বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
মেধাহীন মেরুদণ্ডহীন মানুষদের যদি সাংবিধানিক পদে বসানো হয় তাদের আচরণে, কথা বার্তায় জাতিকে সংকটের আবর্তে পড়ে হিমশিম খেতে হয়। এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে গত ১৬ই অক্টোবর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া বিএনপির প্রতিনিধি দলের সামনে সিইসির প্রদত্ত ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে। বিএনপির প্রতিনিধিদের সামনে তিনি বলেছেন, বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন জিয়াউর রহমান। বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের তারিফ প্রশংসায়ও পঞ্চমুখ ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।
পরের দিন কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম ধারাবাহিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে জিজ্ঞেস করেন, জিয়া যদি বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা হন তবে বহুদলীয় গণতন্ত্রের উচ্ছেদ করেছিলেন কে? বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তার বক্তব্যের প্রতিবাদে কমিশনের সংলাপ না করে বয়কট করেন।
সিইসি বৈঠক ডেকেছেন রাজনৈতিক দলগুলোর দাবী-দাওয়া পরামর্শ ইত্যাদি শুনার জন্য। তিনি এত লম্বা চাওড়া বক্তৃতা দিতে গেলেন কেন! বক্তৃতা দেওয়ার সময় তিনি লুব্রিকেটিং অয়েলের ড্রাম পাশে রাখলেন কেন! জাতীয় পার্টির সঙ্গে বৈঠক করতে গিয়েও তিনি ঘি-মাখনের ডিব্বা সঙ্গে রেখেছিলেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপেও রেখেছিলেন।
এটা সত্য যে অর্থবহ নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রয়োজন। তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানোর জন্য সিইসির সত্য মিথ্যা মিশ্রিত ভাষণ, তৈল মর্দন ইত্যাদিরতো প্রয়োজন ছিলো না। শাসনতন্ত্র তাকেতো অনুরূপ কোনো দায়িত্ব দেয়নি। এমনকি রাজনৈতিক দল সমূহের সঙ্গে বৈঠকের কোনো কথাও শাসনতন্ত্রে নেই।
ভারত, বৃটেন, আমেরিকা, জামার্নীতেও নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দল সমূহের সঙ্গে সেসব দেশের ইলেকশন কমিশন বৈঠক করে না। বৈঠক করার সংস্কৃতি শুধু বাংলাদেশেই আছে। পূর্বের চীফ ইলেকশন কমিশনারেরাও বৈঠক করেছেন কিন্তু এ সংস্কৃতিতে লুব্রিকেটিং অয়েল নিয়ে আসলেন এবারের সিইসি মিস্টার হুদা।
হুদা সাহেব ভাষণ দিলেন কিন্তু সত্য মিথ্যা মিশ্রিত করলেন কেন! কয়দিন আগে রাষ্ট্রপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে অকপটে বলেছিলেন যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময়ে তিনি ভর্তি হতে এসেছিলেন। কিন্তু তার রেজাল্ট দেখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার কাছে ভর্তির ফরমও বিক্রি করেনি। কিন্তু আজকে তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। হুদা সাহেবও তো বলতে পারতেন বিএনপি সরকার তাকে ফোর্স রিটায়ারমেন্টে পাঠিয়েছিলেন হাই কোর্টে মামলা করে পুনঃবহাল হয়েছিলেন আর এখন তিনি চীফ ইলেকশন কমিশনার।
আসলে সাংবিধানিক পদ দেওয়া উচিৎ ওই সব লোককে যারা আত্মবিশ্বাসী। ডান বাম না দেখে দৃঢ় পদক্ষেপে নিজ দায়িত্ব সংবিধান মতো পালনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কোনো দলকে নির্বাচনে আনা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নয়। তার দায়িত্ব হচ্ছে অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করা। কারও মন ভাল করার জন্য অসার ভাষণ দেওয়াও তার কাজ নয়।
সরকারী দলের ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সম্ভবতো সিইসি বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য এসব কথা বলেছেন। ওবায়দুল কাদের একি কথা বললেন! বিএনপি কি ললিপপ মুখে নিযে ঘুরে যে সিইসির ছেলে ভুলানো কথায় নাচানাচি করবে।
বিচারপতি আব্দুর রউফ যখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার তখন মাগুরার উপ-নির্বাচন হয়েছিলো এবং তিনি নিজেও নির্বাচনটা পর্যবেক্ষণ করতে মাগুরা গিয়েছিলেন। আর তিনি যখন দেখলেন প্রতিটি কেন্দ্রে একজন করে বিএনপি দলীয় এমপি রয়েছেন আর তারা ভোট কারচুপির কাজে নিয়োজিত আছেন তখন তিনি মাগুরা থেকে পালিয়ে চলে এসেছিলেন। নিজ চোখে দেখার পরও ঢাকায় এসে তিনি এ নির্বাচন বাতিল করেননি। এখন তার কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে যে তিনি মাগুরা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন-সব কিছুর চাক্ষুস স্বাক্ষী হয়ে যাওয়ার ভয়ে কারণ তিনি বিএনপির ঘরানার লোক।
যে যে ঘরানারই হোক না কেন সাংবিধানিক পদে থেকে কাজ করার সময় ঘরানার বিষয়টা তাকে প্রভাবিত না করলেই হলো। বিচারপতি আব্দুস সাত্তার ১৯৭০ এর নির্বাচনে চীফ ইলেকশন কমিশনার ছিলেন। তিনি মোহাজের ছিলেন। মোহাজেররা আওয়ামী লীগকে, বঙ্গবন্ধুকে পছন্দ করতেন না। তারা মনে করতেন শেখ মুজিব ক্ষমতায় আসতে চাইলে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু সাত্তার সাহেব এলএফও-এর বাইরে এক বিন্দু বিসর্গও যাননি এবং আওয়ামী লীগের জিতে যাওয়াকে ঠেকানোর কোনো চাতুরীর আশ্রয় নেননি। অথচ তিনি পাকিস্তানী ঘরানার লোক। ১৯৭০ এর নির্বাচন শতাংশে নির্ভেজাল হয়েছিলো।
বুধবার ১৮ই অক্টোবর আওয়ামী লীগের সঙ্গে চীফ ইলেকশন কমিশনারের বৈঠক হয়েছে। চীফ ইলেকশন কমিশনার হুদাসহ কমিশনের পক্ষে আরো কমিশনারেরা বক্তব্য দিয়েছেন। মাহাবুব তালুকদারের বক্তব্য প্রদানের সময় বঙ্গবন্ধু ও রাসেলের কথা বলতে গিয়ে আবেগ আপ্লুতও হয়েছেন। চীফ ইলেকশন কমিশনার বিএনপি, জাতীয় পার্টির যেভাবে তারিফ প্রশংসা করেছেন ঠিক সেভাবে আওয়ামী বন্দনাও করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা বন্দনার বিষয়ে নিয়ে বেশী কথা না বলার পরামর্শ দিয়ে তাদের প্রস্তাব সমূহ পেশ করে চলে এসেছেন।
নির্বাচন কমিশনকে একটা কথা মনে রাখতে হবে- কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি তার উদ্দেশ্য সাধনে সক্ষম হয় তবে সে তার উৎকৃষ্টতার কারণেই সক্ষম হয়। আর যদি সে উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয় তবে মনে রাখতে হবে তার বিকারের কারণেই সে ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচন কমিশন খুবই স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান। সুতরাং এখানে বিকারগ্রস্ত হলেই বিপদে পড়তে হবে।
গত একমাসব্যাপী কমিশন রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছে। সবার দাবী দাওয়া সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। এখন নির্বাচন অনুষ্ঠানের মূল প্রকল্প প্রণয়নের পালা। প্রকল্প প্রণয়নের সময় মনে রাখতে হবে কোনো ব্যবস্থাই তার সমসাময়িক কালের চেয়ে গুণগতমানে উৎকৃষ্ট হতে পারে না। কমিশন সবাইকে তুষ্ট করতে পারবে না। সুতরাং কমিশনের উচিৎ হবে সংবিধানকে তার অভিভাবক হিসেবে মেনে নেওয়া।
বেগম খালেদা জিয়া লন্ডন বিমান বন্দরে গত ১৭ই অক্টোবর যেসব কথা বলেছেন তাতে মনে হয় নির্বাচনের পূর্বে আরেক অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হবে। নেতৃবৃন্দের দায়িত্বহীনতা, বগ্লাহীন বাগাড়ম্বরের কারণে দেশের রাজনৈতিক পরিবশে হয়ত উত্তপ্ত থাকবে। তখন বিরাট এক চাপের সম্মুখীন হয়ত নির্বাচন কমিশনকে হতে হবে। সব অবস্থায় নির্বাচন কমিশনকে শাসনতন্ত্র আকড়িয়ে থাকাই হবে উত্তম। না হয় পথের দিশা হারাতে হবে। সংলাপে সে ভাষায় কথা বলে জাতীয় পার্টি, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগকে সন্তুষ্ট করত চেয়েছে কমিশন সে ভাষায় কথা বলে কোনো সুষ্ঠু পথ পাওয়া যাবে না।
বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী: কলামিস্ট এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন