আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করতে আওয়ামী লীগ যে নিদের্শনা দেবে সে অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন (ইসি) কাজ করবে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা। চলমান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে বসে সূচনা বক্তব্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার একথা বলেন। খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এমন বক্তব্যই একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বড় বাধা। এমনকি তার বক্তব্য সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
কারণ সংবিধানে নির্বাচন কমিশনের করনীয় সম্পর্কে বলা হয়েছে। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের ৪ ধারা অনুযায়ী বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্বপালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হবেন।’ তাহলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কিভাবে বলেন নির্বাচন কমিশন সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করবে। একটি সাংবধিানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়ে তিনি কিভাবে এমন বক্তব্য দিলেন। তার এই বক্তব্যের পর তার তার নেতৃত্বাধীন কমিশনের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর কথা না হ্য় বাদ দিলাম জনগণ আস্থা রাখতে পারেকি! এই কদিনে সিইসি এত রূপ দেখালে তো মুশকিল।
সিইসিকে আচার আচরণে স্বচ্ছ হতে হবে। কিন্তু তার জন্য বহুরূপী হবার কোন প্রয়োজন নেই। সেটা অবশ্যই হিতে বিপরীত হবে। দুটো বড় দলই ভালো। তাদের সব কর্মকাণ্ড ভালো। এসব বলা সিইসির কাজ নয়। নিয়োগের পর জনতার মঞ্চের লোক হিসেবে অভিযোগ করে কেএম নুরুল হুদার সমালোচনায় মুখর ছিলো বিএনপি। সম্প্রতি বিএনপির সঙ্গে সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য শুনে বিএনপি কিছুটা আশাবাদী হয়েছিলেন যা বৈঠকের পর সাংবাদিকের কাছে বলেছিলেন দলটির মহাসচিব।
বুধবার আওয়ামী লীগের সাথে সংলাপে সিইসির এই বক্তব্যের পর মির্জা ফখরুলদের সে আশার বেলুন চুপসে গেছে সন্দেহ নেই। সেদিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, জিয়াউর রহমান এ দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ারও প্রশংসা করেন সিইসি। বলেন, ১৯৯১ সালে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর ২০০১ সালে তার নেতৃত্বে আবারো সরকার গঠিত হয়। বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে প্রকৃত নতুন ধারার প্রবর্তন করেছে।
জিয়া যে বহুদলীয় গণতন্ত্র দেশে এনেছিলেন। এবং তার কল্যাণে বিলুপ্ত আওয়ামী লীগ নতুন জীবন পেয়েছিলো। এসবই ইতিহাসের সত্য। জনতার মঞ্চের কুমিল্লার আহবায়ক কে এম নুরুল হুদা না বললেও ইতিহাসের এই সত্য কেউ মুছে ফেলতে পারবে না। তবে আমি ভাবছি। ওবায়দুল কাদেরের কথা। একজন পোড় খাওয়া রাজনীতিক কিভাবে এটাকে সরলীকরণ করে বললেন, সিইসির এমন প্রশংসা শুধু বিএনপিকে আস্থায় আনার কৌশল! তাহলে আওয়ামী লীগের সাথে বৈঠকে সিইসি যে কথা বললেন এরপর কি সেই কৌশল কোন কাজে দেবে কি?
সিইসি দলের প্রতিষ্ঠাতাকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা বললেই, বিএনপির নেতারা গদগদ হয়ে, একটি অসমাঞ্জস্য রাজনৈতিক পরিবেশে নির্বাচনে যাবে? ওবায়দুল কাদের যদি এমনটা ভেবে থাকেন তবে সেটা হবে তার ভুল ভাবনা। মুখের কথায় চিড়ে কেন ইদানিং সত্তর টাকা দরে কেজির মোটা চালও ভেজে না!
সুতরাং এসব কৌশল, টৌশল দিয়ে শেষতক কোন কাজে আসবে না। যদি দৃশ্যমান নির্বাচনী পরিবেশ দেশে তৈরী না হয়! কারণ বাংলাদেশের মানুষ, খায় না খায় ভোটটা দিতে বড়ই উৎসাহি। সেটা দুইবার বঞ্চিত করা মনে হয় অত সহজ হবে না কারো জন্যই। নির্বাচন কমিশন এ বিষয়টা যত দ্রুত উপলব্ধি করতে পারবে ততই তাদের জন্য মঙ্গল হবে।
আর এ নিয়ে বিএনপির উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। নির্বাচন কমিশন কার কোন্ অবদানের প্রশংসা করলো তা না দেখে বিএনপির বরং উচিত হবে নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডের দিকে মনোযোগ রাখা। বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতির প্রতি যারা নজর রাখেন তারা নিশ্চই আমার সাথে একমত হবেন যে, গত দশ বছরে দেশের রাজনীতির বহু ইস্যুতে বিএনপি ক্ষণিকের জন্য আনন্দিত হয়েছিলো। কিন্তু পরে তাদের সে আনন্দ মিইয়ে যেতে কিন্তু সময় লাগেনি।
দুই.
রোহিঙ্গা সমস্যাটা দিনে দিনে আমাদের কাছে গলার কাঁটার মতো হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রভাব ফেলছে আমাদের সামাজিক অর্থনীতিতেও। বাইরের সাহায্য দিয়ে এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের দিনের পর দিন খাওয়ানো বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। আর সব সময় বিদেশী ত্রাণ আসবে তারও কোন গ্যারান্টি নেই। ইতিমধ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলে দিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের কারণে আমাদের বাজেটের বিভিন্ন খাতে নানা পরিবর্তন আনতে হচ্ছে।
আয়তনে একটি ছোট দেশের জন্য এত বিপুল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি আসলে নানা সমস্যার সৃষ্টি করবে সন্দেহ নেই। কিন্তু এদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে যেরকম শক্তিশালী কূটনীতি দরকার, সরকার থেকে তেমনটি চালানোর কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ আমাদের চোখে পড়ছে না। উল্টো আমরা যেন মিয়ানমারের সাথে মাখামাখিতে বড় বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। ইউরোপিয় ইউনিয়ন মায়ানমারের সাথে তাদের সকল সামরিক চুক্তি ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছে।
বিশ্বব্যাংক সাহায্য স্থগিত করেছে। মগের মুল্লুকের মতন তাদের দেশের জনগণকে আমাদের দেশে ঠেলে দিয়ে একটি দুঃসহ পরিবেশ তৈরী করেছে। এখনো ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে মানুষ। যেখানে তাদের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক যোগাযোগের পাশাপাশি সামরিক শক্তিমত্বা প্রদর্শনের কথা। সেখানে আমরা যেন মায়ানমারকে ঘনিষ্ট প্রতিবেশীর মত, তাদের খাতির করছি। আর আমাদের এরকম আশকারা পেয়ে প্রতিদিনই তারা ঝাঁকে ঝাঁকে তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠাচ্ছে।
অথচ সু চির মন্ত্রী কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সফরে এলে আমরা আশাবাদী হয়েছিলাম। সফরে এসে ফেরত নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর এমনটা হবার কথা ছিল না। তবুও আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধানের নীতিতে আছি। যুদ্ধ না হয়, নাই করলাম, একটি কড়া সতর্কবার্তা কি আমরা দিতে পারি না। তাহলে আমাদের সেনাবাহিনীর সক্ষমতা কি গালভরা বুলি? তাহলে সাবমেরিন, মিগ এসব যুদ্ধাস্ত্র কিসের জন্য? এগুলো কি শুধুমাত্র জাতীয় দিবসে প্রদর্শনীর জন্য!
বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় দুটো বিষয় খুব বেশী বার্গেনিংয়ের ক্ষেত্রে কাজে দিচ্ছে, এক অর্থনৈতিক সক্ষমতা অন্যটি সামরিক সক্ষমতা। আমাদের কোনটি আছে! শাসকদলের কথায় দুটোই আছে। তবে আমজনতা মনে করে কোনটাই নেই। সব ফাঁকা বুলি। মায়ানমার ফ্যাক্ট সেটাই প্রমাণ করলো! এদিকে আবার, আসেম সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মায়ানমার যাচ্ছেন ১৯ নভেম্বর। আর ২৩ অক্টোবর যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পররাষ্ট্রমন্ত্রীও যাবেন বলে শুনেছি। আমরা বিদেশ সফরে ক্লান্ত নই। অথচ এতবড়
ক্রাইসিসে আমরা যেসব দেশে গেলে এই সমস্যার সমাধান হলেও হতে পারে, যেসব দেশের হাতে জান্তা সরকারের জীয়নকাঠি সেই চীন, ভারত, রাশিয়া সেসব দেশে কোন ইনভয় পাঠানোর কোন লক্ষণ দেখছি না। অথচ যে দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কটা বাতিল করা উচিৎ, সেখানে আমরা দিনে দিনে বাড়াচ্ছি।
রোহিঙ্গারা না কি বাংলাদেশ সরকারের জন্য আশীর্বাদ, দুদিন আগে কথাটি বলেছিলেন আহমদ নামের একজন আওয়ামী লীগের পদবীধারী নেতা। ওরা না এলে আমাদের নেত্রী যে কত মানবতাবাদী সেটা বিশ্ব জানতো না। আমরা যে মানবতাবাদি সেটা ইতিমধ্যে বিশ্ব ভালোভাবে জেনে গেছে। এখন সময় দেশের স্বার্থে কঠোর হওয়া। না হলে বিহারীদের জেনেভা ক্যাম্পের মতো আরেকটা বড় ক্যাম্প বাংলাদেশের বিধিলিপি হয়ে দাঁড়াবে। যার জের পোহাতে হবে বছরের পর বছর।
মুজতবা খন্দকার: সাংবাদিক, কলামিস্ট।
mujtobantv@gmail.com.
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন