তুমি চলে গেছ প্রায় ৬ বছর হতে চলল । কিন্তু এখনো প্রিয়জনদের সাথে আড্ডায়, কাজের ফাঁকে তোমায় স্মরণ করি,কি করবো দীর্ঘ সময়ের অভ্যাস। জানি, সবাইকেই একদিন মায়া আর মোহ মুক্ত হয়ে চলে যেতে হবে কিন্তু তোমার প্রস্থানটা যেন সময়ের বড্ড বেশী আগে । এমন হাসি-খুশী, প্রাণবন্ত একটা মানুষের এতো দ্রুত চলে যাওয়া মেনে নিতে কষ্ট হয় সবার।তোমার মৃত্যুর পর জীবন সম্বন্ধে আমার অন্য এক উপলব্ধি, জেনেছি জীবন বড় বেশী মূল্যবান, বুঝেছি বেঁচে থাকা কাকে বলে। কত শত প্রশ্ন প্রতিনিয়ত মনের মাঝে উঁকি দেয়, মাঝে মাঝে দোল খেয়ে খেয়ে পিছলে পরে । এতো কাছ থেকে প্রিয় মানুষটির মৃত্যু যন্ত্রণা আমার ভাবনার পুরো জগতটাকে পাল্টে দিয়েছে।
মাঝে মাঝে ভাবি, এই কষ্টটুকু হয়তো আমার প্রাপ্য ছিল। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের অভিজ্ঞতা একরকম হবে এমন কোন বাঁধা ধরা নিয়ম নেই। আবার প্রতিটি মানুষের সহনশীলতা, ধারণ ক্ষমতা এবং পারসেপশনও ভিন্ন ভিন্ন। সেই শিশুকাল থেকে আমি সৃষ্টিকর্তার কর্মের উপর আস্থাশীল একজন মানুষ। আমি বিশ্বাস করি তাঁর সমস্ত হিসাব কোন না কোন উদ্দেশ্যে । আমার এই ভাগ্য তাঁরই ইচ্ছায় যদিও অন্তর্নিহিত কারণ আজও অজানাই রয়ে গেছে।তোমার চলে যাওয়া আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেও । মাঝে মাঝে সন্দেহ জাগে ভাল মানুষের ভিড়ে তোমার চারিপাশে মুখোশ আটা এতো নিকৃষ্ট কিছু মানুষের উপস্থিতি তুমিও কি টের পেয়েছিলে কোনদিন ? তাঁদের কর্ম-কাণ্ড, স্বার্থপরতা তোমায়ও কি আহত করতো ?
তোমার বেদনা বিধুর মুখখানি ইদানীং বেশী মনে পরে।
না কোনদিন মুখ ফুটে বলতে না, '' তোমার অসহায়ত্ব, তোমার হতাশার কথা ''। আর কি ভাবেই বা বলবে আমাকে, শুরু থেকেই সবাইকে ভাল ভাল বলে বলে আমার ধারণা তো তুমি নিজেই সৃষ্টি করেছিলে। হয়তো লজ্জা গ্লানি আর অপারগতায় সেই ধারণা তুমি ভাঙতে চাওনি কোনদিন। মাঝে মাঝে তোমার যন্ত্রণা দগ্ধ মলিন মুখখানি দেখে ভাবতাম হয়তো শরীরের কোন অসুখ আমায় গোপন করছ। কিন্তু ভুলেও ভাবিনি তোমার চারিপাশের যাদের তুমি একান্ত আপন ভেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছ, যাদের পেছনে দিনের পর দিন নিজেকে ভুলে শ্রম দিয়েছ তাঁদেরই কারো কারো বিষাক্ত নিঃশ্বাস তোমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।
তোমার মৃত্যুর পর সেই বিষাক্ত ছোবল, নোংরা-স্বার্থান্বেষী চেহারা এখন আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে। তোমাকে স্মরণ না করে আসলে আমার উপায় নেই, যত বেশী কষ্ট-সংগ্রাম ততো বেশী তোমায় মনে পড়া।মাঝে মাঝে তোমাকেও আমার স্বার্থপর মনে হয়, এমন নোংরা মানুষদের সম্বন্ধে আমায় জানিয়ে গেলে কি হত ! আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে সাবধানী হতে পারতাম, মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করতাম । কিন্তু কারো সম্বন্ধে নেগেটিভ কিছু বলা, কাউকে ছোট করা তোমার চরিত্রের মধ্যেই ছিল না। কিংবা হতে পারে সবাইকেই তোমার মত বিশ্বাসী মনে করতে, ভালো ভাবতে, নিঃস্বার্থ ভাবে অনেক ভালোও বাসতে জানতে।
ইদানীং বড্ড ক্লান্ত লাগে, এতো লড়াই আর ভাল লাগে না আমার। মানুষের নোংরা চেহারা দেখতে দেখতে জীবনের প্রতিই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পরি মাঝে মাঝে। শুনেছি তুলা রাশির জাতক-জাতিকারা নাকি চির সৌন্দর্য পিয়াসী হয়, আমিও তো তাই ছিলাম। চিরকাল ধরেই আমার অসুন্দরকে ভয় এবং এড়িয়ে চলা। কিন্তু ভাগ্যের লিখন সমস্ত কুৎসিত-কদাকার চেহারা গুলো আমার সামনে এসেই হাজির হল। এমন অবস্থায় না পরলে জানতেও পারতাম না একা নারীকে কতোখানি অসহায় বিপন্ন বোধ করতে হতে পারে, প্রতিটি পদ শ্বাপদ সঙ্কুল, হিংস্র পশুরুপী মানুষের স্বার্থের নখর।
অনেকের মনেই প্রশ্ন, অন্যায় আর মিথ্যার বিরুদ্ধে লড়াই করার এতো সাহস আমি পাই কোথা থেকে। আমি কি করে বুঝাই তাঁদের, প্রতিমুহূর্তে ন্যায় আর অন্যায়ের দ্বন্দ্ব, হিংসা,লোভ আর স্বার্থহীনতাই আমায় সাহসী করে, আত্মবিশ্বাস যোগায় । মাঝে মাঝে বড় জানতে ইচ্ছে করে ওপারেতে বসে তুমি কি আমায় দেখতে পাচ্ছ ? হাসছো, রাগান্বিত হচ্ছ, মজা করছো ? আবারও ভাবি এখন তোমার সময় কোথায়, হয়তো ওপারের রহস্যময় জগতে অপার আনন্দে তুমি মত্ত !
ধ্রুব বলে আমি নাকি তোমার লাইফ ইনস্যুরেন্স, শ্রেয়াও ওর সাথে যোগ দেয়, আমার বিপন্নতা, অস্থিরতা নিয়ে মজা করে। ওদের যুক্তি হচ্ছে,'' এমন বউ পেলে, বাচ্চা-কাচ্চা দেখভাল, তাঁদের পড়াশুনা, মানুষ করা, কোন কিছুতেই কারো কোন চিন্তা থাকে না '' । ইদানীং মাঝে মধ্যে আমিও ওদের কথায় প্রভাবিত হই, ভাবি, '' সত্যি সত্যিই কি আমি কেবল তোমার ইনস্যুরেন্সই ছিলাম'' ?
অনেকে বিস্মিত হয় একা একা এতো প্রাণ প্রাচুর্য কি করে পাই ! মনের শুদ্ধতা আমার জীবনী শক্তি অক্সিজেনের মত করে চালিত করে সাহস যোগায়, প্রতিনিয়ত নতুন করে বাঁচতে শেখায়। আশে পাশের মানুষকে নিয়েই আমার সুখ, স্বপ্নের ডালি সাঁজাই । ছেলেটা দূরে কিন্তু এই মুহূর্তে শয্যা শায়িত আমার মা' আর মেয়ে, আমার বাসার আজিজ, শাহানা, লাইলি, ড্রাইভার জামাল, সজিব, দারোয়ান কাসেম, আজিজ কে ঘিরেই আমার সব আনন্দ পল্লবিত। আমার অফিসের সন্তান তুল্য আমার অফিসাররা মায়ের মত আমায় সম্মান ও শ্রদ্ধা করে এতো পাওয়া রাখি কোথায় ! আমার অসুস্থ মায়ের প্রতিটি শ্বাসে আমার জন্য দোয়া নিঃসৃত হয় এটাও তো অনেক পাওয়া।
তাঁর পরেও যদি মন খারাপ করি আল্লাহ্কে দোষারোপ করে বিষাদগার করি একান্ত মিথ্যাচার এবং অকৃতজ্ঞতা হবে বলেই মনে করি।
এতক্ষণ তো শুধু আমার কথাই বললাম, তুমি কেমন আছো ? ওপারেতেও কি আড্ডা হয়, তোমায় ঘিরে ভক্তরা মন্ত্রে মুগ্ধের মত বসে থাকে আর স্তুতি বাক্য ছুঁড়ে ছুঁড়ে তোমায় ঘায়েল করে ? ভক্ত আর চাটুকারদের আলাদা করতে পারনি কোন কালেও। এদের ভিড়ে আমার দিকে তাকানোর ফুরসৎই মিলত না তোমার। রাগে-ক্ষোভে-অভিমানে নীরবে ফোঁস-ফাঁস, কখনোবা বৃথাই অশ্রু বিসর্জন। জীবন তো এমনই হয়, '' কখনো টক, কখনো ঝাল, কখনোবা মিষ্টি'' ! না আজ লিখতে পাড়ছি না, যত চেষ্টা করছি, না বলা শত কথা শত অভিমান এসে আছড়ে পরতে চাইছে।
১৯৬৩ র ১০ই নভেম্বরের রাতের আকাশে কি মেঘ ছিল ! না হয় তোমার জীবনটা অসময়ে এমন বিষাদে ঢেকে গেল কেন ! হতে পারে আমার বুঝার ভুল, হয়তো তুমি ওপারেতেই বেশী ভাল আছো। বেঁচে থাকলে তোমার বয়স হত ৫৪ কিন্তু তোমার বয়স তো ৪৮এ এসেই থেমে গেছে। হতে পারে আমি একদিন থুথুরী বুড়ি কিন্তু তুমি তখনও তারুণ্যে ভরপুর যুবকই রয়ে যাবে।আজ খোলা আকাশ পানে তোমায় শুভেচ্ছা, '' যেখানেই থাকো, ভালো থেকো তুমি, জীবনের সুখের মুহূর্তগুলোর মত আনন্দে থেকো ''।
খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি)
purboposhchim
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন