প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ ছুটি নিয়ে বিদেশে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের হাতে যে বিবৃতিটি ধরিয়ে দিয়ে গেছেন, তাতে কিছু বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছেন এবং নতুন কিছু বিতর্কের জন্ম দিয়ে গেছেন।
তবে সবচেয়ে বড় কথা, তাঁকে নিয়ে বিএনপিসহ কোনো কোনো মহল অসত্য প্রচারণায় ধূম্রজাল সৃষ্টি এবং রাজনৈতিক চক্রান্তের যে জাল ছড়াচ্ছিল সেটি ব্যর্থ হয়েছে। প্রধান বিচারপতির বিদেশযাত্রাকালীন বক্তব্যই সেই চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়েছে।
ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত রায় প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই প্রধান বিচারপতির কিছু ‘পর্যবেক্ষণ’ (Observation) নিয়ে দেশে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। তা হতেই পারে। বিখ্যাত ব্রিটিশ বিচারপতি লর্ড জাস্টিস ড্যানিংয়ের কোনো কোনো রায়, বিশেষ করে কয়লাখনির শ্রমিকদের ধর্মঘটের সময়ে দেওয়া রায় নিয়ে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। কোনো কোনো মিডিয়া তাকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছে; কিন্তু সীমা অতিক্রম করেনি। রাজনৈতিক দলগুলো তা নিয়ে কোনো রাজনৈতিক চক্রান্ত শুরু করেনি।
কিন্তু বাংলাদেশে সবই অভিনব। বিচারপতি সিনহাকে নিয়ে দেশে বিতর্ক শুরু হতেই দেখা গেল একটি রাজনৈতিক দল (বিএনপি), একটি সুধীসমাজ এবং একটি মিডিয়া গ্রুপ তাঁর অতি দরদি হয়ে উঠেছে।
মনে হলো, ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি’—এই প্রবাদটি সঠিক। প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণটি ছিল অবশ্যই বিতর্কমূলক। তিনিও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। তাঁর বক্তব্য নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অবশ্যই আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে। তবে তা হতে হবে সংবিধানভিত্তিক। প্রধান বিচারপতি কোনো ভুল করে থাকলে তার প্রতিকারও সংবিধানে আছে।
কিন্তু বিচার বিভাগের এই মর্যাদা ও নিরপেক্ষতাকে কোনো সম্মান দেখায়নি বিএনপি ও তাদের সহযোগী কুচক্রী মহল। তারা দেশে পাকিস্তানের কায়দায় একটি জুডিশিয়াল ক্যু ঘটানোর চেষ্টা করেছিল এবং সন্দেহ নেই, প্রধান বিচারপতিকে তারা ব্যবহার করতে চেয়েছিল। প্রধান বিচারপতি তা বুঝতে পেরে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেন; কিন্তু তত দিনে দশচক্রে ভগবান ভূত হয়ে গেছেন। বিএনপি জন্ম থেকে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নয়, চক্রান্তের রাজনীতিতে জড়িত। এটা ছিল সম্ভবত তাদের লেটেস্ট কন্সপিরেসি। সে জন্যই বিচারপতি পর্যবেক্ষণে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সরকারকে অবৈধ ও বর্বর বলা সত্ত্বেও গায়ে না মেখে তাঁকে তারা ‘মাসির দরদ’ দেখাতে শুরু করেছিল।
বিএনপির এই প্রপাগান্ডায় আওয়ামী লীগের এক শ্রেণির মন্ত্রী ও নেতার মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং তাঁরাও বিএনপির পাতা ফাঁদে পা দিয়ে প্রধান বিচারপতির তীব্র সমালোচনা শুরু করেন। তাঁরাও সীমা লঙ্ঘন করেন। ফলে বিতর্কটি আর সংবিধান ও বিচার বিভাগের মর্যাদার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা একটি রাজনৈতিক শক্তির দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। এই দ্বন্দ্বে বিএনপি জয়ী হয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হয়েছে। আমাদের আইনমন্ত্রী ব্যক্তিগত বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে বিষয়টি ভালোভাবে হ্যান্ডেল করতে পারেননি, এ অভিযোগও বাজারে রয়েছে।
বিএনপির প্রপাগান্ডার মূল কথা ছিল, আওয়ামী লীগ সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করেছে। ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে অসম্মান ও অগ্রাহ্য করেছে। সরকার বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব চাপাতে চায়। প্রধান বিচারপতি সিনহা সরকারের বশংবদ না হওয়ায় তাঁকে অপসারণ করতে চায়। তাঁকে নানা অভিযোগ তুলে পদত্যাগে বাধ্য করতেও চায়।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে বিএনপি কতটা শ্রদ্ধাশীল ছিল, তা জানতে হলে পড়তে হবে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েমের আত্মকথা, আরো জানা যাবে খালেদা জিয়ার আমলে কয়েকজন বিচারপতির হেনস্তা এবং তাঁদের নিয়োগ বাতিল করা ইত্যাদি ঘটনায়। তাঁদের অপরাধ ছিল, তাঁরা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিযুক্তি পান। পরবর্তী বিএনপি সরকার এই নিযুক্তি স্থায়ী না করে বাতিল করে। দেশের বিচার বিভাগের কারা দলীয়করণ চেয়েছিল, তা দেশের মানুষের ভালোভাবেই জানা।
এবার ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত রায়ের সঙ্গে যুক্ত প্রধান বিচারপতি সিনহার পর্যবেক্ষণগুলো নিয়ে বিএনপির অতি উৎসাহী হয়ে ওঠার একমাত্র কারণ ছিল, তারা ভেবেছিল, এই পর্যবেক্ষণগুলোকে রাজনৈতিক ইস্যু করে তারা সরকার উত্খাতের চক্রান্ত সফল করতে পারবে। তাদের চক্রান্তে সহযোগী হয়েছিলেন দেশের একাধিক বিখ্যাত আইনজীবী। তাঁরা ভেবেছিলেন, প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণগুলো দ্বারা সরকার উচ্ছেদের একটি মোক্ষম অস্ত্র তাঁরা হাতে পেয়েছেন। এই ভরসায় তাঁরা প্রধান বিচারপতিকে কেন্দ্র করে গুজবের পর গুজব ছড়াতে শুরু করেছিলেন। ঘটনার শুরুতেই তাঁরা প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য হুমকি দেওয়া হচ্ছে এবং নানা অভিযোগ তোলা হচ্ছে, হুমকির মুখে প্রধান বিচারপতি কানাডা ও জাপানে চলে যাচ্ছেন, আর ফিরবেন না, তাঁকে দুর্নীতির মিথ্যা মামলায় জড়ানো হবে ইত্যাদি গুজব ছড়াতে থাকেন। এই গুজব মিথ্যা প্রমাণিত হয় এবং প্রধান বিচারপতি দেশে ফিরে আসেন। তাঁকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না—এই গুজবও মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
দেশে ফেরার পর তিনি ছুটির আবেদন করেন। এবার শুরু হয় তাঁকে নিয়ে বিএনপির নতুন গুজব ছড়ানো। তিনি অসুস্থ নন, তিনি গৃহবন্দি, তাঁকে দীর্ঘ ছুটি নিয়ে বিদেশে যেতে বাধ্য করা হয়েছে, তিনি সপরিবারে চিরতরে দেশত্যাগ করে যাচ্ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এই প্রচারণাও বিদেশযাত্রার মুহূর্তে মিথ্যা প্রমাণ করে দিলেন প্রধান বিচারপতি নিজেই। তিনি বলেছেন, ‘আমাকে ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়নি। আমি নিজ থেকেই ছুটি নিয়েছি। ছুটি শেষে দেশে ফিরে আসব। বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকুক, এটাই আমি চাই। ’
রাষ্ট্রপতির কাছে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পাঠানো চিঠিতেও বলা হয়েছে, তিনি কিছুদিন বিদেশে কাটাতে চান। সরকারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ব্যাপারে তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী ও কয়েকজন মন্ত্রী একটি রায় নিয়ে তাঁর সমালোচনা করায় তিনি বিব্রত। তবে তাঁর বিশ্বাস, একটি রায়কে কেন্দ্র করে তার ভুল ব্যাখ্যা জানানোর ফলেই প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রতি অভিমান করেছেন। এই অভিমান শিগগিরই কেটে যাবে।
প্রধান বিচারপতির এই স্পষ্ট বক্তব্য বিএনপির মিথ্যা প্রচারের ঢাকটিকে স্তব্ধ করবে কি? যদি না-ও করে, প্রধান বিচারপতিকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও তাদের সমমনা কতিপয় মহল সরকার উচ্ছেদের যে ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছিল, তা ব্যর্থ হয়ে গেল। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘকাল ধরে অসুস্থতার ধুয়া তুলে লন্ডনে অবস্থান করছেন। বিএনপির হেডকোয়ার্টার এখন লন্ডনে। বিএনপির নেতারা হয়তো আশা করছিলেন, প্রধান বিচারপতিকে কেন্দ্র করে যে ষড়যন্ত্রের জাল তাঁরা বুনেছিলেন, তা সফল হবে এবং মাতা-পুত্র বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে আবার ক্ষমতার ডাণ্ডা হাতে নেবেন, বিএনপির ঘোড়াশালে ঘোড়া থাকবে, হাতিশালে হাতির গর্জন শোনা যাবে। কিন্তু সেই আশায় ছাই দিয়েছে প্রধান বিচারপতির বিদেশযাত্রাকালীন বক্তব্যও।
প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে। সে সম্পর্কে সহযোগী বিচারপতিরা তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং এ সম্পর্কে তাঁদের ভূমিকাও বিশ্লেষণ করেছেন। এটি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। প্রধান বিচারপতি যদি কোনো অন্যায় করে থাকেন, তাহলে দেশের প্রচলিত আইন অনুসারেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিএনপি এটিকেও যদি সরকারের কারসাজি বলে প্রচার চালায়, তাহলে বিস্মিত হব না।
লন্ডনে কয়েক বছর আগে এক বিচারপতি আদালত থেকে বাসায় ফেরার পথে গাড়ি থামিয়ে যৌনকর্মীদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। পুলিশ তাঁকে ধরে ফেলে। তিনি অভিযুক্ত হওয়ার আগেই পদত্যাগ করেন। তাঁর স্ত্রী আত্মহত্যা করেন। এটি নিয়ে কেউ বিচার বিভাগের মর্যাদায় হাত দেয়নি এবং কোনো রাজনৈতিক ইস্যুও করেনি। কিন্তু বাংলাদেশে বিএনপির হতাশ রাজনীতিকরা প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোকেও রাজনৈতিক ইস্যু করার চেষ্টা করতে পারেন। সন্দেহ নেই, তা ব্যর্থ হবে। আমার আশা, প্রধান বিচারপতি যেমন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চান, তেমনি এই স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষার জন্য তাঁর সম্পর্কে তোলা অভিযোগগুলো এড়িয়ে না গিয়ে সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করবেন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
পাঠক মন্তব্য
torr motonn oboiidho..aowami bakshal hasina-rr..abdul gaffar-raa..aarr koto..miithaa..kothaa..boliibe..shov miithukk-derr..diinn kaall shesh hoye..geshe..shaaraa..deshe..deshe..shaaraa..biisshe..shov shashty eaii duniiyaate o kobore..hobeii hoiibe..rokkhaa..paiibii naa.
By default ,a corrupted Justice Shamsuddin Manik knows reports of huge corruptions committed by the Chief Justice Surrendra Sinha. Actually they all were birds of a feather. All the BAL/ RAW brutal Justices including these two suppressed the few honest Justices in the Supreme Judiciary. Justice Khairul and these groups enjoyed huge advantages from the brutal BAL/RAW govt , though some of them grew inimical to each other for clash of interest. These Justices were all busy implementing BAL /RAW directions historically in the worst possible manner , leading the whole country into anarchy and pandemonium. NB: Alongside corruption and sex allegation, some justices have the record of involvement of killing political opponents while they were university students.Since they were BAL/RAW selected,no body could vehemently challenge them.They have long been using Judiciary to hold mock trials and to let loose the BAL/RAW Police/RAB in committing nationwide heinous oppression,abduction and crossfires.
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন