ভারত আমাদের নিকট ও বৃহৎ প্রতিবেশী। তাই ভারতের সাথে আমাদের বহুবিধ দ্বি-পাক্ষিক স্বার্থের সম্পর্ক রয়েছে। বন্ধু বদলানো যায়, কিন্তু প্রতিবেশী বদলানো যায় না। তাই আমরা ভারতের সাথে সুসম্পর্ক রেখেই বন্ধুত্বটা এগিয়ে নিতে চাই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে কৃতজ্ঞতা আমরা ভুলিনি, ভুলবো না। কিন্তু এখন পারস্পরিক সম্পর্কটা হতে হবে শ্রদ্ধার-ভালোবাসার।
সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত বড় দেশ, বাংলাদেশ ছোট- এটা মাথায় রাখলেই সমস্যা। বড়-ছোট’র ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। সীমান্ত চুক্তি অনুমোদনের সময় ভারতের পার্লামেন্টে তিনি বলেছিলেন, ভারতকে বিগ ব্রাদার না হয়ে এল্ডার ব্রাদার হতে হবে। সমস্যাটা এখানেই। ভারত প্রায়ই এল্ডার ব্রাদার না হয়ে বিগ ব্রাদার হয়ে যায়। সমস্যা এই দাদাগিরিতেই।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের একটা ঐতিহাসিক, কূটনৈতিক, ইমোশনাল, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। আরেকটু ছোট করে বললে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের সম্পর্কটা নাড়ির টানের। ১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান একটি অভিন্ন রাষ্ট্র ছিল ভারত নামে। ব্রিটিশরা দুইশ বছরের শাসন শেষে ফিরে যেতে বাধ্য হওয়ার আগে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতকে ভেঙ্গে দিয়ে যায়।
সৃষ্টি হয় পাকিস্তান নামে এক অদ্ভুত রাষ্ট্রের। ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তানের দুটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানে ভৌগোলিক দূরত্ব ছিল ১১০০ মাইল। কিন্তু মানসিক দূরত্ব ছিল হাজার কোটি মাইল।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রাম শেষে একাত্তরে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। এক সময়ের পূর্ববঙ্গ, পরের পূর্ব পাকিস্তান বদলে যায় স্বাধীন বাংলাদেশে। স্বাধীনতা অর্জনের পর পাকিস্তানের সঙ্গে সৌজন্যের কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও তা বরাবরই শীতল রয়ে গেছে।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যাই হোক, জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক একেবারেই নেই। এই বিচ্ছিন্নতার মূল কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টির কোনো মিল নেই; বিচ্ছিন্নতাটা আসলে মানসিক। কিন্তু ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা তেমন নয়। বাংলাদেশ আর ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ একসময় অভিন্ন বাংলা ছিল।
পূর্ব বাংলা থেকে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশ হলেও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আমাদেরও আবেগের সম্পর্কটা এখনো রয়ে গেছে। দেশভাগের সময় বা পরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় এপার বাংলা থেকে সংখ্যালঘুদের অনেকেই ভারতে চলে গিয়েছেন বা চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। যতই বাধ্য হন, তাদের শেকড় তো বাংলাদেশেই।
বাংলাদেশে ভারতের গান, সাহিত্য, সিনেমা, টেলিভিশন দারুণ জনপ্রিয়। কিন্তু সমস্যাটা হয়, যখন পুরো বিষয়টা হয় একতরফা। একটা গল্প বলি। এক লোক বললো, রাজকন্যার সাথে তার বিয়ের ৫০ ভাগ অগ্রগতি হয়েছে। বন্ধুরা কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলো, কিভাবে? সেই লোক বললো, আমি রাজি। কিন্তু রাজকন্যা এখনও রাজি হয়নি। ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্কটা কখনো কখনো এমন একতরফা।
বাংলাদেশের বিশাল বাজারের পুরো সুবিধাটা ভারত নেয় ষোল আনা। বাংলাদেশে ভারতের সিনেমা চলে, ভারতীয় শিল্পীদের গান আমাদের ঠোঁটে ঠোঁটে। ভারতীয় লেখকদের গল্প-উপন্যাস বিক্রি হয় দেদারসে। ঈদে ভারতীয় টেলিভিশনের নায়িকার পোশাক না পেলে বাংলাদেশের তরুণী আত্মহত্যা করে।
কিন্তু দেখুন ভারতের লোকজন বাংলাদেশের তেমন কাউকে চেনেই না। বাংলাদেশের অনেক উপন্যাস আছে, যা ভারতের বাঙালিরা পড়তে পারতো। অসাধারণ সব গান আছে আমাদের, ভারতের মানুষের দুর্ভাগ্য, তারা সে সব গান শুনতেই পায় না। ভারতের সব চ্যানেল বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল সেখানে দেখাই যায় না। অনেকে বলেন, চাহিদার কথা। চাহিদা তৈরির সুযোগ দিতে হবে তো।
ভারতের বাঙালি পাঠকরা কেন হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল বা আনিসুল হক পড়বেন না? রুনা লায়লা বা সাবিনা ইয়াসমিনের গান কেন শুনবেন না তারা? অন্যদের কথা না হয় বাদই দিলাম, গণমাধ্যম তো দুই দেশের সম্পর্কে ন্যায্যতা ও সমতা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু হয়েছে উল্টো। ভারতের গণমাধ্যমের কাছে বরাবরই বাংলাদেশ এক উপেক্ষিত নাম। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মারা গেলে বাংলাদেশের সব গণমাধ্যমে শীর্ষ সংবাদ হয়।
আর হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুসংবাদ পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকায় সিঙ্গেল কলাম নিউজ, তাও সব পত্রিকায় নয়, কোনো কোনো পত্রিকায়। অমিতাভ বচ্চনের জন্মদিনও আমাদের গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়। আর আমাদের নায়ক রাজের মৃত্যুসংবাদও ঠাঁই পায় না তাদের পত্রিকায়।
নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশে এলে পত্রিকা বা টিভিতে আর কোনো নিউজই থাকে না। আর শেখ হাসিনার ভারত সফরের খবর মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজতে হয়। এমন হাজার হাজার উদাহরণ দেয়া যাবে। পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকাগুলো ইচ্ছা করেই বাংলাদেশের সম্মানিত মানুষদের নামের বানান ভুল করে। আসলে আমার ধারণা তারা ইচ্ছা করেই বিকৃত করে। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের গণমাধ্যমের আগ্রহ একেবারে নেই বলা যাবে না। বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক আর বিভ্রান্তিকর সংবাদে তাদের প্রবল আগ্রহ।
সাম্প্রদায়িক কোনো ইস্যু পেলে তো ঝাঁপিয়ে পড়ে। কদিন আগে ভারতীয় এক সাংবাদিক মিয়ানমারের একটি অনলাইন পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টার একটি খবর প্রকাশ করেন। সেই অনলাইন পত্রিকার সূত্র ধরে ভারতের একটি অখ্যাত টিভি স্টেশন বিশাল গল্প ফেঁদে বসে।
এমন আয়োজন করে যেন ইন্ধিরা গান্ধী হত্যার পর এত বড় ষড়যন্ত্র আর হয়নি। তাদের আয়োজনে তারা বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী, বাংলাদেশের দুই সাংবাদিক, বাংলাদেশে এক সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনারকে কানেক্ট করেন। কেউই ঘটনার ব্যাপারে কিছু বলেননি। কিন্তু তারপরও তারা ফেনাতেই থাকে। শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে, এমন কিছু ঘটেনি।
কিন্তু ভারতীয় মিডিয়ার তুলকালাম দেখলে মনে হতেই পারে না জানি কী হয়েছে। এ ধরনের ভুয়া নিউজ প্রচারের জন্য পরে তারা দুঃখপ্রকাশ করেছে, এমন কোনো খবরও পাইনি। সর্বশেষ ভারতের জি নিউজ বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে খুবই আপত্তিকর সংবাদ করেছে।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর সরকারের সাথে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার টানাপড়েন চলছে। শেষ পর্যন্ত তিনি ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছেন। গত অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের গণমাধ্যমের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকছেন প্রধান বিচারপতি।
কিন্তু জি নিউজ বলে দিলো, বাংলাদেশের গণমাধ্যম রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিয়ে ব্যস্ত, প্রধান বিচারপতি প্রসঙ্গে চুপ। ছুটি নেয়ার পর অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে প্রধান বিচারপতি তার বাসাতেই ছিলেন। এই সময়ে তিনি ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গেছেন, অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনে গেছেন, আইসিডিডিআর’বিতে গেছেন।
প্রধান বিচারপতি তো আর রাস্তায় ঘুরে ঘুরে নিজের উপস্থিতি জানান দেবেন না। অথচ জি নিউজ তাদের রিপোর্টে বলে দিল, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিকে জোর করে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। তারা আরো বললো, তাঁকে অপহরণ করা হয়েছে বা তিনি লাপাত্তা হয়ে গেছেন। কী ভয়ঙ্কর হাস্যকর কথা।
ভারতীয় হাইকমিশনার নাকি তাকে পাচ্ছেন না। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি কি যখন তখন ভারতীয় হাইকমিশনারের জন্য তৈরি থাকবেন? অথচ ভারতেরই একটি অখ্যাত টিভি চ্যানেল ওয়ার্ল্ড ইজ ওয়ান নিউজ টেলিফোনে ঠিকই তাঁকে পেয়েছে।
প্রধান বিচারপতি যতই বলেন, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনি প্রেসের সাথে কথা বলতে পারেন না, ততই তারা প্যাঁচায়। কিন্তু যার সাথে তারা টেলিফোনে কথা বলতে পারেন, তাঁকে লাপাত্তা বলেন কোন আক্কেলে?
সেই অখ্যাত টিভি চ্যানেলের ক্লিপিং ব্যবহার করে জি নিউজের ত্যানা প্যাঁচানো চলতেই থাকে। প্রধান বিচারপতি কথা বলতে না চাইলেও তারা সেটুকুকে ধরে নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে থাকে- কথা শুনে মনে হচ্ছে তিনি ভয়ে আছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে সবচেয়ে আপত্তিকর হলো জি নিউজ সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে ‘হিন্দু’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাদের দাবি হিন্দু বলেই তাঁকে এই ‘সাজা’ পেতে হচ্ছে। আর বাংলাদেশে হিন্দুদের জীবন খুব কষ্টের। জি নিউজ দাবি করেছে, তারা সবসময় সব ধর্মের মানুষের পাশে থাকে। কিন্তু প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে করেছে চরম সাম্প্রদায়িক রিপোর্ট।
সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সাথে সরকারি দলের যে টানাপড়েন, আপনি তার সমালোচনা করতে পারেন। কিন্তু সুরেন্দ্র কুমার সিনহা হিন্দু বলেই সরকার তাকে সাজা দিচ্ছে, এমন ভাবনা কোনো সুস্থ মানুষের মনে আসবে না। তাহলে আওয়ামী লীগ তাকে প্রধান বিচারপতি বানালো কেন?
আমি নিশ্চিত প্রধান বিচারপতি মুসলমান হলেও তাঁর পরিণতি একই হতো। শুধু জি নিউজ নয়, এনডিটিভিসহ ভারতের আরো অনেক গণমাধ্যমেও সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে ‘বাংলাদেশের প্রথম হিন্দু প্রধান বিচারপতি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যম তো দূরের কথা, সাধারণ মানুষও তাঁকে হিন্দু হিসেবে বিবেচনা করেনি।
বলতে দ্বিধা নেই, ভারতের কোনো কোনো গণমাধ্যম সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াতে ওস্তাদ। ভারতের সাংবাদিকদের কি কোনো নিয়ম-নীতি মানতে হয় না? প্রিয় দাদাবাবুরা আপনারা খালি আমাদের গন্ধ না খুঁজে, নিজেদের দিকেও একটু তাকান। মুখে অসাম্প্রদায়িক না বলে, কাজেই প্রমাণ করুন।
প্রভাষ আমিন: সাংবাদিক, কলাম লেখক; বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ।
probhash2000@gmail.com
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন