ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকটের শুরু ১৯৪৮ সাল থেকে হলেও এর বীজ নিহিত ছিল ১৯২০ সালে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বিষয়ে আরব দেশগুলো দাবি জানালেও ইহুদিরা তা মেনে না নেয়ায় সেসময় দুই জাতি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। অটমান সম্রাজ্যের ভেতরে দীর্ঘ ৪শ’ বছর দুই ধর্মের মানুষের পবিত্র স্থানটি মুসলিমদের দখলে থাকায় ইহুদিরা সেখানে বসবাস তো দূরে থাক প্রবেশের অনুমতিই পায়নি।
.
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সম্রাজ্য ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হলে আরব অধ্যুষিত ফিলিস্তিন ব্রিটিশ প্রশাসনের আওতায় চলে আসে। সেসময় অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময়ে পূর্ব ইউরোপসহ বলতে গেলে পুরো ইউরোপ জুড়েই বিভিন্ন স্থানে বংশানুক্রমে ইহুদি অভিবাসীদের বসবাস ছিল।
অত্যন্ত মেধাশক্তিসম্পন্ন, বুদ্ধিমান ও কর্মঠ জাতি হিসেবে পরিচিত ইহুদিরা ইউরোপে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও অর্থনীতিকে অনেকাংশ নিয়ন্ত্রণ করত এবং অবধারিতভাবে অর্থের জোরে রাজনীতিকেও তারা কমবেশি প্রভাবিত করতে সক্ষম ছিল।
স্থানটিকে ঘিরে ইহুদি প্রশ্নের সমাধানে ব্রিটিশ সরকার ইহুদিদের সাথে ১৯১৫ সালে সমঝোতায় আসে। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯১৭ সালে বেলাফোর ডিক্লারেশন বা বেলাফোর ঘোষণা নামে ব্রিটিশ ও ইহুদিদের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। যে চুক্তি অনুসারে আরব অধ্যুষিত তৎকালীন ফিলিস্তিনে ইহুদিদের স্থানীয়ভাবে বসবাসের জন্য সুনির্দিষ্ট একটা ভূমি প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।
ইহুদিদের সাথে ব্রিটিশ সরকারের ‘বেলফোর’ চুক্তি করার আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের পরাজিত করে ফিলিস্তিন দখল করায় ইহুদিরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা করে। সেই সময় ইহুদিদের ছাড়া ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে রাজনৈতিকভাবে তা অর্জন করা সম্ভব ছিল না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর নবগঠিত ‘লীগ অব নেশন্স’ ব্রিটিশ সরকারকে দখলকৃত ফিলিস্তিনের ওপর প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রদান করে। যা মূলত ব্রিটিশ সরকারের ‘বেলফোর’ চুক্তিকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে।
ফিলিস্তিনের গাজা থেকে দুই মাইল উত্তরে কিবুটস এলাকায় ১৯৩০'র দশকে পোল্যান্ড থেকে আসা ইহুদিরা এসে কৃষি খামার গড়ে তোলে। সেখানে ইহুদিদের পাশেই ছিল ফিলিস্তিনী আরবদের বসবাস। আরবদেরও সেখানে কৃষি খামার ছিল। কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাস করা আরবদের সঙ্গে তখন ইহুদিদের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ।
সে সময় ফিলিস্তিনে বসবাসকারী ইহুদিদের আনুমানিক সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র ১১ শতাংশ। অবশ্য নিজেদের নির্ধারিত পুণ্যভূমিতে ফিরে যাওয়ার এবং সেখানে ইহুদিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ও পরিকল্পনাকে সামনে রেখে অটোম্যান সুলতান ও তার এজেন্টদের কাছ থেকে ফিলিস্তিনের পতিত জলাশয় ও অনুর্বর ভূমি ইউরোপিয়ান ইহুদিরা গণহারে কিনতে শুরু করে। যা অব্যাহত ছিল বিংশ শতাব্দীর প্রায় পুরো শেষ ভাগ জুড়েই।
পরবর্তী বছরগুলোতে ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদিদের অনেকেই ফিলিস্তিনে ফিরতে শুরু করে। মাত্র এক বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯৩১ সালের মধ্যেই ফিলিস্তিনে ইহুদি জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৭ শতাংশে।
এর পেছনে অবশ্য কারণও ছিল! জার্মানিতে হিটলারের অনুগত নাৎসিরা ক্ষমতায় এলে ইহুদি বিদ্বেষ চরমে পৌছে। নাৎসিরা ইহুদিদের নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা করলে প্রাণভয়ে দলে দলে ফিলিস্তিনের মাটিতে তারা আসতে শুরু করে।
ফলে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। ফিলিস্তিনীরা বুঝতে পারলো যে ইহুদিরা দলে দলে সেখানে জমি কেনায় তারা ধীরে ধীরে তাদের জমি হারাচ্ছে। ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার সময় প্রায় ৭ লাখের মতো ফিলিস্তিনী সেখান থেকে উচ্ছেদ হতে বাধ্য হয়। তাদের আশা ছিল যে, দ্রুত সমস্যার সমাধান হলে আবারও তারা বাড়ি ফিরে আসতে পারবে। যদিও সেই স্বপ্ন তাদের কখনই পূরণ হয়নি।
ফলে আরবদের মধ্যে বিদ্রোহের সূচনা হয়। তাদের মধ্য বিপ্লবী দলের জন্মলাভ ঘটে। অপরদিকে ইহুদিরাও নিজেদের রক্ষায় শক্তি বাড়াতে থাকে। ১৯৩৬ সাল নাগাদ ইহুদি অভিবাসীদের বিপুল উপস্থিতি ও ইহুদিদের প্রতি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের পক্ষপাতিত্বের কারণে ফিলিস্তিনি বিপ্লবীরা পরবর্তীতে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর সাথে সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ইতিহাসে যা ব্যর্থ ‘১৯৩৬-১৯৩৯ আরব বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানিতে ইহুদিদের নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়া বা ‘নাৎসি হলোকস্ট’ সংঘটিত হলে অসংখ্য ইহুদি ফিলিস্তিনে পালিয়ে আশ্রয় নেয়। ফলে অবৈধ ইহুদি অভিবাসীর সংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পায় যা সেখানকার বসবাসকারী ইহুদি-মুসলিম সম্পর্কে চরম অবনতি ঘটায়। ক্রমেই দুই জাতির ভেতর উত্তেজনা চরম আকার নেয়।
জাতিসংঘের সাধারণ সম্মেলনে ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে ‘ইসরাইল’ ও মুসলিম অধ্যুষিত ‘ফিলিস্তিন’ নামের দুটো পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব করা হয়। মুসলিম ও ইহুদি উভয় ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র ও পুণ্যভূমি হিসেবে বিবেচিত জেরুজালেমকে জাতিসংঘের নিজস্ব ক্ষমতার আওতায় রাখার প্রস্তাব করা হয় উত্থাপিত ওই বিলে।
নবগঠিত আরবলীগ তথা আরব দেশগুলো বিলের বিপক্ষে ভোট দেয়। এমনকি, দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে জাতিসংঘের ফিলিস্তিন বিভাজনকে বেআইনি বলে আরবলীগ দাবি করে। সেই সঙ্গে তারা পুরো ফিলিস্তিনকে আরব মুসলিমদের একক শাসনাধীনে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানায়। কিন্তু তাদের বিরোধীতা সত্ত্বেও জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৩৩ - ১৩ ভোটে ‘রেজ্যুলেশন ১৮১'এর মাধ্যমে বিলটি পাস হয়ে যায়।
এই বিরোধীতাকে অবশ্য ইসরায়েলিরা আরবদের ভুল বলেই মনে করে। ইসরায়েলের সাবেক প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজ’ও ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি'র কাছে এক সাক্ষাৎকারে বছর দশেক আগে বলেছিলেন, ফিলিস্তিনীদের কেন এই দশা হলো সেজন্য তাদের নিজেদেরই প্রশ্ন করা উচিত!
তার মতে, সেই চুক্তিতে রাজি থাকলে অধিকাংশ জমি ফিলিস্তিনিদের হাতেই থাকতো। তাদের একটি আলাদা রাষ্ট্র থাকতো। কিন্তু তারা সেটি প্রত্যাখ্যান করে।
ফিলিস্তিনীদের ভূখণ্ডে এর মাধ্যমে ইহুদিরা একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পায়। কিন্তু আরবরা বুঝতে পেরেছিল যে কূটনীতি দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। জাতিসংঘের ওই সিদ্ধান্তের পর আরব এবং ইহুদিদের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। যদিও সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য আগে থেকেই তৈরি ছিল ইহুদিরা।
আরব এবং ইহুদি সবারই দৃষ্টি ছিল জেরুজালেম শহরের দিকে। কেননা সেটি মুসলমান, ইহুদি এবং খ্রিস্টান এই তিন ধর্মের জন্যই পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত।
জেরুজালেমে বসবাসরত ইহুদিরা ১৯৪৮ পর্যন্ত সেখানে আরবদের দ্বারা অবরুদ্ধ ছিল। কিন্তু সেই বছরের মার্চ মাস থেকে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। আরবদের উপর ইহুদিরা পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, ইহুদিরা তখন আরবদের নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা করেছিল।
ইহুদিরা আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দিলে বহু ফিলিস্তিনি তাদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। ইহুদি সশস্ত্র বাহিনীগুলোর নৃশংসতা তাদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। অন্যদিকে ফিলিস্তিনী সশস্ত্র দলগুলোও ইহুদিদের উপর বিচ্ছিন্নভাবে আক্রমণ চালাতে থাকে।
এমন অবস্থায় ব্রিটেন ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায় । ওইদিনই তৎকালীন ইহুদি নেতারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা করেন। তবে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের এক ঘন্টার মধ্যেই ৫টি আরব দেশ একযোগে আক্রমণ শুরু করে।
মিশর, ইরাক, লেবানন, জর্ডান এবং সিরিয়ার প্রায় ত্রিশ হাজার সেনার বিপরীতে প্রায় ৩৫ হাজার ইসরায়েলি সেনা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। জেরুজালেম দখলের লক্ষ্যে আরব এবং ইসরায়েলের মধ্যে তীব্র লড়াইয়ের একপর্যায়ে ইসরায়েলি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। তাদের অস্ত্রের মজুত’ও শেষ হয়ে যায়।
সম্ভাব্য পরাজয় আঁচ করতে পেরে ইহুদিরা নিজেদের শক্তি সঞ্চয়ের জন্য সময় নেয়। তারা জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করে। যদিও কিছুদূর অগ্রসর হলেই মিশরীয় বাহিনী তেল আবিবের দিকে অগ্রসর হতে পারতো।
যুদ্ধবিরতির সময় দু'পক্ষ শক্তি সঞ্চয় করলেও ইসরায়েল বেশি সুবিধা পেয়েছিল। চেকোস্লোভাকিয়া থেকে তখন ইসরায়েলের হাতে আধুনিক অস্ত্রের চালান এসে পৌঁছায়। ফলে যুদ্ধ বিরতি শেষ হলে নতুন করে আরবদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইসরায়েলি বাহিনী। একের পর এক তারা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখলে নিতে শুরু করে। এরই মাধ্যমে তেল আবিব এবং জেরুজালেমের উপর ইসরায়েলিদের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা পায়।
এরপর থেকে সামরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে ইসরায়েল খুব দ্রুত উন্নতি করতে থাকে। অল্প দিনের মধ্যেই ভূমিহীন একটি জাতি বিশ্বে অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
পাঠক মন্তব্য
অত্যন্ত মেধাশক্তিসম্পন্ন, বুদ্ধিমান ও কর্মঠ জাতি হিসেবে পরিচিত ইহুদিরা ইউরোপে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও অর্থনীতিকে অনেকাংশ নিয়ন্ত্রণ করত এবং অবধারিতভাবে অর্থের জোরে রাজনীতিকেও তারা কমবেশি প্রভাবিত করতে সক্ষম ছিল। Same things are happening now. Jews value education. Arabs like to eat and sleep.
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন