এ বছর আমি রোমান পোলানস্কির মাস্টার ক্লাশে স্বশরীরে উপস্থিত ছিলাম, ২০১৭ এর কান চলচ্চিত্র উৎসবে। কানের ৭০ তম আসরে আমার একটি ক্ষুদে ছবি ‘দাগ’ শর্ট ফিল্ম কর্নারে ছিল। সেই সুবাদে এই ক্লাসে যাওয়ার সুযোগ আমি পাই। পিয়ানিস্টের মত দুনিয়া কাঁপানো অসংখ্য সিনেমার স্রষ্টা মি. পোলানস্কি কতটা দাপুটে বা ক্ষ্যাপাটে আমার এ দেশীয় অসংখ্য সাংবাদিক বন্ধু দেখেছেন এবার কানে।
ধারনা করাই যায় এমন পাগলামি দেখে কোন প্রশ্ন করারই সাহস থাকবে না আমার মত তৃতীয় বিশ্বের কোন ছোট ছবির নির্মাতার। নইলে আমার প্রথম প্রশ্নই হতো স্যার, আপনি কেনো আমেরিকা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন জেল না খেটে। অথবা আমেরিকার সাথে যাদের অপরাধী প্রত্যার্পণ চুক্তি আছে সেই সব দেশে আপনি কেনো যান না। কেনো থাকেননি বৃটেনে, যেখানে আপনার নিজের বাড়ি ছিলো। অথবা বাড়িটি কেনো বিক্রি করলেন?
রোমান পোলানস্কি নিয়ে আর কোন কথা বলার আগে আমি শুধু জানতে চাই, বাংলাদেশের খান আতা কি রোমান পোলানস্কির চেয়ে বড় চলচ্চিত্র নির্মাতা? অথবা সমান? যদি তাই না হয় পোলানস্কির সামান্থা ধর্ষণ কাণ্ড জেনেও আমরা তাকে ভালোবাসি কি? উত্তরে আমি অন্তত বলতে পারি আসলেই তাকে ভালোবাসি এবং ভালোবেসেই যাবো।
কেউ প্রশ্ন করলে ঔদ্ধত্য হবে যে খান আতা কি স্যার পোলানস্কির চেয়েও বড় নির্মাতা? এ কারণেই আমার মাথায় আসে না, রোমান পোলানস্কির অন্ধকার দিক আমরা মেনে নিতে পারলেও কেনো খান আতার স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকাণ্ড বিশ্বাস করতে পারছি না?
খান আতার কিছু কর্মকাণ্ড নিয়ে আমি সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদ এর একটি লেখার অংশ বিশেষ তুলে ধরছি। ২০১৩ সালে তিনি এটি লিখেছিলেন, ‘‘১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট দুপুরে ঢাকা বেতারে বীরদর্পে ঢুকলেন একাত্তরের কোলাবরেটর খান আতাউর রহমান(যার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়ীদ সেসময় গভীর শোক প্রকাশ করেন)। হারমোনিয়াম তবলা নিয়ে বসে গেলেন, রচনা করলেন ‘এদেশ ধ্বংস হলো কাহাদের জন্য’। পুরুষ ও নারী কণ্ঠের দু’জন বেশ দ্রুত সুর তুলে লাইভ গাইলেন, এরপর ক্রমাগত রেকর্ডে গানটি বাজতে থাকে। এরপরই রচিত হলো আরেকটি গান ‘অলি আল্লাহর বাংলাদেশ পীর মুর্শিদের বাংলাদেশ।’ আফরোজা বানু বিকেলে অনুষ্ঠান ঘোষণায় ছিলেন।
১৯৯৬ সালে এই গানটি ঢাকা বেতার থেক বাজতো আবু সাইয়িদ, মন্ত্রী থাকাকালে। এমনকি যুদ্ধকালে পাকিদের প্রচার করা ব্রাক্ষ্মণ্যবাদবিরোধী নাটকগুলোও প্রচার হতো।
খান আতা প্রতিরাতে ঢাকা বেতার থেকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গীতিনাট্য প্রচার করতো। বাধা গায়ক-গায়িকা ছিল গোপীবাগের লাভলী ইয়াসমীন, মিলি জেসমিন, নাজমুল হুদা। ধারা বর্ণনায় ফরিদপুরের হেলেন শের ছদ্মনামে, পরবর্তীতে খবর পাঠিকা চৌধূরী রীণানাসির হিন্দি ও কলকাতার বাংলা গানের প্যারোডি করতেন। একটা গান মনে আছে, গীতাদত্তের বিখ্যাত গান ‘মেরা সুন্দর স্বপ্নাবীত গেয়া’র প্যারোডিটি ইন্দিরাকে আক্রমণ ও মুক্তিযোদ্ধা নামক দুর্বত্তদের বিরুদ্ধে।
শিল্পএলাকা তেজগাঁও হওয়াতে শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বাধীন শ্রমিকলীগ এফডিসিতে শক্তিশালী ছিলো। স্বাধীনতার পর খান আতাকে শ্রমিকরা ধরে মারধর করে। খবর পেয়ে শব্দসৈনিক আলমগীর কবির ও হাসান ইমাম, মনি ভাইকে অনুরোধ করেন মাফ করার জন্য। খান আতা বেঁচে যায়।
ড. নীলিমা ইব্রাহীমের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু বেতার-টিভিতে দালালদের চিহ্নিত করতে কমিটি করেন। এবারও মানিকগঞ্জে জন্ম খান আতা বেঁচে যান কমিটিতে হাজির হওয়া নিয়ে, কমিটি প্রধানের বড় জামাতা আলমগীর কবিরের কারণে।
জহির রায়হানের টিমের সবাই সীমান্ত পাড়ি দিলেও খান আতা রয়ে যান-সুবিধা ছিল উর্দু সিনেমা নির্মাতা তিনি। পাকিস্তানে তার ‘সোয়ে নদীয়া জাগে পানি’ জনপ্রিয়তা পায়। হাসান ইমাম ওই ছবির নায়ক।
সুমিতা দেবী বলেছেন, আতা তাকে এপ্রিলের শেষে টিভিতে নিয়ে যায় এই বলে, বাঁচতে হলে নাটক করতে হবে। একটি নাটকে অভিনয়ের পর বুঝলেন বাংলা নামের কারণে হানাদাররা তাকে খুঁজছে। তিনি দেশ ছাড়েন আতাকে না জানিয়ে।
আতার নায়ক জাফর ইকবাল আগরতলা চলে গেলে আতা তাকে ফিরিয়ে আনেন। এ নিয়ে নানা কথা রয়েছে।
নবাব সিরাজউদ্দৌল-র নির্মাতার দোহাই দিয়ে আতা রেহাই পেয়ে শোধ নিলেন ১৯৭৩-৭৪ সালে। নির্মাণ করলেন মুক্তিযোদ্ধাদের চরিত্র হননকারী সিনেমা ‘আবার তোরা মানুষ হ’। ওই সিনেমাটি মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে মানুষের মনে এমন বিতশ্রদ্ধ ধারণা তৈরি করে যার মাশুল তারা আজো দেয়। মুক্তিযোদ্ধা মানেই হাইজ্যাকার, নকলবাজ ইত্যাকার চরিত্র দেখিয়ে পুরো যোদ্ধাদের দশ হাত দেখায়। শব্দসৈনিক নারায়ণ ঘোষ মিতা এর কাউন্টারে বানালেন ‘আলোর মিছিল’।
খান আতা ১৯৭৬ সালে সরকারি অর্থে নির্মাণ করলেন প্রামাণ্যচিত্র ‘ওয়াটার অব গ্যান্জেশ’-ভারত ও শেখ মুজিব শাসন বিরোধী আধাঘণ্টার চিত্রটি টিভি-সিনেমা হলে প্রচার করে দেশের মানুষের মনে ভারত বিরোধীতা তথা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মানুষকে বিষিয়ে তোলে, যার রেশ এখনো বহাল।
খান আতার শেষ সিনেমা মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক ‘এখনো অনেক রাত’ বানিয়ে জানান দিয়ে গেছেন যোদ্ধাদের ভোর অনেক দূরে।
৭১ এ খান আতার স্বাধীনতা বিরোধী ভূমিকার একটি প্রামাণ্য দলিল হলো তার একটি বিবৃতি।
পাকিস্তানিদের পক্ষে দেয়া এই বিবৃতির বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেননি। সাপ্তাহিক বিচিন্তাকে তিনি লিখে জানিয়েছিলেন, এই বিবৃতিতে জোর করে নেয়া হয়েছিলো তার স্বাক্ষর। খান আতাকে যদি সত্যবাদী ধরে নিয়ে কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করে যে, তাহলে তিনি যে ৯ মাস ধরে বেতার-টিভিতে পাকিস্তানি বন্দনা করলেন তাতে তাকে কি জোর করে প্রতিদিন নিয়ে গিয়েছিলো পাকিস্তানি আর্মি? আর তিনি এতো দীর্ঘ সময়েও কেন পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি যেমনটি করেছিলেন অজস্র বাঙালি?
আরেকটা প্রশ্ন আসতেই পারে যে, তিনি যদি মন থেকে সৎ হন তাহলে ১৬ ডিসেম্বরের পর ৩/৪ মাস পালিয়েছিলেন কেনো অন্যান্য রাজাকারের মত?
তার ব্যক্তিগত ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ বলেইতো ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবিটি যে মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করতে নির্মান করা হয়েছে এই প্রশ্ন যে কেউ করতে পারেন।
অনেকেই বলতে পারেন তাহলে স্বাধীনতার পর খান আতাকে ছেড়ে দেয়া হলো কেনো? এ বিষয়ে নাট্যজন নির্মাতা ও মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেছেন, মানবতার বিরুদ্ধে তার কোন অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধে সংশ্লিষ্টতা নেই বলে তিনি ক্ষমা পেয়েছেন।
খান আতা নিজেও জানতেন যে ৭১ এ তার সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো, পরবর্তীতে তিনি এটি অনুভব করতে পেরেছিলেন এটা প্রমাণিত সত্য এবং আমাদের তা মেনে নিতে হবে।
তবে একটি বিষয়ে অনেক খারাপ লাগে যেটি হচ্ছে বিষয়টি উত্থাপনকারী নাসির উদ্দীন ইউসুফকে যখন আক্রমণ করেন মুক্তিযোদ্ধা দাবিদার কেউ কেউ। তারা একবারও ভাবেন না যে, চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেইতো দুজনের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য।
একজন ‘একাত্তরের যিশু’ আরেকজন ‘আবার তোরা মানুষ হ’ এর নির্মাতা। আর ৭১ এর ভূমিকা? একজন দেশ স্বাধীনের জন্য জীবনবাজী রেখে যুদ্ধ করেছেন আরেক জন রেডিও- টিভিতে পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়েছেন।
একই সময়ে পাকিস্তানি ছবি বিট্রেয়ালের সরকারি পরিচালনা করেছেন যেটা দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা আড়ালের অপচেষ্টা হয়। খান আতা পরিস্থিতির শিকার বলে সহানুভূতি দেখিয়ে যেসব মুক্তিযোদ্ধারা নাসির উদ্দিন ইউসুফকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে অপমান করছেন তাদের কী বলবো?
জসীম আহমেদ: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা।
jahmed@glbangladesh.com
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন