সৌমিত্র শেখর
রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে নেভা নদী। নেভার পাড়ে লেখক।
তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার সেন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায় হঠাৎ যেন অগ্নিকুণ্ডের আলো ও উত্তাপ পেলাম। থমকে দাঁড়িয়ে দেখি গ্রন্থহৃদয় ঝুলছে। এমনটি আগে কোথাও, কখনো দেখিনি। তরুণ-তরুণীদের কাছে ‘হার্ট’-এর প্রতীক বেশ আকর্ষণীয় নিশ্চয়। কত কিছু দিয়েই-না এটি করা যায়, আঁকা যায়। এমনকি ক্ষুদ্রতরের চিহ্ন (<) আর ৩ পাশাপাশি বসালেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে হৃদয় তৈরি হয় ফোনে বা কম্পিউটারে। কিন্তু আমি দেখলাম একটি দোকানে গোটা গোটা সব বই দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিরাট গ্রন্থহৃদয় বা বুকহার্ট। দোকানের নাম: ‘ভুক্বন’, বাংলায় ‘অক্ষর’। পাশেই রুশ ভাষায় যা লেখা রয়েছে তার বাংলা মানে—‘শরৎকাল পড়ার জন্য’। চার ঋতুর রাশিয়ায় আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর হলো শরৎকাল। তখন শরৎ চলছিল।
পড়ুয়া ও ভদ্রজাতি হিসেবে জগৎজুড়ে রুশদের সুনাম আছে। চেকভ, তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি, গোর্কি, পুশকিন, তুর্গেনিভ, বরিস পেত্রারনাক, মিখাইল বাখতিন আরও কত নাম! রাশিয়ানরা বিশ্বাস করে, সম্পদ বা নেতার জন্য নয়, লেখকদের জন্য রাশিয়াকে পৃথিবী চেনে। তাই ‘ভালো পাঠক’ বলে গর্ব করে তারা। রাশিয়ার সমাজে একটি ‘মিথ’ প্রচলিত আছে এবং সেটি হলো, ‘পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পড়ুয়া রাশিয়াতে বাস করে’।
বইয়ে বুঁদ একজন যাত্রী
অক্টোবরের ১ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত রাশিয়ার দুটি প্রধান শহর মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গে ঘুরে আমার মনে হয়েছে, ‘সবচেয়ে বেশি’ নয়, ‘সবচেয়ে বেশিরও একটু বেশি’। দূরপাল্লার বাসে বা ট্রেনে কারও হাতে বই থাকতে পারে কিন্তু লোকাল বাসে দাঁড়িয়ে কেউ বই পড়ে? মেট্রোরেলে? রাশিয়ায় পড়ে। এমন একজন-দুজন নয়, শত শত। মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গের দূরত্ব ৭০০ কিলোমিটারের বেশি। দ্রুতগামী বুলেট ট্রেনে ঘণ্টা চারেক সময় লাগে। আমি বিকেল সাড়ে পাঁচটায় মস্কো থেকে ট্রেনে উঠলাম। কিছুক্ষণ পরই মনে হলো ট্রেনের কামরায় যাত্রীদের মধ্যে যেন ‘পড়া প্রতিযোগিতা’ শুরু হয়ে গেছে! যে যার মতো পড়ছে। কোনো হইহুল্লোড় নেই, নেই ফেরিওয়ালার হাঁকডাক। পাশের আসনে বসা যাত্রী সেভেৎলাভার সঙ্গে আলাপের শব্দও যেন আমারই কাছে বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছিল। কারণ, দীর্ঘ কথোপকথন বা উচ্চকণ্ঠে মুঠোফোনের আলাপ সেখানে নেই। দ্রুতগামী ট্রেনও বিমানের মতো সামান্য শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া কিছু করছে না। ট্রেনে যাত্রীদের হাতে কাগজের বই দেখেছি ঠিক, পত্রিকাও আছে। কিন্তু কারও কারও হাতে ট্যাব বা মোবাইল ফোনও। সন্দেহ হলো। প্রক্ষালনকক্ষে যাওয়ার ছুতোয় দুবার আসন থেকে উঠলাম। পরে আমি নিশ্চিত হয়েছি, মুঠোফোন বা ট্যাবেও বই বা পড়ার বিষয়েই তাদের মনোযোগ—ফেসবুক বা ইউটিউবে নয়। অনেকে অবশ্য ইয়ারফোন লাগিয়ে ট্রেনের টেলিভিশন বা অডিও গান শুনছিলেন। গান শুনে শুনে বই পড়ার দৃষ্টান্ত রাশিয়ার পথে পথে।
অন্য দিন, মস্কোর মেট্রোরেলে চড়ে যাচ্ছি ক্রেমলিনে, রুশ বিপ্লবের মহানায়ক ভ. ই. লেনিনের মমি দেখব বলে। মেট্রোরেলে এক যুবক ইয়ারফোন লাগিয়ে হাতে ঢাউস বই নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। ফেরার সময় হালকা বৃষ্টি। মেট্রোরেলে ছাতা গুটিয়ে নিয়ে দুই যুবতী বান্ধবী বই পড়ছিল আর আলাপ করছিল। অভ্যন্তরীণ বিমানে বয়স্ক থেকে শুরু করে তরুণদের প্রায় সবাই যেন বইয়ে বুঁদ! তরুণেরা হয়তো মুঠোফোনে বা ট্যাবে আর বয়স্করা আদি-অকৃত্রিম কাগজের বইয়ে।
আলোচনা যেন বই ঘিরে
২০০৮ সালে রাশিয়ায় বই নিয়ে জরিপ হয় এবং তাতে দেখা যায়, ৫৪ শতাংশ মানুষ নিষ্ঠার সঙ্গে বই পড়েন; ৪০ শতাংশ মানুষ নিয়মিত বই কেনেন; ৭০ শতাংশ পরিবারে ব্যক্তিগত পাঠাগার আছে। তবে এখন নাকি পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে বই সংগ্রহ করে পাঠ ও তারপর ফেরত দেওয়ার চিরায়ত চিত্রটি আর নেই, কমে গেছে। হতে পারে। ইন্টারনেটে বলে দিলেই বই যেখানে ঘরে চলে আসে বা ই-বুক মেলে হাতের ট্যাবে, কারণ এটি হতে পারে। তবে, পৃথিবীর বড় ও সেরা দশটি লাইব্রেরির দুটোর অবস্থান রাশিয়ায়। এর একটি মস্কোর ‘রাশিয়ান স্টেট লাইব্রেরি’ আর অন্যটি সেন্ট পিটার্সবার্গের ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব রাশিয়া’।
২০০৭ সালকে রাশিয়াতে ‘অধ্যয়নবর্ষ’ ঘোষণা করা হয়েছিল। সে বছর বই প্রকাশ-বিক্রি-পাঠ ছিল রেকর্ড পরিমাণে। রুশরা চায়, দুই বছরের মধ্যেই আবার ‘অধ্যয়নবর্ষ’ ঘোষিত হোক। প্রতি বারো বছরে একটি বছর তারা বইয়ের জন্য দিতে চায়। পড়াকে রুশরা জীবন থেকে আলাদা করে দেখে না। ভাবে না, পড়ার কোনো সময় আছে কিংবা পড়ার কোনো স্থান বা বয়স আছে। বরং তারা ভাবে, সব সময়ই পড়ার, পড়লেই হলো। তাই পার্কে বসেও তারা বই পড়ে, বাসে বসেও। এমনকি প্রক্ষালনগৃহেও বই রাখার ছোট তাক থাকে।
চলন্ত ট্রেনে দাঁড়িয়ে বই পড়া
আমরা কিছু বইকে ‘পাঠ্যবই’ নাম দিয়ে প্রকারান্তরে অন্য বইগুলোকে ‘অপাঠ্য বই’ বলি। রুশদের কাছে ‘পাঠ্যবই’ বলে আলাদা কিছু নেই, সব বই-ই পাঠ্য। যার যেটা ভালো লাগে, যতটুকু ভালো লাগে। যেকোনো বই পুরো শেষ করতেই হবে, এটা সাধারণ মানুষ মনে করে না। অনেক বই আছে যেগুলো অল্প পড়েই তারা রস গ্রহণ করতে পারে। এই যোগ্যতা অর্জনও বেশি বই পড়ার কারণেই হয়েছে। বই তারা পাঠ করে জীবনকে বুঝবার জন্য, জীবনকে সুন্দরভাবে উদ্যাপন করবার জন্য। স্কুল-কলেজের বইয়ের ভার ও ভয়ে কাবু হতে হয় না তাদের। ভ্রমণ ব্যাগে তো থাকবেই—অফিসের ব্যাগেও টিফিন, পানি, ছাতার সঙ্গে একটি বই থাকবে না, এটা অবিশ্বাস্য।
রাশিয়ায় একটি বইয়ের দোকানে ‘গ্রন্থহৃদয়’
কী বই তারা পড়ে? শুধুই কি গল্প-উপন্যাস? না। কেউ খেলাধুলার, কেউ ফ্যাশনের, কেউ জাদুর, কেউ বিজ্ঞানের, কেউ শরীরচর্চার, কেউ দর্শনের, কেউ লাইফস্টাইলের, কেউ পড়ে চিরায়ত বই। কর্মজীবীরা নিজের কাজে আরও পারদর্শী হওয়ার জন্য, উন্নতি করার জন্য বই পড়ে। আমরা কর্মক্ষেত্রে ঢুকে পড়লে ভাবি, পড়া শেষ! রুশরা ভাবে, নতুন ক্ষেত্রের পড়া শুরু। পড়ার এই অভ্যাসটি গড়ে ওঠে বলেই কর্মজীবন থেকে অবসর নিলেও পড়ার জীবন থেকে তাদের অবসর হয় না—জীবনটা চলমানই থাকে, থাকে গতিশীল।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন