টুডে ডেস্ক
আজকে ইত্তেফাকে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে মোটামুটি বুঝা যায় সরকারের গোয়েন্দা বাহিনীর তত্ত্বাবধানেই মূলত দেশী বিদেশী বাহিনী শিক্ষক মুবাশ্বির হাসানকে গুম করে ফেলেছে। ওদিকে ভাইকে নিয়ে মুবাশ্বিরের বোন তামান্না তাসনিম নানা স্মৃতিচারণ করে ফেসবুক লিখেছেন। তামান্নার স্ট্যাটাসটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো ---------
ছোটবেলা থেকে আব্বুর সাথে এক ধরণের চাপা অভিমানের সম্পর্ক আমার। কারণ আমাদের ২ ভাই বোনের মধ্যে, ভাইয়ার দিকে টান মারাত্মক রকম বেশি আব্বুর। আমি রাগ করে অনেকবার বলেছি "ভাইয়াই তো তোমার সব, আমি তো ঢেউটিন"! ছোটবেলা থেকে মারাত্মক দুরন্ত আমার এই ভাইয়াকে সবচেয়ে বেশি শাসন করেছে আব্বু আবার এই ভাইয়া বলতেই আব্বু মোটামুটি অন্ধ। ভাইয়া যদি বলে আজকে সূর্য পশ্চিমদিকে উঠেছে, আব্বু টেবিল চাপড়ে বলবে "অবশ্যই সূর্য আজকে পশ্চিমদিকে উঠেছে"। আব্বু কিছুটা বদমেজাজি ধরণের। একমাত্র ভাইয়ারই পারে থাকে কোনো কথা বুঝতে বা ঠান্ডা করতে। বাপ-বেটার এমন কেমিস্ট্রি দেখে আমি র আম্মু সবসময় হাসতাম। সেই বাবার ছেলেটার আজকে ৩ দিন ধরে কোনো খোঁজ নাই। ষাটোর্ধো সেই বাবার কি অবস্থা হতে পারে সেটা কি কেউ কল্পনা করতে পারেন আপনারা?
বাইরে ও একজন একাডেমিক, রিসার্চার, জার্নালিস্ট বা কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট হতে পারে, বাসায় সে শুধুই সিজার। ঘরে ঢুকে জুতা একদিকে, মোজা আরেকদিকে, ব্যাগ সোফায়, বেল্ট মেঝেতে রেখে ঘরে ঢুকে যাবে। আম্মু খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবে যে "তুমি খাওয়ায় খাওয়ায় আমাকে আরো মোটা বানাচ্ছ, আমি খাবো না"। ঠিক ১০ মিনিটের মাথায় ঘুরেফিরে এসে বলবে "আম্মু কি খাবো?"। হটাৎ হটাৎ ওর মাথায় ডায়েটিংয়ের ভূত ঢুকে। তখনও আম্মু খাওয়ার কথা বললে বলে যে "দেখতেসো না আমি ডায়েট কন্ট্রোল করতেসি?" । কিন্তু আবার দেখা যাবে কিছুক্ষন পর খাওয়া খুজতেসে। ছুটির দিনগুলিতে বাসায় থাকলে খামাখাই চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করবে। হটাৎ করে একটা হাক দিবে বিরাট করে " আব্বাআআআআআ" । আব্বু তাড়াহুড়া করে দৌড়ে আসলে সুন্দর করে একটা হাসি দিবে । আম্মুর সাথেও একই কাজ করবে আর আম্মু কিল মারার জন্যে হাত তুল্লে হেসে দিবে।
আমি হচ্ছি ওর গিনিপিগ। সবকিছু আমাকে দিয়ে টেস্ট করতে হবে। ছোটবেলা থেকে ওর কোনো গান বা মুভি ভালো লাগলে সেটা আমাকেও দেখতে হবে। কিছুদিন আগে নেটফ্লিক্স কিনেছে ও। সেখানে আমি জানার আগেই আমার জন্যে প্রোফাইল আছে। ওর মেট্রিকের রেসাল্টের প্রাইজ ছিল বাইসাইকেল। সেটাতেও আমাকে নিয়ে উঠতে হবে। আমি ব্যালান্স রাখতে না পেরে পাথুরে মাঠে পরে গিয়ে হাঠু বাজেভাবে ছিলে ফেলেছিলাম। কলোনির বাসার লম্বা করিডোরে আমরা ক্রিকেট খেলতাম আর বিছানায় রেসলিং করতাম। যে খাট থেকে পরে যাবে সে হারবে। আমি সবসময় জিততাম। কারণ আমি পরে গেলে তো ব্যাথা পাবো! অনেকআগে আমার এক কাজিন ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করেছিল "তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে?" ভাইয়া আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিলো। ভাইয়ার খুব ইচ্ছা ছিল আমি আই বি এ তে পরব কিন্তু আমি জানতাম আমাকে দিয়ে হবেনা সেটা। তবুও শুধু ওর মন রাখার জন্যে এডমিশন টেস্ট দিয়েছিলাম। "ঘ" ইউনিটের পরীক্ষা দিয়েও আমার মনে হয়েছিল যে আমার চান্স পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। ভাইয়া তখন UK তে। রেসাল্টের দিন ভোর ৪টায় ফোন দিয়ে বলে যে "এই তুমি তো চান্স পাইস"। ওর সাথে মতভেদ আমার চরম ছিল। কিন্তু কোনো ব্যাপারে কনফিউসড থাকলে ওর কাছেই যাই আমি। বিশেষ করে আমার প্রফেশনাল লাইফের বেশিরভাগ ডিসিশনই ওর সাথে কনসাল্ট করে নেয়া। কখনো কোনো কিছু হলে মাথায় সবার আগে আসতো, ভাইয়া ম্যানেজ করে ফেলবে। ওর অনুপস্থিতিতে এখন নিজেকে কেমন যেন ডিফেন্সলেস মনে হচ্ছে।
যে মানুষটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে খুঁতখুঁত করতো, খাওয়া নিয়ে বিলাসিতা করতো, সে কোথায় আছে, কেমন আছে আমরা জানি না। কিছু মুখে দিতে গেলে মনে হয় আমার ভাই টা কি খাচ্ছে, নরম বিছানায় শুতে গেলে মনে হয় ও কি আদৌ ঘুমাতে পারছে। আব্বু আম্মু চুপচাপ একটু পর পর একেকটা রুম ঘুরে বেড়ায়। তাদের কোনো লজিক কাজ করে না। কারণ ছাড়াই একটু পরপর রেগে যান। যে মানুষ ২টা এতগুলা বছর দাপটের সাথে সরকাররের উচ্চ পদে কর্মরত ছিলেন, তারা এখন একেবারেই হতাশ।
একটা পরিবারের প্রত্যেকটা সদস্য একটা পিলারের মতো। আমাদের এখন একটা খুঁটি নাই। সবচেয়ে মজবুত খুঁটিটাই নাই। যে খুঁটিটা বাসাটাকে হাসিখুশি রাখতো সেই খুঁটিটাই নাই। এই খুঁটিটাকে যে খুব দরকার আমাদের। আব্বু আম্মু সবাই ওকেই বেশি আদর করুক, আমার কিচ্ছু লাগবে না, শুধু ও সুস্থভাবে বাসায় আসুক। যেভাবেই হোক আমার ভাইটা বাসায় আসুক। আমার বাবার একমাত্র সম্বল, আমার মায়ের বুকের ধন ফেরত আসুক আমি এই জীবনে আর কিছু চাইব না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন