আবু জাফর
অনেক মানুষ আছেন যারা দৈবক্রমে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে যান বটে, কিন্তু স্বভাবের কোনো পরিবর্তন ঘটে না। সেই হিংসা, সেই ঈর্ষাকাতরতা, সেই ক্ষুদ্রতা, সেই সঙ্কীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ, অপর মানুষের প্রতি অবজ্ঞা, ন্যায্যতার প্রতি বিমুখ মনোভাব, বিবেকভ্রষ্ট ফাঁকা আত্মগরিমা- এসব নিয়ে তারা আগের ভ্রান্ত অবস্থানেই থেকে যান। সৌভাগ্য তাদের বিনম্র তো করেই না; বরং আরো বেশি দাম্ভিক, আরো বেশি অসূয়াপ্রবণ ও অহংসর্বস্ব করে তোলে। এ ধরনের মানুষ যদি রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তারা হয়ে ওঠেন নিষ্ঠুর ও নিপীড়ক এবং অপরের অধিকার সম্পর্কে পুরোপুরি অসচেতন ও আত্মবাদী। এরা যদি ব্যবসায়ী হন, তাহলে তারা ভোক্তার অধিকারের প্রতি উদাসীন এবং নির্লজ্জ-লুণ্ঠনকারী। যদি হন রাজ-অমাত্য বা আমলা, তারা হয়ে ওঠেন সম্পদলিপ্সু স্বার্থান্বেষী উৎকোচলোভী, হয়ে ওঠেন প্রায় দস্যুতস্করের মতো গোপন অর্থশিকারি। দুঃখের বিষয়, এরা সর্বদা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যান। এদের মানবদরদ ও দেশপ্রেম বস্তুত কুৎসিত ও অকথ্য তামাশায় পরিণত হয়। আমাদের এসব কথা বহু মানুষের বিশেষ গাত্রদাহের কারণ হতে পারে, কিন্তু পৃথিবী এভাবেই চলছে। বলা বাহুল্য, আমাদের বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে আদৌ কোনো ব্যতিক্রম নয়। এভাবেই চলছে, আশঙ্কা হয় আরো বহু দিন এভাবেই চলবে, যদি দৈবাধীন, যুগান্তকারী কোনো পরিবর্তন না আসে।
এখন আমরা জাতীয় নির্বাচনের কথা উল্লেখ করতে চাই। এই এই নির্বাচন কতটা অবিতর্কিত ও গ্রহণযোগ্য হবে, কতখানি পরিচ্ছন্ন হবে, তা নিয়ে সব পক্ষেরই বিস্তর সংশয় রয়েছে। সবাই জানেন, দিন যত যাবে এই সংশয় ততই ঘনীভূত হবে। নির্বাচন কমিশন সবার সঙ্গেই আলোচনা করছে। কিন্তু কোনো আলোচনাই সর্বসম্মত রূপ পরিগ্রহ করতে পারছে না। কমিশন যদি পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে অভিজ্ঞতা, মেধা ও প্রজ্ঞাবলে সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারে এবং সেই মোতাবেক অবিচল থাকার সৎসাহস বজায় রাখতে পারে, আশা করা যায়- একটি গ্রহণযোগ্য সফল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অবশ্য ভয়ে কিংবা ভালোবাসায় কমিশন যদি নিজ দায়িত্ব সম্পাদনে ইনসাফকে অগ্রাধিকার দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সব আয়োজনই হবে পণ্ডশ্রম। আমরা কোনো অসার ও নিষ্ফল কর্মতৎপরতা দেখতে চাই না। আমরা চাই অটুট ও সাহসী ভূমিকা, যেখানে কারো দুর্বিনীত রক্তচক্ষু বা পদলেহী চাটুকারিতা কমিশনকে পরাভব-স্বীকারে বাধ্য করতে না পারে। জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই জাতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্ম; এতে যদি ক্রিকেট মাঠের একজন সাধারণ আম্পায়ারের নিরপেক্ষতা ও সাহসটুকুও কমিশন প্রদর্শন করতে না পারে, তাহলে নীরবে অশ্রু-বিসর্জন ছাড়া জাতির জন্য আর কিছু করার থাকে না। কোনো চিকিৎসক কি কোটি টাকার লোভে একজন রোগীকে মেরে ফেলার কথা ভাবতে পারেন? একজন বিচারক কি পারেন জেনেশুনে ইনসাফ কেনাবেচা করতে? তাহলে একজন রাজনীতিবিদ যিনি সততই দেশপ্রেমের উদাত্ত আহ্বানে উচ্চকণ্ঠ, তিনি কী করে পারেন জনগণের ন্যায্য অধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করে ক্ষমতা ও বিত্তবৈভবের পাহাড় গড়ে তুলতে? আসন্ন নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে এসব কথাই প্রশ্ন হয়ে জনমনে সরবে-নীরবে তরঙ্গায়িত হচ্ছে। বিষয়টি এত প্রকট ও সর্বজনবিদিত, কোনো সৎ ও নির্লোভ এবং আত্মজয়ী উত্তম স্বভাবের মানুষ আজ আর ইলেকশনরূপী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেতেই চাচ্ছেন না। নির্বাচন কমিশন কী ভাবছে কমিশনই জানে। আমাদের বক্তব্য শুধু এটুকু- এত কথা এত আয়োজন যেন তামাশা ও হাস্যকর মেলোড্রামায় পরিণত না হয়।
জনগণ যা আশা করে, সেই কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনেক সমস্যা বিদ্যমান। বিরাজমান এসব সমস্যাকে পুরোপুরি নিরাময় করে তোলা কার্যত অসম্ভবই বটে। অর্থাৎ কিছু সমস্যা ও সঙ্কট থাকবেই, যা ষোলআনা প্রশমিত করা সম্ভব না-ও হতে পারে। আগেই উল্লেখ করেছি, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে মুখ্যত সমস্যা আসলে দু’টি এবং এগুলো অত্যন্ত গুরুতর এবং প্রায় অপ্রতিরোধ্য। এক. অর্থের খেলা- যা অসংখ্য বেপরোয়া মাস্তানকে মাঠে নামিয়ে দিয়ে কেন্দ্র দখল, ভোট ডাকাতি প্রভৃতি কাজের মধ্য দিয়ে পুরো নির্বাচনকে তছনছ করে ফেলে। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, নির্বাচন কমিশনের তো বটেই, এমনকি প্রতিপক্ষ দলেরও করণীয় কিছু থাকে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই এসব ঘটতে থাকে। এ দেশে এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা অসম্ভব। এ জন্য, নির্বাচন কমিশন যাদের সাথে মতবিনিময় করছেন, তারা সবাই নির্বাচনকালে সেনাবাহিনী তলব করার কথা বলছেন। কারণ সেনাবাহিনীর উপস্থিতির ফলে মাস্তান বাহিনীর ঔদ্ধত্য ও তাণ্ডব স্তিমিত না হয়ে কোনো উপায় থাকে না। অবশ্য অনেকের বিপরীত অনেক চিন্তাও আছে। তাদের ধারণা, সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা হলে নির্বাচনে সুষ্ঠুতা হয়তো আসবে। কিন্তু দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার জন্য তা কল্যাণকর ও সমীচীন হবে না। কিন্তু এ কথারও উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদী মন্তব্য আছে। অনেকের যুক্তি, দেশের নানাবিধ দুর্যোগ ও দুঃসময়ে সেনাবাহিনী যদি নিষ্ঠাভরে ত্বরিত তৎপর হয়ে উঠতে পারে, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এমনকি ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণÑ এসব ক্ষুদ্র-বৃহৎ প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা যদি বিতর্কিত না হয়, বিশেষ করে বিদেশেও যখন তারা প্রশংসনীয় ভূমিকায় শামিল হতে পারছে, কোথাও তাদের নিয়ে তর্ক-বিতর্কের সূত্রপাত ঘটছে না, তখন দেশ ও জাতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ও সঙ্কটে তাদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণকে বিতর্কিত করা যথাযথ হবে না। আসলে এখানেই প্রশ্ন; আর এ প্রশ্নে কমিশন কি প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, সেটাই জাতির দেখার বিষয়। দ্বিতীয় যে বিষয়টি সর্বোচ্চ সতর্কতা দাবি করে, সেটা হলোÑ যত ঝুঁকিপূর্ণই হোক, সব মাস্তানি উৎপাত ও দৌরাত্ম্য নির্বাচনী বুথ ও চত্বরে প্রতিহত করতেই হবে। এসব অপকর্ম যদি আশাপ্রদভাবে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না থাকে, অর্থাৎ গোলযোগ যদি অব্যাহতভাবে প্রবল থেকে প্রবলতর রূপ ধারণ করে, তাহলে সব চেষ্টা-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। বড় কঠিন এ সঙ্কট, যা পুরো নির্বাচনকেই গ্রাস করে নিতে পারে। নির্বাচন কমিশন কিভাবে এ সঙ্কট মোকাবেলা করবে সেটা বিষম দুর্ভাবনার বিষয়। কারণ এত আগেই বিভিন্ন দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে যে স্নায়ুচাপের আধিক্য দেখা দিচ্ছে, তা চূড়ান্তপর্যায়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেই শঙ্কা ক্রমাগত ঘনীভূত হচ্ছে।
যা হোক, কোনো দল বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই, থাকার কথাও নয়। আমরা শুধু বিরাজমান অবস্থা ও সম্ভাব্য নানামুখী সঙ্কট ও ঘনায়মান নিম্নচাপের বিষয়টি মনে রেখে কথা বলছি। আমরা খুবই স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। বিশেষ করে আমাদের রাজনীতিজ্ঞানের দৈন্য এতই প্রকট যে, জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে অগ্রিম কোনো আলোচনা থেকে যথাসাধ্য দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয়। তবু সাধারণ বুদ্ধিকে সম্বল করে কিছু বলার চেষ্টা করছি। আলোচ্য বিষয়ে আমরা এই মুহূর্তে একটি পরামর্শ উল্লেখ করতে চাই। তা হলো- সব দল থেকেই যারা মনোনয়নপ্রত্যাশী ও মনোনয়ন লাভে সচেষ্ট, তাদের সবাইকে নিয়ে সবার কাছে এ মানবিক আবেদনটুকু বিশেষ গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা আবশ্যক যে, জয়-পরাজয়ই মুখ্য নয়, মুখ্য হওয়া উচিত মানবিক দায়িত্ববোধ; মুখ্য হয়ে ওঠা উচিত অকৃত্রিম মানবপ্রেম ও মনুষ্যত্বনিষ্ঠা। এ রকম যদি হতে পারে, তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা যতই তীব্র হোক, বিদ্বেষ কিংবা বিদ্বেষপ্রসূত কোনো কার্যক্রম প্রবল হয়ে উঠতে পারে না। নির্বাচন কমিশন এ দিকটির প্রতি সবাইকে অভিনিবিষ্ট হতে আহ্বান জানালে অনেকটা ভালো ফল হতে পারে। ক্ষমতার প্রতি দুর্বার আকর্ষণ যদিও সর্বদা সক্রিয়, কিন্তু মানুষের মধ্য থেকে শুভবুদ্ধি ও শুভচেতনা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। কাজেই নির্বাচন কমিশন যদি সবার সুস্থবুদ্ধির কাছে আন্তরিকভাবে আবেদন মেলে ধরতে পারে, নিশ্চয়ই তা পুরোপুরি নিষ্ফল হবে না।
সময়টা আদৌ ভালো যাচ্ছে না। এক দিকে সম্প্রতি জল-বন্যার মারাত্মক আক্রমণ, অন্য দিকে যমুনার ভয়াবহ ভাঙন এবং পাহাড়ধসের ভয়াল আকস্মিকতা; সর্বোপরি মিয়ানমার থেকে আগত লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর অপ্রতিহত চাপ- সব মিলিয়ে এক নিদারুণ বিপন্ন অবস্থা। সমগ্র পৃথিবী এখন চেয়ে আছে বাংলাদেশের দিকে। ত্রাণসাহায্য কিছু আসছে, কিন্তু তা এতই অপ্রতুল যে, অনেকটা নির্দয় প্রহসনের মতো। কোনো কোনো দেশ সান্ত্বনা জ্ঞাপন করছে, কিন্তু সেই সান্ত্বনাও কতটা নিছক মৌখিক, আর কতটা বাস্তবানুগ- তা এক প্রশ্নই বটে। যা হোক, রোহিঙ্গা প্রশ্নে দেশের মানুষ যে একতাবদ্ধ এবং সরকারও সাধ্যমতো সক্রিয়, এটাই বর্তমান সময়ের সর্বোচ্চ আশার কথা। বিষয়টি উল্লেখ করতে হচ্ছে এ কারণে যে, নানামুখী বিপদ ও বিপর্যয়ের মধ্যেও জাতীয় নির্বাচন ত্বরিত এগিয়ে এসেছে, আর নির্বাচনী ময়দানও দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। আগেই বলেছি, আবার বলি- সমগ্র পৃথিবীর চোখ এখন বাংলাদেশের দিকে এবং তা শুধু রোহিঙ্গাদের দিকে নয়, সমাগত জাতীয় নির্বাচনের দিকেও। বিশ্ব দেখবে ১৬ কোটি মানুষের দেশে কেমন হয় নির্বাচন? সংশ্লিষ্ট সবার জন্য এ কথাটিও অভিনিবেশসহকারে মনে রাখার মতো বিষয়।
লেখক : শিক্ষাবিদ, গীতিকার, সাহিত্যিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন