদেশ এমন কিছু করতে পারে না যা বিশ্বে প্রচলিত সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে বেমানান। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের এ যাবৎ অনুষ্ঠিত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ ছাড়া সবাই একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়ার পক্ষে। সুতরাং এ বিষয়টি নিয়ে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা ও সমঝোতা হওয়া জরুরি।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অংশ হিসেবে সেনা মোতায়েন করা বা না করা আরেকটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আগামী সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ মূলত নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিপক্ষে। তবে দলটির নেতাদের বক্তব্য থেকে মনে হয়, নির্বাচনের সময় স্ট্রাইকিং বা রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে সেনা মোতায়েনে তাদের আপত্তি নেই। অন্যদিকে বিএনপি চাচ্ছে নির্বাচনের সময় সশস্ত্র বাহিনী নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা পালন করুক। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের এ যাবৎ অনুষ্ঠিত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই চান নির্বাচনের সময় সশস্ত্র বাহিনী নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা পালন করুক। এ বিষয়টি নিয়েও সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা ও সমঝোতা হওয়া প্রয়োজন।
সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণ নিয়েও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। আওয়ামী লীগ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনী আসনের সীমানার বদল চায় না। অন্যদিকে বিএনপি সংসদীয় আসনের সীমানা পুনঃনির্ধারণ চায়। এ বিষয়টি নিয়েও আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে কিছুটা সমঝোতা থাকা দরকার।
প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে ‘সন্ত্রাসী’ ও ‘দেশকে ধ্বংসে বিশ্বাসী’ দল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এর দ্বারা তিনি সম্ভবত ২০১৫ সালে বিএনপির লাগাতার হরতাল এবং সে সময়ে সংঘটিত সহিংস কার্যকলাপের কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতারা ওই সময়ে সংঘটিত হিংসাত্মক কার্যকলাপের জন্য বিএনপি ও তাদের সহযোগী দলগুলোকে দায়ী করেন। বিএনপি হিংসাত্মক কার্যকলাপে তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে প্রকৃতপক্ষে কারা এসব সহিংস কার্যকলাপের জন্য দায়ী তা নির্ধারণের জন্য নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছিল। সরকার সে বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে খালেদা জিয়াসহ বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে। এসব মামলায় খালেদা জিয়া বা বিএনপির কোনো নেতাকর্মী এখন পর্যন্ত দোষী প্রমাণিত হয়েছেন বলে জানা যায়নি। আদালতের রায়ের আগে কাউকে কোনো অপরাধের জন্য দোষী বলে আখ্যায়িত করা সমীচীন নয়।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং এর বিকাশে অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নেই- সে নির্বাচন জাতীয় বা স্থানীয় যে পর্যায়েই অনুষ্ঠিত হোক। একাদশ সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানে চলমান রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, জাতীয় সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ নিবন্ধিত সব দলকে আলোচনায় বসতে হবে এবং একটি যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছাতে হবে। জনগণ যদি বিএনপিকে ‘সন্ত্রাসী’ ও ‘দেশকে ধ্বংসে বিশ্বাসী’ দল বলে মনে করেন, তাহলে তারা আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করবেন। তাই চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় না বসা বা দলটির সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতায় না পৌঁছানোর মনোভাব থেকে সরকারি দলকে সরে আসতে হবে। জনগণ চায় সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হোক একাদশ সংসদ নির্বাচন। বর্তমানের দুর্বল গণতন্ত্র শক্তিশালী হোক এবং গণতন্ত্র ও উন্নয়ন হাত ধরাধরি করে চলুক। সরকার যত শিগগির এটি অনুধাবন করবে ততই দেশের জন্য মঙ্গল।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
পাঠক মন্তব্য
oboiidho..hasina-rr..duii sokh ondho..duii kaann bonndho..aarr baakii aashe..shaaraa kaalerr..joiinno..koborerr..ondhokaarr.
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন