সাইদ রহমান
কিছু শব্দ আছে যেগুলো নিয়ে আপনি চাইলেই খেলা করতে পারেন, এমন একটা শব্দ হলো ‘নিরপেক্ষতা’। এই শব্দের আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় কোনো পক্ষেই অবস্থান গ্রহণ না করা। কিন্তু বাস্তবে কি এটা সম্ভব? উত্তর হলো, না। বিচারক যখন বিচার করেন তখন বিচার শেষে তিনি একটি পক্ষ নেন। কোনো পক্ষেই অবস্থান না নিয়ে বিচারকের পক্ষে বিচার করা সম্ভব নয়।
.
তাহলে ‘নিরপেক্ষ’ ব্যাপারটা কি? সবাই হয়তো বলবেন, বিচারক উভয় পক্ষে সমান অবস্থান গ্রহণ করবেন। ভালো কথা, কিন্তু বিচারকের কাজইতো এই যে, তিনি উভয় পক্ষেই সমান অবস্থান নেবেন। তাহলে ‘নিরপেক্ষ বিচার’ করবেন আলাদা করে এই কথার মানে কি? বিচারক হিসেবে তার তো এমনিতেই অনিরপেক্ষ বিচার করার কথা। বিচার মানেই তো নিরপেক্ষ বিচার।
ভাবছেন, ‘নিরপেক্ষ’ শব্দ নিয়ে এত আপত্তি কেন? সঙ্গত কারণ আছে।পৃথিবী জুড়েই পিছিয়ে পড়া, নির্যাতিত-নিপীড়িত পক্ষকে অগ্রাধিকার অর্থাৎ ‘অন্য পক্ষের চেয়ে বেশি সুবিধা’ দেয়ার রেওয়াজ আছে। তাই যদি ন্যায় বিচারের জন্য কোনো পক্ষকে ‘অগ্রাধিকার’ দিতে হয় তাহলে তো আক্ষরিক অর্থে সেটা আবার নিরপেক্ষ হবে না। এজন্য নিরপেক্ষ শব্দটা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আসলে বিপদজনক। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার বদলে ‘ন্যায্যতা’ শব্দটি যুৎসই হতে পারে।
আমরা বলি, মানুষ মাত্রই মরণশীল। অথচ বলি না যে মানুষ মাত্রই অনিরপেক্ষ! সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের সঙ্গে ‘নিরপেক্ষ’ ব্যাপারটা যায় না। বোধকরি, এটা ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য। দিন শেষে আমাদেরকে একটা পক্ষ নিতেই হয়। নিরপেক্ষতা আসলে পীড়ককে সাহায্য করে, কখনই পীড়িতকে নয়। নিরপেক্ষতা জাতভাই হতে পারে ‘নিরবতা’। এই নিরবতাও অত্যাচারীকে উৎসাহ দেয়, অত্যাচারিতকে নয়।
বিখ্যাত ইতালীয় কবি দান্তে আলিগিয়েরিতে বলেছেন, ‘নরকের সবচেয়ে অন্ধকার এবং জ্বলন্ত অংশটি সেইসব মানুষের জন্য বরাদ্দ থাকবে যারা গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক সঙ্কটের সময় নিরপেক্ষতা অবলম্বন করেছে।’ দান্তের এই কথায় দ্বিমত করবার কোনো সুযোগ নেই। আক্ষরিকভাবে নিরপেক্ষতা শব্দটি যে অর্থের দিকে নির্দেশ করে সেই অর্থে নিরপেক্ষতা মানে ‘অবিচার’ অর্থাৎ ‘অন্যায় বিচার’। এটি করতে গেলে পৃথিবী স্থবির হয়ে যাওয়ার কথা।
নিরপেক্ষতা আসলে এক ধরনের ‘ভান’। আপনি যে দুর্বল তার প্রমাণ হলো আপনার নিরপেক্ষতা। আপনি যদি দুর্বল হোন, আপনার মেরুদণ্ড যদি সোজা না হয় তাহলেই শুধু আপনি নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করবেন। আর আপনি যদি সবল হোন, আপনার মেরুদন্ড যদি সোজা থাকে তাহলে আপনি শুধু আপনার ওপর অর্পিত দায়িত্বটি সূচারুরূপে পালন করবেন মাত্র।
এটি করতে গিয়ে আপনার সিদ্ধান্তটি কোন পক্ষের পক্ষে গেল আর কোন পক্ষের বিপক্ষে গেল সেটা দেখা আপনার কাজ নয়। আপাত চোখে সিদ্ধান্তটিকে কোনো নির্দিষ্ট পক্ষের অনুকূলে মনে হতে পারে। যে পক্ষের প্রতিকূলে গেল সেই পক্ষ ‘পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত’ বলে আন্দোলন করতে পারে। তাতেও কিছু আসে যায় না যদি আপনি আপনার ওপর অর্পিত দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করে থাকেন। যে গোষ্ঠি পক্ষপাতদুষ্টতার দোহাই দিয়ে আন্দোলন করলো, সিদ্ধান্ত উল্টো হলে এরাই আপনাকে বাহবা দিত আর আন্দোলন করে মাঠ গরম করতো অন্য পক্ষ! এজন্যই নিরপেক্ষ ব্যাপারটি ‘বিপদজনক’।
যেসব মানুষ সব পরিস্থিতিতেই নিরপেক্ষতা দাবী করে তারা আসলে নিরপেক্ষ না। তারা একটি পক্ষে যেতে চায় বলেই নিরপেক্ষতার বাঁশি বাজায়। নিরপেক্ষতা বজায় রাখার পরও সেটা যদি তাদের পক্ষে না যায় তাহলেই মুহুর্তের মধ্যে তাদের ভাষায় সেই কাঙ্খিত নিরপেক্ষতা হয়ে উঠবে ‘পক্ষপাতদুষ্টতা’। তাই মূল কথাটা হলো, ব্যক্তির ওপর অর্পিত দায়িত্বটি সঠিক এবং যথাযথভাবে পালন।
দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বারংবার আমরা তার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারি। নিরপেক্ষতার সবক দিতে পারি না। তিনি (দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি) নিরপেক্ষ হওয়ার জন্য সেখানে বসেননি, বসেছেন নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করতে। উন্নত দেশগুলোতে নিরপেক্ষতা নিয়ে এত কথা হয় বলে মনে হয় না। কারণ তারা দায়িত্ব নিয়ে প্রয়োজনীয়/যথাযথ কাজটা করে তাই তাদের নিরপেক্ষ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
বাংলাদেশে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির যথাযথ দায়িত্ব পালনের রেওয়াজ নেই। তাই এখানে নিরপেক্ষতার কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা ওঠে। তাছাড়া এদেশের রাজনীতিতে (রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে) বিরাজ করে পাহাড়সম আস্থাহীনতা। তাই যারা মধ্যস্থতা করতে আসে তাদেরকে নিরপেক্ষতার ভান করতে হয়।
এখানকার রাজনীতিতে অস্থিরতা, বিক্ষুব্ধ অবস্থা লেগেই থাকে। তাই এখানে নিরপেক্ষ থাকাটা সিন্ধু সেঁচে মুক্তা তুলে আনার মতো। মার্কিন ইতিহাসবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হাওয়ার্ড জিনের কথাটা এদেশের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য ‘চলন্ত ট্রেনে আপনি চাইলেও নিরপেক্ষ থাকতে পারবেন না।’
এদেশে নিরপেক্ষতা বড় অদ্ভুত জিনিস। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে অবলীলায় অন্য ধর্মকে গালি দেয়া হয়। নিরপেক্ষতার মুখোশটা পরে নেয় মূলত ধর্মটাকে গালি দেয়ার জন্য। একটা ধর্মকে নিরন্তর গালি দেয়ার পর অন্য পক্ষের ধর্মটাকে কিঞ্চিৎ সমালোচনা করে নিরপেক্ষতার ঝাণ্ডা তুলে ধরবার জন্য। কী গোলমেলে নিরপেক্ষতা!
নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন কেন? যে তদন্ত করবে তার কাজই তো নিরপেক্ষ তদন্ত করা। পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে কারো পক্ষাবলম্বন করা নয়। যেহেতু দায়িত্বটা পালন করা হয় না তাই প্রশ্ন আসে নিরপেক্ষতার। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্র সংগঠনকে বুকে রাখা আর আরেকটিকে পিঠে রাখা উপাচার্যের কাজ নয়। তারপরও উপাচার্যরা সেটাই করে থাকেন। তাই খোঁজা হয় ‘নিরপেক্ষ উপাচার্য’। এভাবে সর্বত্র আমরা নিরপেক্ষতা খুঁজি। অথচ কাউকে তার দায়িত্বহীনতার জন্য শক্ত করে প্রশ্নের মুখোমুখি করতে পারি না।
নির্বাচন যেহেতু ঘনিয়ে আসছে তাই এখন রব উঠছে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনারের। নির্বাচন কমিশনার নিরপেক্ষ আচরণ করবে কিনা, এ নিয়ে জল্পনা কল্পনার অভাব নেই। এবার একটি প্রশ্ন আজ পর্যন্ত কোনো বিষয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছেছে আমাদের বড় দুটি পক্ষ? কখনো পৌঁছাবে? উত্তর হল, না। তাহলে আমরা কেন আশা করছি যে, নিরপেক্ষ থাকলেই দুপক্ষ ফলাফল মেনে নেবে! অথচ আসল যে জায়গাটা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই, সেটা হল, নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব তাদেরকে যথাযথভাবে পালন করতে হবে। হোক সেটা যে পক্ষের লোক দ্বারাই গঠিত কমিশন।
‘দেশে পাগল এবং শিশু ছাড়া কোনও নিরপেক্ষ লোক নেই’ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কথাটা বলেছিলেন একজন পাকা দার্শনিকের মতো। এটা নিয়ে ব্যঙ্গ করার কিছু আছে বলে মনে করি না বরং আমাদের দেশের রূঢ় বাস্তবতায় এর চেয়ে সত্য আর হতে পারে না। কিন্তু দুঃখজনক হলো, চেয়ারপারসনের সেই কথাকে অমান্য করে এখন পুরো দল মিলে পাগল এবং শিশুর বাইরেও নিরপেক্ষ লোক খুঁজছে!
শুধু বিএনপিকে কেন, যেকোনো দলকেই যদি ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ’ ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে বলা হয় তাহলে তারা তা পারবে বলে মনে হয়? সঙ্গত কারণেই সম্ভব না। নিরপেক্ষতার আলোচনা আগাগোড়াই অন্তঃসারশুন্য। কারণ সত্যিকারের নির্দলীয় কেউ হতে পারেন না। প্রত্যেক ব্যক্তিরই নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকা খুবই স্বাভাবিক। তাই এই আলোচনায় সময় ব্যায় না করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিৎ নয় কি?
রাষ্ট্র ব্যবস্থা হবে সিস্টেম নির্ভর, জবাবদিহি নির্ভর। আইনের কাঠামোর ভিত্তিতে যেখানে কোনো ব্যাক্তি তার দায়িত্বের ব্যত্যয় কিছু করতে চাইলেও সফল হবে না। যদি কদাচিৎ সফল হয়ও তাহলে যথাবিধিতেই তার বিচার হবে। কিন্তু সব কিছুর জন্য যদি ব্যক্তির নিরপেক্ষতার ওপর নির্ভর করতে হয় তাহলে তো এই পরিস্থিতি রাষ্ট্রযন্ত্রের ভয়াবহ ব্যর্থতার শামিল।
এই ব্যর্থতা খুব শিগগিরই আমাদের ধ্বংস ডেকে আনবে। যখন কোনো নির্দিষ্ট পদের জন্য কোনো নিরপেক্ষ লোক পাওয়া যাবে না তখন কি রাষ্ট্রযন্ত্রকে বন্ধ করে দিতে হবে? উত্তরটা ‘হ্যাঁ’ হলে কিংবা ওই পদের জন্য নিরপেক্ষ (যদিও এর কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই) লোক নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হলে এই দেশটি অনেক আগেই স্থবির হয়ে পড়ার কথা। কারণ এই দেশের জন্মের পর এখানে কোনো পদের জন্য নিরপেক্ষ লোক পাওয়া গেছে বলে কেউ শুনেনি। এটা ঠিক যে, অনিরপেক্ষ লোক হওয়া সত্বেও কখনো কখনো কেউ কেউ নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছেন।
এ দেশে বুদ্ধিজীবী, উকিল, ডাক্তার, আমলা, শিক্ষক, সাংবাদিক কে নিরপেক্ষ? অনেকেই সুশীল সমাজের কথা বলতে চান। তারা তো সেই কবেই শতক আর সহস্রে ভাগ হয়ে বসে আছেন। ঘরানার বাইরে এদেশে কোনো লোক নেই। তাই যেকোনো পদের জন্যই নিরপেক্ষতা তল্লাশি না করে এমন একজনকে দায়িত্ব দিতে হবে যিনি সুষ্ঠুভাবে, সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন। এমন একজনকে দিতে হবে যার মেরুদণ্ড এখনো খাড়া আছে, যিনি নিরপেক্ষ কথা বলেন না, যৌক্তিক কথা বলেন।
নিরপেক্ষতাই এক ধরনের পক্ষপাতদুষ্টতা ‘নিষ্ক্রিয় পক্ষাবলম্বনের কৌশলী অবস্থান বিশেষ’। তাই নিরপেক্ষতা-অনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকাটাই আসল কথা। পদে যাকেই বসানো হোক না কেন, যেহেতু কোনো না কোনো পক্ষ তার বিরোধিতা করবেই। তাই নিরপেক্ষতার নামে এই ‘প্যারাডক্স’ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার কোনো মানে হয় না! ব্যাপারটা নিয়ে হয়তো তত্ত্ব কপচানো যাবে। কিন্তু বাস্তবে এটার মূল্য কোথায়?
সাইদ রহমান : সাংবাদিক, কলাম লেখক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন