আনিস আলমগীর
বাংলাদেশের বিচারপতিদের মধ্যে অনেক বিরল গুণও ছিল। সুপ্রীম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেনের ছেলে মারা গিয়েছিলো। তিনি মৃত ছেলের গোসল দিয়ে কফিন পরিয়ে তার বাসায় কফিন রেখে সুপ্রীম কোর্টে এসেছিলেন। কারণ সিদ্ধান্ত হয়েছিলো সিলেট থেকে তার মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা আসার পর মাহমুদ সাহেবের মৃত ছেলের দাফনের কাজ সন্ধ্যার পরে সম্পন্ন হবে।
.
সুপ্রীম কোর্টে মাহমুদ সাহেবকে কোর্টে দেখে সহকর্মীরা জিজ্ঞেস করলেন- ছেলের লাশ ঘরে রেখে আপনি কেন এসেছেন? তখন তিনি পরিস্থিতি বর্ণনা করে বললেন, সময় যখন পেয়েছি তাই এসেছি কারণ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ শুনানি আছে। আমার অনুপস্থিতিতে শুনানী বন্ধ থাকবে মক্কেলেরা কষ্ট পাবে।
মরহুম মাহমুদ সাহেবদের মতো বিরল গুণাবলীর লোক পাওয়া এখন মুশকিল হবে। কিন্তু একেবারে যে পাওয়া যাবে না তাতো নয়। বিচারপতি নিয়োগের সময় আওয়ামী লীগ তার নিজস্ব উকিল আর বিএনপি বিএনপির উকিল নিয়োগ দিলে তো হবে না। গুণাবলীর তালাশও নিতে হবে। তা হচ্ছে না বলে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার মতো দুর্নীতিতে অভিযুক্তরা বিচারাসনে বসতে পেরেছেন।
যাক, নানা নাটকের পর অবশেষে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা অবশেষে পদত্যাগ করেছেন। সিনহা সাহেবের পদত্যাগ মিডিয়ায় তেমন আলোড়ন তুলতে পারেনি যতটা তার ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার সময় হয়েছে। কেউ কেউ এই বিদায়ে সরকারের সমালোচনা করেছেন। তাদের যুক্তি সরকারের ইচ্ছে অনুযায়ী চলতে পারছেন না বলে সিনহার এই পরিণতি। তবে যে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সিনহা সংসদ থেকে বিচারালয়ের হাতে আনলেন, তাতে লাভ হল কি! সরকারতো চাইলে তাহলে যে কাউকে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারেন
আবার অনেকে খুশি এই পদত্যাগে। তাদের যুক্তি বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা একজন অসাধু বিচারপতির হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে এর মধ্য দিয়ে। খবর বেরিয়েছে, ২০০৮ সালে হাই কোর্টের বিচারপতি থাকাকালে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে বিচার বিক্রি ও মানি লন্ডারিং এর অভিযোগ উঠেছিলো। তখন ২০০৮ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি তিনি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পদত্যাগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি পদত্যাগ করেননি। বরঞ্চ তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে- একজন বিচারপতি যিনি বিচার বিক্রি করার অভিযোগে অভিযুক্ত, মানি লন্ডারিং এর অভিযোগে অভিযুক্ত- তার তদন্ত করে বিচার সোপর্দ করার পরিবর্তে তাকে এপেক্স কোর্টে কে বা কারা নিয়োগ দিয়েছিলেন? তারও তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তার নিয়োগের ব্যাপারে প্রাক্তন আইনমন্ত্রী শফিকুর রহমান ও আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের ভূমিকা সম্পর্কে তাদের স্ব স্ব মুখে তার বিস্তারিত বিবরণী জাতি অবগত হতে চায়। পরবর্তী সময়ে তাকে এপেক্স কোর্টের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছিলো। কোন্ উপযুক্ততার ভিত্তিতে তাকে প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো তারও ব্যাখ্যা দেওয়া সরকারের উচিৎ।
কিছুদিন আগে আমরা একটি বেসরকারি টিভিতে দেখেছি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে দুটি পে-অর্ডারের ছবি। ফার্মাস ব্যাংকের ইস্যুকৃত সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে ওই দুই পে-অর্ডারে লেখা টাকার পরিমাণ দু’কোটি করে মোট চার কোটি টাকা। পে-অর্ডার দুটি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সোনালী ব্যাংক হাইকোর্ট শাখার একাউন্টে জমা হয়েছে এবং টাকা সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তুলে নিয়েছেন। টিভিতে প্রদর্শিত দলিলে দেখা যায় সিনহার ট্যাক্স রিটার্নে প্রচুর গরমিল রয়েছে। সিনহা সাহেব সব বিষয়ে কথা বলেন কিন্তু এইসব দুর্নীতির খবরের কোনও প্রতিবাদ করেননি।
আমরা অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকার পরও আওয়ামী লীগ সরকার তাকে এপেক্স কোর্টে নিয়োগ দিয়েছিলো আবার পরবর্তী সময়ে তাকে প্রধান বিচারপতিও করেছিলো। আর এখন বেদনার সঙ্গে লক্ষ করছি যে তাকে প্রধান বিচারপতি হিসাবে বহাল রাখার ব্যাপারে সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশন এবং বিএনপির জাতীয়তাবাদী আইনজীবীরা আন্দোলন করছেন। সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশনও বিএনপির দখলে। এডভোকেট জয়নাল আবেদীন সভাপতি আর ব্যারিস্টার মাহাবুব উদ্দীন খোকন সেক্রেটারি।
বেগম খালেদা জিয়াও তার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় সিনহার জন্য আফসোস করেছেন। একদল কোনও বিষয়ে কথা বললে আর এক দলের তার বিরোধিতা করা যেন ওয়াজিব হয়ে যায়। ভাল-মন্দ বিচার করার কোন তোয়াক্কা করে না। বিচারাসনে বসে যে বিচার বিক্রি করে, টাকা রোজগার করে বলতে হবে সে অন্যায়ের যথার্থ প্রতিমূর্তি! রাজশক্তি যারা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের কাছে অনুরূপ ব্যক্তি ভয়ানক হওয়ার কথা অথচ লাজ শরম ত্যাগ করে বিএনপি তাকেই সমর্থন করতে এগিয়ে গেল। বিচারালয়ের পবিত্রতা নিয়ে কারো রাজনীতি করা উচিৎ নয়। সভ্যতার অনুঘটক হচ্ছে বিচার ব্যবস্থা আর সে ব্যবস্থার উপর যদি টাকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা লাভ করে তবে সমাজ তো লণ্ড ভণ্ড হয়ে যাবে।
এমনিতেই প্রতিদিন সমাজ জীবন করুণ থেকে করুণতর পথে এগিয়ে যাচ্ছে। দুর্দশার অন্তর্ঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এ দুর্দশা সমাজের সাধারণ মানুষ সৃষ্টি করছে না। সমাজের উচ্চস্তরে অধিষ্ঠিত লোকেরাই এর জন্য দায়ী। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে গিয়ে ট্রায়াল কোর্টে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির নিকট আত্মীয়দের সাক্ষাৎ করা সহজ বিষয় নয়। সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরীর স্বজনরা প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার সঙ্গে মামলা সুপ্রীম কোর্টে চলার সময় দেখা করেছিলেন।
বিচারপতি জয়নাল আবেদীনের দুর্নীতির তদন্ত স্থগিত করার জন্য প্রধান বিচারপতির নির্দেশে দুদককে চিঠি দেয়া হয়েছে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে রুল নিষ্পত্তির সময় হাই কোর্ট বলেছেন এ চিঠি আপিল বিভাগের চিঠি নয়, এটা প্রশাসনিক চিঠি। প্রশাসনিক চিঠি বলে অত্র চিঠিটাকে অবহিত করে হাইকোর্ট সুপ্রীম কোর্টের ইজ্জৎ রক্ষার একটা কৌশল রপ্ত করলেন বলে মনে হয়। অথচ রাষ্ট্রপতি ছাড়া আর কেউ দায়মুক্তি পেতে পারে না।
ওই প্রশাসনিক চিঠিটাতে বিচারপতি জয়নালের দুর্নীতির মামলা স্থগিত করার কথা বলা হয়েছিলো। সুপ্রীম কোর্টের প্রশাসনিক বিভাগ এ চিঠি নিশ্চয়ই প্রধান বিচারপতির আদেশক্রমেই ইস্যু করেছিলেন। প্রশাসনিক বিভাগের কোনও রেজিস্ট্রার নিজ ইচ্ছানুসারে অনুরূপ কোনও চিঠি ইস্যু করতে পারেন না। এটা প্রধান বিচারপতি সিনহার নির্দেশেই নিশ্চয় লেখা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি সিনহা প্রধান বিচারপতির চেয়ারে বসে সক্রেটিসের মতো, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ইত্যাদি সম্পর্কে কথা বলতেন যেন সাধারণ মানুষের মাঝে তার ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। অথচ তার বিরুদ্ধে ১১টি দুর্নীতির অভিযোগ। মহামান্য রাষ্ট্রপতি যখন এ অভিযোগগুলো সুপ্রীম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির হাতে দিয়েছিলেন তখন সে পাঁচ বিচারপতি প্রধান বিচারপতি সিনহার বাসায় গিয়ে অভিযোগগুলো তার হাতে দিয়ে তার জবাব চেয়েছেন। সিনহা কিন্তু তাদেরকে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। তখন তারা তাদের সিদ্ধান্ত তাকে জানিয়ে দেন যে তারা তার সঙ্গে একই বিচারাসনে বসবেন না।
বিচারপতি সিনহার মতো লোকের মুখে সক্রেটিসের বুলি পরিহাসের উদ্রেক না করে পারে না। সিনহার পক্ষ অবলম্বন করে কথা বলে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা বিচারালয়ের পবিত্রতাকে আরো কয়দিন ঝুঁকির মুখে রাখতে চাওয়া সত্যই বেদনা দায়ক। অবশ্য ন্যায়বোধ তো সর্বত্র বিরাজ করতে হয়। বিচার কেনা বেচায় তো এ উকিলেরাই প্রায় মধ্যস্থতা করে থাকেন।
প্রধান বিচারপতি সিনহা সিঙ্গাপুর থেকে দূতাবাসের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ পত্র পাঠিয়েছেন তা যদি তিনি না করতেন তবে কোনও না কোনও উপায়ে তাকে তো বিচার ব্যবস্থা থেকে সরিয়ে দেওয়ার একটা ব্যবস্থা রাষ্ট্র পক্ষকে করতে হতো। কারণ ১১টি দুর্নীতির অভিযোগ রাষ্ট্র পক্ষের হাতে আসলে তো রাষ্ট্রপক্ষ এ নিয়ে নির্বাক থাকতে পারে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিদায় নিলেই কী দুর্নীতির বিচার থেকে মাফ? সরকারের উচিত সিনহার বিরুদ্ধে উঠা দুর্নীতিগুলো তদন্ত করা, তাকে বিচারের মুখোমুখি করা। নইলে সিনহার পদত্যাগ স্বেচ্চায় নাকি সরকারের চাপে সে প্রশ্নটার জবাব পাবে না জনগণ।
আমার মনে হয় জেলা জজ থেকে হাইকোর্টে প্রমোটি জর্জ বেশী পরিমাণে আসা প্রয়োজন। কারণ তারা জেলা পর্যায়ে দীর্ঘদিন বিচারের কাজ করেছেন তাদের সততা অসততার একটা ব্যাকগ্রাউন্ড দৃশ্যমান থাকে। হাইকোর্টের উকিলদের থেকে যখন বিচারপতি নিয়োগ করা হয় তখন পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ যাচাই বাচাই করা খুবই প্রয়োজন। না হয় দলীয় ভিত্তিতে যে নিয়োগ হচ্ছে তাতে হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্ট টিউডোর যুগের ‘কোর্ট অব স্টার চেম্বার’-এ রুপ নেবে। আর বিচার ব্যবস্থা যখন হুকুমের তাঁবেদার হয়ে যাবে তখন সভ্যতার পতন ঘটবে।
আনিস আলমগীর : সাংবাদিক ও শিক্ষক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন