জসিম উদ্দিন
বন্ধুত্ব বজায় রাখার বাংলাদেশের যে অবাস্তব ও আজগুবি চেষ্টা সেটা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। দলের স্বার্থে নয় দেশের স্বার্থে বন্ধু নির্বাচন করতে হবে। দলের স্বার্থে বন্ধুত্ব হলে সেটা একসময় দেশের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে যাবে। যার কোনো মাশুল হবে না
পরমাণু বোমা হামলার শিকার পৃথিবীর একমাত্র দেশ জাপান। ভয়াবহ ওই হামলা চালিয়েছে তাদের এখনকার একেবারে ঘনিষ্ঠ বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র। এই বন্ধুত্বের ধরনটি বিস্ময়কর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাস্ত হওয়ার পর জাপানকে বাধ্য হয়ে আমেরিকার বন্ধুত্ব মেনে নিতে হয়! ফলে দেশ দুটির মধ্যে সখ্যতা পাল্লা দিয়ে ক্রমেই বেড়েছে। এই সখ্যতা আসলে জাপানিদের আমেরিকার প্রতি ঝুলে পড়া ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। সারা বিশ্ব সেটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে।
পরমাণু বোমা হামলার বিভীষিকা জাপানিদের এতটাই হীনবল করে দেয় নিজেদের প্রতিরক্ষার ন্যূনতম উদ্যোগ নিতেও তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আমেরিকার সাথে অধীনতামূলক চুক্তি থেকে বের হওয়ার প্রেরণা জাপান আর পায়নি। ফলে প্রতিনিয়ত আমেরিকার ওপর তাদের নির্ভরতা বেড়েছে। এই বন্ধুত্ব যে তাদের আত্মনির্ভরশীল হওয়া কিংবা আত্মশক্তিতে বলীয়ান হওয়ার পথকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, সেই হুঁশ তাদের বহু পরে ফিরেছে। অর্থনীতিই যে সব কিছু নয়, তাও প্রমাণ হয়েছে। প্রযুক্তিতে বিশ্বের প্রধান দেশ, উন্নয়নের শীর্ষ দেশ, এমনকি দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি হয়েও দেশটির অসহায়ত্ব দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। এখন অবশ্য জাপানকে ছাড়িয়ে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে জাপানিদের টেনশন বেশি করে টের পাওয়া যায়। জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ধরেই নিয়েছিলেন, এলোমেলো অগোছালো ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। নির্বাচনের অল্প কিছুদিন আগে আমেরিকা সফরে গিয়ে তিনি ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের সাথে দেখা করে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করেন। নির্বাচনী ফলাফলের আগেই ট্রাম্প তার উগ্র স্বাদেশিকতার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, তার নীতি হচ্ছে আমেরিকা ফার্স্ট। সবার আগে আমেরিকানদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। বন্ধুরাষ্ট্রের ব্যাপারে তিনি বন্ধুত্বের চেয়ে অর্থকড়ির হিসাবের ওপর গুরুত্ব দেন। তার মতে বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে আমেরিকাকে অনেক অর্থ গচ্চা দিতে হচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি হবে অর্থের বিনিময়ে বন্ধুদের নিরাপত্তায় তারা কাজ করবে। ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পরপরই আবের পেরেশানির পারদ চূড়ায় উঠে। তিনি সবার আগে ছুটে যান ওয়াশিংটনে। যার সাথে নির্বাচনের আগে কোনো আলাপ আলোচনার প্রয়োজন মনে করেননি তার সাথে বৈঠকের শিডিউল পাওয়ার জন্য জাপানি কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ দেখা গেছে। অবশেষে ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করতে সমর্থ হন আবে। তবে জাপানিদের নিরাপত্তা আশঙ্কা দূর হয়নি। নতুন করে তাদের অসহায়ত্ব লক্ষ করা যাচ্ছে।
১৯৪৫ সালে জাপানের দুটো শহর হিরোশিমা ও নাগাসাকিকে আণবিক বোমা ফেলে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় আমেরিকা। ওই পরিস্থিতিতে জাপানিদের মনোবল থুবড়ে পড়ে। একেবারে আমেরিকার বশ্যতা শিকার করে নেয় তারা। চুক্তির কোনো শর্তের প্রতিই আর ‘না’ বলার সাহস দেখায়নি তারা। যেমনটি জার্মানিকে নিজেদের ইচ্ছেমতো দুটো ভাগ করে দেয় আমেরিকা ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা মিলে। হিটলারের পতনের পর জার্মানদের কেউ অবশিষ্ট ছিল না এই ভাগাভাগির বিরুদ্ধে জোরালো কণ্ঠ হবে। জাপানের ধারবাহিক উন্নয়ন তাদের এ অধীনতামূলক মিত্রতা থেকে বের হওয়ার পথ করে দেয়। উন্নয়নের বিভিন্ন ধাপে জাপান সেই সুযোগ স্বেচ্ছায় জলাঞ্জলি দিয়েছে বলে প্রতীয়মান, বরং তারা বরাবর আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র সেজে বসেছে। ফলে আত্মরক্ষার জন্য তাদের নিজস্ব উন্নত প্রতিরক্ষাবাহিনী যেমন গড়ে উঠেনি, একইভাবে উন্নত সামরিক সরঞ্জাম তৈরির দিকেও তারা মনোযোগ দেয়নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরো প্রায় সাত দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। ট্রাম্প যখন বন্ধুদের প্রতিরক্ষা করার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার দৃঢ় আশ্বাস দিচ্ছেন না, জাপান তখন তার চারপাশে সামরিক প্রযুক্তিতে অগ্রগামী দেশ দিয়ে ঘেরাও হয়ে গেছে। উত্তর কোরিয়া হাউড্রোজেন বোমা পরীক্ষা চালিয়েছে। জাপানের ওপর দিয়ে আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে এরা। বোমা মেরে জাপানকে পানিতে ডুবিয়ে দেয়ার হুমকিও দিয়েছেন উত্তর কোরীয় নেতা। অন্য দিকে চীন অর্থনীতিতে বিশ্বে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক খেলোয়াড় হয়ে উঠছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিশাল ভাণ্ডার তাদের অভূতপূর্ব শক্তি এনে দিয়েছে। বাণিজ্য বিনিয়োগ নিয়ে সারা বিশ্বে তারা ছড়িয়ে পড়ছে। সামরিক শক্তিতেও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক বাহিনী তাদের। এশিয়ায় তারা এখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি। ট্রাম্পের নেতৃত্বে যখন আমেরিকা একা হয়ে ঘরমুখী হচ্ছে, তখন ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ নিয়ে চীন বিশ্বের নেতৃত্ব গ্রহণ করছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশী চীনের কাছে জাপান তাই অসহায় বোধ করা ছাড়া উপায় নেই। এশিয়া থেকে আমেরিকার হঠাৎ করে সরে পড়া এ অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটেছে। এতে করে জাপানের মর্যাদাগত পতন হয়েছে। ভারতকে পাশে নিয়ে কিছু একটা করার প্রচেষ্টা তারা নিচ্ছে বটে, তবে সেটা অনেক দেরি হয়ে গেছে।
বন্ধুত্বের নামে আমেরিকার বশ্যতা শিকারের এ পরিণতি জাপানকে ভোগ করতে হচ্ছে। সেটা ছিল ঝুলানো বন্ধুত্বের একটা মুলা। এ ধরনের বন্ধুত্বের যে আসলে কোনো মূল্য নেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। প্রযুক্তিগত উন্নতির সাথে সাথে জাপান যদি আমেরিকার বশ্যতা থেকে বের হয়ে এসে সামরিক শক্তি অর্জনে ধারাবাহিক এগিয়ে যেত তাহলে তাদের শ্রেষ্টত্ব আরো দীর্ঘায়িত হতো। সামনে জাপানের অসহায়ত্ব বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আরো বেশি করে দেখা যাচ্ছে।
বন্ধুরাষ্ট্রের ধারণাটা আমরা এখন বুঝে নিতে পারি। বাংলাদেশ এখন এক বিরাট বিপদে পড়েছে। মিয়ানমারের এক অভ্যন্তরীণ সঙ্কটের দায়ভার চেপে বসেছে বাংলাদেশের ওপর। নিজের দেশের মানুষের ওপর খুন ও ধর্ষণ চালিয়ে রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। মিয়ানমারের প্রায় দশ লাখ নাগরিক আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। ঘোরতর অন্যায় করেও মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের সমর্থন পাচ্ছে। চীন রাশিয়া ভারত দেশটির এতটা কঠিন বন্ধু কেউ আগে জানত না। বন্ধুত্বের জোর এতটাই বেশি ধর্ষণ ও খুন করেও তারা এসব দেশের সমর্থন পাচ্ছে। যখন রোহিঙ্গা ইস্যু আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচিত হচ্ছে চীন ও রাশিয়া জোরালোভাবে মিয়ানমারকে সমর্থন করছে। এখন প্রশ্ন হতে পারে, কোনটা বেশি বেআইনি? খুন, ধর্ষণ করা না তাদের প্রতি জোরালো সমর্থন করা। কারণ খুন, ধর্ষণ করছে মিয়ানমার আর তাতে সমর্থন করছে রাশিয়া, চীন ও ভারত। এরাই আবার ধর্ষণের শিকার ওই নারীকে সামান্য চিকিৎসা দিতে চায়। একটু খাদ্য দিতে চায়। এগুলো হচ্ছে ত্রাণ! বাংলাদেশ যদি একটি উন্নত নীতিগত অবস্থান নিতে পারে তাতে ধর্ষণের সমর্থকদের ত্রাণ তারা নিতে পারে না।
বাংলাদেশ নিজেই মিয়ানমারের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছাড়তে চায় না! অথচ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশ আহ্বান জানাচ্ছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে চাপ প্রয়োগের জন্য। বাংলাদেশের এমন নমনীয় আচরণের ফলে মিয়ানমার নিশ্চই বিষয়টিতে সহজ বোধ করছে। সে দেশে গিয়ে বাংলাদেশের মন্ত্রীরা চাল কিনে আনছেন। নিজেরা মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ না করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সেই আহ্বান জানানো কতটুকু যুক্তিযুক্ত। চাল আমদানি অব্যাহত রেখে বন্ধুত্ব বজায় রেখে আসলে কোনো দেশকে চাপ দেয়া যায় না। এই ব্যাপারটি কবে বাংলাদেশ বুজতে পারবে।
বাংলাদেশকে এখন দশ লাখ শরণার্থীর ভার নিতে হয়েছে। ঘনবসতিপূর্ণ গরিব দেশটিকে এ জন্য বড় ধরনের সঙ্কটের মধ্যে পড়তে হয়েছে। বলা হয়ে থাকে বিপদে বন্ধুর পরিচয়। এই সঙ্কটে আমরা দেখলাম এক আজগুবি চিত্র। যাদের বন্ধু হিসেবে ঢাকঢোল পেটানো হচ্ছে তারা রীতিমতো এই সঙ্কটে উল্টো চেপে ধরেছে বাংলাদেশকে। ভারতে থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পুশইন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি মিয়ানমারে, হিসাব মতে তাদের মিয়ানমারে পুশইন করার কথা। মিয়ানমার বলছে রোহিঙ্গারা বাঙালি। সেই হিসেবে তাদের দেশে থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে ভারতও মিয়ানমারের যুক্তিকে জোরালো করছে। ভারত মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাষ্ট্র এমনটি শোনা যায়নি। ভারত বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ রাষ্ট্র এমনটা সবার জানা। অন্ততপক্ষে বর্তমান সরকারের সময় ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক সবচেয়ে উষ্ণ বলে দাবি করা হচ্ছে। তাহলে এমন উষ্ণ সম্পর্কের দাবি কি বন্ধুর ওপর হামলাকারীকে সহায়তা করা? এই প্রশ্নটা বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে উঠানোর কোনো চেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে না।
জাপানের অসহায়ত্বের ব্যাপারটি বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলোকে অনুধাবন করা দরকার। সময়মতো সেটা উপলব্ধি করতে না পারলে সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে একতা থাকলে একই সাথে শক্তিশালী সামরিক শক্তির অধিকারী হলে মিয়ানমার এমন দায়দায়িত্বহীন আচরণ করার সাহস কখনো পেতো না। রোহিঙ্গাদের উৎখাত করে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার জন্য তারা এমন একটি সময়কে বেছে নিয়েছে যখন সত্যিকার অর্থে নির্বাচিত সরকার এ দেশে নেই। একই সাথে বাংলাদেশে বন্ধু বলে যারা পরিচিত তারাও যে বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু নয় সেটা মিয়ানমার বুঝতে পেরেছে। তারা একটা মোক্ষম সময়কে এর জন্য বাছাই করেছে। এই বেলায় তাদের সফলতা বঙ্গোপসাগরে পুরনো মগের মুল্লুক কায়েম করার পথকে উৎসাহিত করবে।
বাংলাদেশের জেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়া, জোর করে মৎস্য আহরণ করা এগুলো তারা করেছে। ইতোমধ্যে তারা নৌমহড়াও দিয়েছে একাধিকবার। বাংলাদেশ যদি সতর্ক না হয় গোটা পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে তাদের নতুন করে ভাবনার উদয় হতে পারে। এ অঞ্চলে থাকা উপজাতি ও বৌদ্ধদের নিয়ে তারা নতুন কোনো চক্রান্তে লিপ্ত হতে পারে। সুতরাং বন্ধুত্ব বজায় রাখার বাংলাদেশের যে অবাস্তব ও আজগুবি চেষ্টা সেটা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। দলের স্বার্থে নয় দেশের স্বার্থে বন্ধু নির্বাচন করতে হবে। দলের স্বার্থে বন্ধুত্ব হলে সেটা একসময় দেশের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে যাবে। যার কোনো মাশুল হবে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন