দীপ আজাদ
জেনারেল মঈনের দিল্লি সফর ও সাংবাদিকের নোটবুক
কাঁটায় কাঁটায় দিনক্ষণ মনে নেই। সম্ভবত ২০০৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের তৎকালীন সেনা প্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ ভারতের সেনা প্রধান জেনারেল দীপক কাপুরের আমন্ত্রণে ছয় দিনের ভারত সফরে যাবেন। জেনারেল মঈন ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে দিয়েছেন। আমার বার্তা প্রধান জরুরি তলব করে নির্দেশ দিলেন, পরবর্তী ফ্লাইটে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে। জেনারেল মঈনের সফর কাভার করতে হবে।
বাংলাদেশ থেকে একমাত্র সাংবাদিক হিসেবে জেনারেল মঈন ইউ আহমেদের নয়াদিল্লি সফরের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়েছিলাম আমি। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর্দার আড়ালে মূল ব্যক্তির এ সফরের সংবাদ সংগ্রহ করার আগ্রহ যথেষ্ট ছিল। ফলে সব আয়োজন দ্রুতই হলো।
যতদূর মনে পড়ে ওই দিনই বিকেলের দিকে ফ্লাইট ছিল। সিনিয়র ক্যামেরাপারসন ফজলু ভাইকে নিয়ে যাত্রা শুরু। যখন কলকাতাতে পৌঁছালাম জেনারেল মঈন দিল্লি ততক্ষণে পৌঁছে গেছেন। বিপত্তি বাধলো কলকাতা থেকে দিল্লি যাবার পথে। ঢাকা থেকে কলকাতা ফ্লাইট বিলম্ব ছিল। ট্রানজিট কাউন্টারে গিয়ে মাথায় বাজ পড়লো। এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তারা জানালেন, উড়োজাহাজের দরোজা বন্ধ হয়ে গেছে, এখন আর যাওয়া যাবে না। তাহলে? কাল প্রথম ফ্লাইটে আমাদের দিল্লি যেতে হবে।
মিথ্যার আশ্রয় নেয়া ছাড়া পথ ছিল না। তাদেরকে জানালাম, উই আর স্টেট গেস্ট, সুতরাং আমরা সময়মত না পৌঁছালে সমস্যা হয়ে যাবে। পেছনের পকেট থেকে চার ভাঁজ করা বিমানের টিকেটটা বের করে বললাম, আমরা যে স্টেট গেস্ট এই যে আমাদের পেপারস, চাইলে দেখতে পারো। আমাদের সেনা প্রধানের নিউজ কাভার করা না গেলে দুই দেশের সম্পর্কে ভাটা পড়বে। ইত্যাদি ইত্যাদি নানা কিছু বানিয়ে বললাম হড়হড় করে।
কাজ হলো। দ্রুত এয়ারলাইন্স কর্মকর্তারা নড়াচড়া শুরু করলেন। ওয়াকিটকিতে কয়েকবার কথা বলে বললেন, জাস্ট রান। রানওয়েতে প্রায় দৌড়ে বিমানে উঠলাম। বিমানে ওঠার পর দেখি সবার চোখ আমাদের দিকে। গেট বন্ধ হয়ে যাবার পর উড়াল দেয়ার অবস্থায় বিমান থামিয়ে এরা কারা উঠলেন? সবার চোখে তখন এমন প্রশ্ন। কেবিন ক্রুদের কাছ থেকে বাড়তি খাতিরও পাওয়া গেল।
প্রায় মধ্যরাতে নয়াদিল্লির পাহাড়গঞ্জে এক হোটেলে রাত্রিযাপনের সুযোগ হলো। অবশ্যই সুযোগ সুবিধা মোটেই মান সম্মত নয়। কিন্তু মাথায় তো একটাই চিন্তা জেনারেল মঈনের সফরের সংবাদ সংগ্রহ। সকালে প্রথমেই গেলাম নয়াদিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনে। সেনা প্রধানের সফর নিয়ে খুব একটা জানেন না হাইকমিশনের কর্মকর্তারা। কখন কি কর্মসূচি আছে সেটাও বলতে পারলেন না।
হাইকমিশনে কিছু হবে না, এটা বুঝে দ্রুত কেটে পড়লাম। পেশা সূত্রে নয়া দিল্লিতে পূর্ব পরিচিত সাংবাদিকদের শরণাপন্ন হলাম। সেনা প্রধানের সফরের সংবাদ বলার মত কিছু সংগ্রহ করতে পারিনি। তবে রাইসিনা হিল (ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন) ও সাউথ ব্লকে (ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) স্থানীয় যে সাংবাদিকদের যাতায়াত আছে তাদের সাথে কথা বলে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেল। কিন্তু তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করার মত পরিবেশ তখন ছিল না।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার মুক্তি ও যথা সম্ভব দ্রুত নির্বাচন দেয়ার ব্যাপারে ভারতীয় পক্ষ জোর দিয়েছিলেন বলে জেনেছিলাম দিল্লি থাকতেই। বিশেষ করে শেখ হাসিনার বিষয়ে ভারতের সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির অবস্থানের বিষয়ে সবাই জানেন। ওই সফরে জেনারেল মঈনকে প্রণব মুখার্জি কি বলেছিলেন জানা গেল প্রায় ৯ বছর পরে। তার সম্প্রতি প্রকাশিত, ‘দ্যা কোয়ালিশন ইয়ারস ১৯৯৬-২০১২’ বইয়ে।
নয়া দিল্লির সাংবাদিকরা জানান, বাংলাদেশের সেনা প্রধানকে ডেকে আনা হয়েছে। আনার উদ্দেশ্যই হচ্ছে শেখ হাসিনার মুক্তি ও দ্রুত নির্বাচন দেয়ার তাগিদ দেয়া। তবে জেনারেল মঈনকে দিল্লি সফরে ৬টি ঘোড়া উপহার দেওয়া নিয়ে বেশ কিছু গল্প তারা বানিয়েছিলেন সে সময়। জুনিয়র হিসেবে সেগুলো গেলা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।
দীর্ঘ দিন থাকার পরিকল্পনা নিয়ে আসা সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু’বছরের মধ্যে নির্বাচন দেয়ার পেছনে জেনারেল মঈনের দিল্লি সফর অনেক বড়ো কাজ করেছে। ৯ বছর পরে সেই অজানা কথা জানা গেল প্রণব মুখার্জির বইয়ে। যদিও তখন অনেকের মুখে মুখে কিছুটা শুনেছিলাম। সেই শোনা কথাগুলো যে আদতেই সত্য তা জানালেন তিনি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিক নঈম নিজাম ভাইয়ের এক লেখায় আরো কিছু জানা গেল। তার সাথে প্রণব মুখার্জির ব্যক্তিগত সখ্য অনেক আগে থেকেই। ভবিষ্যতে তিনি লিখলেও অনেক অজানা কথা জানা যাবে। বাংলাদেশ জন্মের পর থেকে উথাল পাতাল সময়ের যারা সাক্ষী তারা লিখলে মানুষ অনেক কিছুই জানতে পারবেন।
আবার জেনারেল মঈনের দিল্লি সফরে ফিরে যাই। সংবাদ সংগ্রহে দিল্লিতে সুবিধা করতে না পারলেও কলকাতায় তাকে ধরার চেষ্টা করলাম। সফরের শেষ দিকে শান্তিনিকেতনে তার কর্মসূচি ছিল। কাকডাকা ভোরে ট্রেনে চেপে কলকাতা থেকে শান্তি নিকেতন পৌঁছালাম।
বাণিজ্যিক ক্যামেরা শান্তিনিকেতনে প্রবেশের বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিল। জেনারেল মঈনের একটা কর্মসূচিও যদি সরাসরি কাভার করতে না পারি তা হলে সবটাই বৃথা। একই ফমুর্লা কাজে লাগালাম। শান্তি নিকেতনের উচ্চ পদস্থদের প্রায় ঘণ্টাখানেক চেষ্টা করে মন গলালাম। অবশ্য সহকর্মী ক্যামেরাপারসন ফজলু ভাইয়ের ভূমিকা এক্ষেত্রে কম নয়।
শান্তিনিকেতন ঘোরা শেষে জেনারেলের মুখোমুখি হবার সুযোগ হলো। নিজের পরিচয় দিয়ে জানালাম যে বাংলাদেশ থেকে আমি একাই এসেছি তার সফর কাভার করতে। গত কয়েকদিন ধরে দিল্লিও কাভার করেছি। ছোট হাসি দিয়ে বললেন, ও তাই নাকি। ওটুকুই ছয়দিনের সফরে জেনারেলের কাছ থেকে আমার প্রাপ্তি।
সংবাদটি সময়মত পাঠাতে বর্ধমানের দুই সাংবাদিক বন্ধু অনেক সহযোগিতা করেছেন। কলকাতাতে ফিরে ওইদিন নিউজ পাঠালে তা সম্প্রচার হতো না। পরে আর তাদের কৃতজ্ঞতা জানানো হয়নি। দিল্লি সফরে সংবাদ সংগ্রহ খুব একটা করতে না পারলেও ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতির নতুন বইয়ের তথ্য জেনে ভালোই লাগলো। এক এগারোর আরো অনেক অজানা তথ্য অদূর ভবিষ্যতে প্রকাশিত হবে এমন প্রত্যাশা অনেকের।
দীপ আজাদ: সাংবাদিক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন