খুরশীদ আলম বাবু
‘যখন কোনো একটি জাতি তার সরকারের বিপক্ষে যায়- এমন কিছু বলা থেকে বিরত থাকে, তখন সেই জাতি কিছু শোনারও যোগ্যতা হারায়। আর সেটা তখন যে জাতিতে পরিণত হয়, আমি সেই জাতির একজন হতে চাই না।’-বিচারপতি এম আর কায়ানি।
যা আশঙ্কা করেছিলাম, শেষাবধি তাই ঘটল। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা এক মাসের ছুটিতে অস্ট্রেলিয়া গেছেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অশান্ত সমালোচনার ঝড়ের তোড়ে কতক্ষণ টিকতে পারবেন প্রধান বিচারপতি, সেটাই ছিল দেখার বিষয়। এরপর যা ঘটল তাতে অদূরভবিষ্যতে আরো অনেক কিছু ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। আইনের পরিভাষায়, আশঙ্কা কেবল বোধ করলেই হবে না, তারও একটা যথাযোগ্য ব্যাখ্যা থাকতে হয়। ধরা যাক কোনো ব্যক্তিকে দুষ্টু ব্যক্তি নানারকম হুমকি-ধমকি দিয়ে বসলেন। আক্রান্ত ব্যক্তি সারা রাত ধরে ভাবলেন, এ রকম হুমকি যদি সত্যি সত্যি কার্যকর হয়ে যায় তাহলে তিনি মারা যেতে পারেন। এই বোধ নিয়ে ফৌজদারি কার্যবিধি ১০৭ ধারা মোতাবেক একটি মামলা ঠুকে দিয়ে প্রার্থনা জানালেন, প্রতিপক্ষের মুচলেকায় সই-স্বাক্ষর না হলে তিনি মারা যেতে পারেন। আদালত এ ধারণাকে আমলে নিয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করবেন। জনাব এস কে সিনহা প্রধান বিচারপতি হওয়ার কারণেই এই মামলাটি করতে পারেননি। একজন জুনিয়র আইনজীবী সে দিন আমাকে এ তথ্য হাসতে হাসতে বললেন। ব্যাপারটাকে রসিকতা বলে উড়িয়ে দিলেও ওই জুনিয়রের কথায় খানিকটা সত্যতা ছিল বলাই যায়।
রাজশাহী বারের কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবীর সাথে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার দীর্ঘ ছুটি নিয়ে আলাপ-আলোচনায় যা বুঝলাম, তা দুঃখজনক বটে। নিম্ন আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটরদের যে ভয়াবহ প্রতাপ- তাতে তো ‘নগদনারায়ণ’ না দিলে কাজ হয় না। আওয়ামী লীগের আগের জামানায় ‘লিগ্যাল এইড’ বিষয় নিয়ে ঢাকায় সুপ্রিম কোর্টের অডিটোরিয়ামে সম্মেলন হয়, সেখানে কয়েকজন অ্যাসিস্ট্যান্ট পাবলিক প্রসিকিউটর তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদকে অনুরোধ জানালেন, রিমুনেশনের পরিমাণ এত কম যে, ওই টাকা দিয়ে আর চলা যাচ্ছে না। মন্ত্রী বলেছিলেন, পিপি-এপিপি হওয়ার তদবির দেখে সেটা মনে হয় না। অর্থাৎ আইনাঙ্গনের এই পরিস্থিতির জন্য আইনজীবীরাও কম দায়ী নন। আইনজীবীরা এখন নানা দলে বিভক্ত। জুনিয়র আইনজীবীরা বারে এসব দলীয় রাজনীতিতে না জড়ালে পিপি-এপিপি হওয়ার জন্য ‘যোগ্য’ হবেন না।
এমন সব আইনজীবীকে সরকারি আইন কর্মকর্তা হিসেবে দেখছি- যারা একটি মামলার ভালো আরজি পর্যন্ত লেখার সামর্থ্য রাখেন না। অথচ শুধু এই পদে থাকার কারণে গাড়ি-বাড়ি করে ফেলেছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি ও দ্বিতীয় কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান (২০০১) মরহুম লতিফুর রহমান ক্ষোভে লিখেছিলেন-
‘আমরা যেভাবে সিনিয়রের চেম্বারে কষ্ট করে কাজ শিখেছি ও কোর্টে উপস্থিত থেকে আইনজীবীদের উপস্থাপনা লক্ষ করেছি ও আইনের বইপুস্তক পড়াশোনা করেছি, আজকের আইনজীবীরা কিন্তু সেভাবে তাদের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন না। আজকের আইনজীবীরা শুধু কিভাবে অল্প পরিশ্রমে টাকা উপার্জন করা যায়, সে দিকেই ব্যস্ত। সত্যিকার অর্থে মেধার চর্চায় নবীন আইনজীবীরা অনেক দূরে সরে গেছেন। আমার মনে হয় সুপ্রিম কোর্টে ২০ জন ভালো উকিলের নাম নির্ণয় করা কঠিন ব্যাপার। এর ফলে আইন পেশার মান ও সুনাম অনেক কমে গেছে। (তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দিনগুলো ও আমার কথা : লতিফুর রহমান, প্রথম প্রকাশ ২০০২, জুলাই।
আজকে আইনজীবীদের একটি দল সরকারি দলের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে প্রকাশ্যে আইনাঙ্গনে সরকারের স্তুতি করতে দ্বিধাবোধ করেন না। কথাটা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আইনজীবীদের মধ্যে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি ঢুকে গিয়ে এই সর্বনাশ ঘটেছে। যা হোক প্রধান বিচারপতিসহ অন্য ছয়জন বিচারপতি এই ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে যে রায় দেন- তাতে করে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়েন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। অথচ এর আগে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের মামলায় রায় দিয়ে এই সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কাছে সাঙ্ঘাতিক প্রশংসাধন্য হয়েছিলেন। আমার যত দূর ধারণা, অতীতের প্রধান বিচারপতিদের তুলনায় হাইকোর্ট ডিভিশন ও অ্যাপিলেট ডিভিশনের মামলায় সম্ভবত সবচেয়ে বেশি রায় দিয়েছেন তিনি। মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ছিল তার বেশ পরিশ্রমী ভূমিকা।
তবে প্রধান বিচারপতি সিনহা সৌভাগ্যবান যে, অতীতের মতো রাষ্ট্রপতির কলমের খোঁচায় বরখাস্ত হতে হলো না। আমাদের সুপ্রিম কোর্টের দুই প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন (১৯৮২) ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন (বিচারপতি সৈয়দ দস্তগীর হোসেনের বাবা) এরশাদ সরকারের কলমের খোঁচায় বরখাস্ত হয়েছিলেন। অন্যায় আচরণের শিকার হয়েছিলেন বিচারপতি কে এম সোবহান ও বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী। শেষোক্তজন দুঃখ করে বলেছিলেন, কেউ তার বরখাস্তের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেননি। তারও আগে রক্ষীবাহিনীকে বেআইনি বাহিনী হিসেবে ঘোষণার স্মরণীয় রায় দেয়া বিচারপতি দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য সামরিক জান্তার অন্যায় আদেশের শিকার হয়েছিলেন।
এখন মনে হচ্ছে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে সহ্য করাটা আওয়ামী লীগের সবার পক্ষেই ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়েছিল। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ঘোষণার পর নেতাকর্মীরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তার চেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন কয়েকজন কলাম লেখক। তাদের একজন লিখেছেন-
‘আমি এ কথাও লিখেছি যে, এই পর্যালোচনা (রায়ের) লেখার ব্যাপারে প্রধান বিচারপতি হয়তো হাসিনাবিদ্বেষী তিন বিখ্যাত আইনজীবী, একটি তথাকথিত সুশীলসমাজ এবং নিরপেক্ষ মিডিয়া গ্রুপের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।’
এ বিষয়টি নিয়ে দলনিরপেক্ষ আইনজীবীরা ভাবতে পারেন। প্রধান বিচারপতিকে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনে আর দেখা যাবে না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জানিয়েছেন, এস কে সিনহা তার বিচারপতি পদটিকে বারবার বিতর্কিত করেছেন। তার সরকার চায় ‘সম্মানের সঙ্গে’ বিদায় জানাতে।
এবার আসা যাক প্রধান বিচারপতি কেন দ্বিতীয়বার ছুটি নিলেন সে প্রসঙ্গে। তার এই ছুটি নেয়াটা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের কাছে অভাবিত বলে মনে হয়েছে। তাদের অভিযোগ, প্রধান বিচারপতিকে সরকার জোর করে ছুটিতে পাঠিয়েছে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তো সরাসরি বলেই ফেলেছেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক সাংবাদিকদের কাছে প্রধান বিচারপতির স্বাক্ষর সংবলিত দরখাস্তের ফটোকপি সরবরাহ করেছেন; তা-ও ভুয়া। এমনকি স্বাক্ষরও জাল। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতারা প্রধান বিচারপতির বাড়িতে গিয়ে তার সাথে দেখা করতে পারেননি। পরে জানা গেছে, প্রধান বিচারপতি ‘ক্যান্সারসহ নানা রোগে’ আক্রান্ত হয়েছেন। অবশ্য আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত- যার সৌভাগ্য হয়েছিল তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করার, তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তাকে আমার অসুস্থ বলে মনে হয়নি। তা হলে প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রধান বিচারপতি কি ইচ্ছাকৃতভাবে নাটকীয় ঘটনার সৃষ্টি করলেন? নাকি বাধ্য হলেন?
ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর যে ঘটনা ক্রমান্বয়ে চলে আসছিল- এর ধাক্কা শেষাবধি এস কে সিনহা সামলাতে পারলেন না। তার এই ছুটি নেয়ার মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের মনে হতে পারে, এখন আর কোনো বিচারপতিই নিরাপদ নন। সরকার এ ঘটনার মধ্যে দিলো, কোনোরকম সমালোচনা তারা সহ্য করতে রাজি নয়। এতে করে সারা বিশ্বের কাছে আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের ভাবমর্যাদা আবার নিচে নেমে গেল। একটি রায়কে কেন্দ্র করে আমাদের উচ্চতর আদালতে এত বড় একটি অঘটন ঘটে গেল, দুঃখ সম্মিলিতভাবে আমাদের আইনজীবী সমাজ প্রতিবাদ করতে পারল না। কেবল বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টের বারান্দায় বিক্ষোভ করছেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির নেতারা বারবার চেষ্টা করেও প্রধান বিচারপতির সাথে সাক্ষাৎ করতে পারেননি। অথচ গত ৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গহর রিজভী অনায়াসে দেখা করে এলেও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতাদের যাত্রাপথে পুলিশ আটকে দিয়েছে। অবশ্য পুলিশ সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে, যা এ দেশের পুলিশ সবসময় করে থাকে।
বিশিষ্ট আইনজীবী মওদুদ আহমদের সাথে আমি একমত, ‘অনেক ঘটনা ঘটবে- এখানেই সব কিছু শেষ নয়- এমন ঘটনা আরো ঘটবে।’ (সূত্র : প্রথম আলো ৭ অক্টোবর ২০১৭)
কী ঘটনা ঘটবে সেটা অনুমান করা কঠিন নয়। প্রকৃতপক্ষে এ ঘটনার মধ্য দিয়ে সরকার বিচার বিভাগকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিলো। স্মর্তব্য, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এর আগে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লাঠিমিছিল করেছিলেন। আমরা বড় আশান্বিত হয়েছিলাম, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা প্রবল বাধা অতিক্রম করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার কান্ডারি হয়ে যাবেন।
এত বড় বাজে ঘটনা ঘটে গেল- তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলা হলো না।
এ জন্য আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আইনজীবীদের কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে। আওয়ামীপন্থী একজন কলাম লেখক ভবিষ্যদ্বাণী করেই ফেলেছেন-
‘প্রধান বিচারপতি এক মাসের ছুটি নিয়েছেন। আমার ধারণা, এটা তার অগস্ত্যযাত্রা। তিনি আর এই পদে ফিরে আসবেন না। (সূত্র : প্রধান বিচারপতির অগস্ত্যযাত্রা? যুগান্তর ৬ অক্টোবর ২০১৭)
তাহলে তো আমরা ধরে নেবো আওয়ামী নেতা ছাড়াও কিছু কলামিস্ট জেনে ফেলেছিলেন সরকারের এই কর্মকাণ্ড সম্পর্কে।
লেখক : অ্যাডভোকেট, জজকোর্ট, রাজশাহী।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন