বিয়েটা ছিল প্রেমের। কঠিন প্রেমই বলতে হয়। নাহলে নিশ্চয়ই পরিবারের অমতে ‘প্রেমিক’ সবুজ শেখকে বিয়ে করতেন না জেসমিন আক্তার। অন্তত জেসমিনের দিক থেকে এই সম্পর্কে খাদ ছিল না বলেই মনে হয়।
বছর সাতেক আগে প্রেমের টানে জেসমিনের নেওয়া সিদ্ধান্তটি যে মস্ত বড় এক ‘ভুল’ ছিল, তা প্রকাশ্য হতে বেশি সময় লাগেনি। বিয়ের পর জেসমিনের কাছে সবুজের প্রতারণা ধরা পড়ে। বিদ্যমান এক স্ত্রী ও দুই সন্তান থাকার বিষয়টি গোপন করেছিলেন সবুজ। প্রিয় মানুষের এমন বিশ্বাসভঙ্গে দারুণ কষ্ট পান জেসমিন। চলে যান বাবার বাড়ি। সবুজের পীড়াপীড়ি ও পরিবারের সম্মতিতে ফের স্বামীর বাড়িতে ফেরেন। তাঁর মনে হয়তো নতুন বিশ্বাস জন্মেছিল। স্বামীর প্রতারণা ভুলে হয়তো নতুন করে সবকিছু শুরু করতে চেয়েছিলেন তিনি।
সবুজকে জেসমিন বিশ্বাস করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু স্বামীর বিশ্বাস পাননি তিনি। সবুজের মনে ভর করে সন্দেহ। এত কিছুর পরও যে বউ সংসার করছেন, তাঁকে বিস্তর সন্দেহ স্বামীর। নিজের পরিবারের পুরুষ সদস্যের সঙ্গে জেসমিনের কথা বলাও সবুজ সন্দেহের চোখে দেখতেন। এ জন্য জেসমিনকে হরহামেশা মারতেন সবুজ। বছরখানেক আগে স্বামীর মারে জেসমিনের নাক ভেঙে যায়।
জেসমিন বুঝে গিয়েছিলেন, ‘ভুল সবই ভুল’। মিছে আশায় এক প্রতারক, নিপীড়ক স্বামীর সংসার করছেন তিনি। স্বামীর নির্যাতনে অতিষ্ঠ জেসমিন ছয় মাস আগে সবুজকে তালাকের নোটিশ পাঠান। ভেবেছিলেন, এবার হয়তো তাঁর রেহাই মিলবে!
বেশি দূর পড়ালেখা করেননি জেসমিন। নবম শ্রেণি পাস। বাবা ভাড়ায় মাইক্রোবাস চালান। দুই ভাই তিন বোনের মধ্যে জেসমিন বড়। পরিবারের বোঝা হয়ে থাকতে চাননি তিনি। দুই মাস আগে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি কাপড়ের দোকানে ৭ হাজার টাকা বেতনে কাজ নেন। নিজের আয়ে চলতে চেয়েছিলেন তিনি।
তালাক দিয়েও জেসমিনের রেহাই মেলেনি। তালাক মানছিলেন না সবুজ। তিনি জেসমিনকে অনুসরণ করতেন। তাঁকে ফিরিয়ে নিতে হুমকি দিতেন।
গত রোববার মোহাম্মদপুরে জেসমিনের কর্মস্থলে এসে তাঁকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেন সবুজ। হত্যার দৃশ্য সিসি ক্যামেরায় আছে। সবুজ পলাতক। তাঁকে খুঁজছে পুলিশ (১৭ অক্টোবর, প্রথম আলো)।
পত্রিকায় ছাপা হওয়া জেসমিনের শান্ত চেহারা চোখে ভাসে। তাঁর জীবন, জীবনের পরিণতির বিবরণ পড়ে চোখ ভিজে ওঠে। একটা সুখের সংসারের স্বপ্ন দেখেছিলেন জেসমিন। তাই নিজের পরিবারকে পর্যন্ত অগ্রাহ্য করেছিলেন। বিনিময়ে প্রতারিত হলেন। স্বামীর অহেতুক সন্দেহে কতগুলো বছর দুর্বিষহ জীবন কাটালেন। যে ঘরে তাঁর নিরাপদে থাকার কথা ছিল, সেখানে তাঁর ওপর চলল অমানুষিক নির্যাতন।
মাত্র ২৬ বছর বয়স। এই বয়সে কত কঠিন জীবন পার করে শেষে নির্মমভাবে খুন হতে হলো জেসমিনকে। খুনি আর কেউ নন; খুনি তাঁরই একসময়কার প্রেমিক, স্বামী। যাঁকে ভালোবেসে কুড়ি বছরের তরুণী জেসমিন ঘর ছেড়েছিলেন, সে-ই তাঁর হন্তারক। আমাদের সমাজে ঘরে-বাইরে নারীরা কতটা অনিরাপদ, তাদের জীবন কতটা বিপদাপন্ন—এই ঘটনা তার আরেকটি প্রমাণ।
সমাজ, সমাজের মানুষের হিংস্র মনোবৃত্তি ও পুরুষতান্ত্রিকতার বলি হলো জেসমিন। প্রতারণার জন্য সবুজকে কোনো শাস্তি পেতে হয়নি। বরং ‘যা হওয়ার হয়েছে’ বলে বুঝিয়ে জেসমিনকে ফের স্বামীর কাছে পাঠানো হয়েছিল। এই দফায় স্বামীর সন্দেহে ফানা ফানা হয় জেসমিনের জীবন। এমনকি নিছক সন্দেহ থেকে তাঁর ওপর স্বামীর নির্যাতনের বিষয়টি পরিবার-পরিজনের অজানা ছিল না। স্বামীকে তালাক দিলেও নারীর যে ‘মুক্তি ‘নেই-পুরুষতন্ত্রের এই হিংস্র মনোবৃত্তির প্রকাশ্য মহড়া জেসমিনের নির্মম খুনের মধ্য দিয়ে আরেকবার দেখা গেল।
আমরা নিজেদের সভ্য দাবি করি। নারী-পুরুষের সমানাধিকারের কথা বলি। নারীর উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা কাজও হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, নারীর প্রতি সহিংসতা কমছে না। নারীকে এখনো ‘অধস্তন’, ‘ভোগ্যবস্তু’ হিসেবে দেখা হয়। ফলে রাজনীতি-অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘দৃশ্যমান’ উন্নতি সত্ত্বেও নারীর অবস্থান এখনো ভঙ্গুরই রয়ে গেছে। শিক্ষিত, চাকরিজীবী নারীরা পর্যন্ত হয়রানি-নিপীড়নের শিকার হয়। রাস্তাঘাট, গণপরিবহন, কর্মক্ষেত্র-কোথাও নারী নিরাপদ নয়। বাইরের কথা নাহয় বাদ দিলাম। নারী তার নিজ ঘরেও পুরুষতান্ত্রিক মনোবৃত্তির শিকার হয়। পরিবারই নারীকে চুপ থাকতে শেখায়। স্বামীর নির্যাতনের কথা জেনেও মা-বাবা তাঁদের মেয়েকে সব মেনে নিতে বলেন। সব ঠিক হয়ে যাবে—এমন মিছে আশা দেন। আসলে নারীর সত্যিকারের মুক্তির জন্য পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে। নারীর প্রতি বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কেন্দ্র হতে হবে পরিবার।
ইদানীং মানুষের মধ্যে অতিমাত্রায় জিঘাংসা, হিংস্রতা লক্ষ করা যাচ্ছে। কথায় কথায় মাথায় রক্ত চড়ছে। খুনখারাবি করতে হাত কাঁপছে না। হঠাৎ কী হলো সমাজের, মানুষের? এই জিঘাংসা, হিংস্রতার উৎস কোথায়?
আমাদের দেশে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তার সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক কারণ অনুসন্ধান করা হয় না। এখানেই আমরা পিছিয়ে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারীর প্রতি পুরুষের সহিংসতার সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক কারণ অনুসন্ধান জরুরি হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে দরকার আইনের শাসন তথা ন্যায়বিচার। জেসমিনের হত্যাকারীকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করার দাবি জানাই। সঠিক তদন্ত, অভিযোগপত্র ও বিচারের মাধ্যমে আসামির সর্বোচ্চ শাস্তিই কাম্য।
সাইফুল সামিন: সাংবাদিক
saiful.samin@yahoo.com
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন