আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারতের কেরালার এক পানের দোকান থেকে একজন পুলিশ অফিসার পান কিনে একটি ১০ টাকার নোট দেয়। দোকানদার বাকি টাকা ফেরত দিলে পুলিশ অফিসারটি রেগে যায়। বাদানুবাদের পর পুলিশ তাকে সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অপরাধে গ্রেফতার করে এবং থানায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে ভীষণ অত্যাচার করে। পানওয়ালা মৃত্যুবরণ করলে তাকে এক জঙ্গলের কাছে নিয়ে ফেলে দেয়। পরে সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করা হয়, এক এনকাউন্টারে (বন্দুকযুদ্ধে) তার মৃত্যু হয়েছে।
ঠিক এমনিভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রাজন এবং অভিনেত্রী স্নেহলতা রেড্ডির পুলিশ পাহারায় মৃত্যু ঘটে। এমনি অসংখ্য ভয়ঙ্কর মৃত্যুর বর্ণনা পাওয়া যায় ভারতীয় সংস্থা, পিউপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিস (পিউসিএল) বুলেটিনে। প্রতিটি তথ্যই ভয়াবহ। যেমন ১৯ বছরের শ্যাম তানে তাদের বাড়ির সামনে দু’দলের মারামারি দেখছিল দাঁড়িয়ে। সেই অপরাধে তাকে গ্রেফতার, অত্যাচার এবং শেষে মৃত্যু ঘটে।
তারাকুণ্ডে এই কমিটি সর্বপ্রথম সরকারি শান্তিরক্ষা সংস্থাগুলোর এমন অনৈতিক, সামরিক এবং একপেশে কর্মকাণ্ডের বিবরণ জনসমক্ষে তুলে আনে। কমিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে। ‘পুলিশ উপরের’ ইচ্ছাকে প্রতিপালন করে নিজেদের ইচ্ছার সাথে মিলিয়ে। এটাই সাধারণ নিয়ম। কেননা তাদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোনো জবাবদিহিতা নেই। কমিটি ৭৭ জন নকশালি মৃত্যুর অনুসন্ধান করে বলেছে, এগুলো সবই হত্যা।
ভারতে সর্বপ্রথম পুলিশি কর্মকাণ্ডের এই প্রবাহে বাধা পড়ে যখন অন্ধ্র প্রদেশে অর্গানাইজেশন ফর প্রোটেকশন অব ডেমোক্রেটিক রাইটস (অপিডিআর) নামে এক সংস্থা ১৩৫ জন সাধারণ মানুষকে কেন পুলিশ হত্যা করেছে, তার জবাব চেয়ে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করে। অপিডিআর জানতে চায় কেন পুলিশ কাস্টডিতে মৃত্যু ঘটবে এবং অত্যাচার করা হবে। তবে এটা বহু পুরনো কর্মকাণ্ড যে, পুলিশ তথ্য সংগ্রহের নামে অত্যাচার করে থাকে এবং এই কর্মকাণ্ডে সরকারি দলের সমর্থন থাকে। যেমন উত্তরপ্রদেশ সরকার গর্বের সাথে ঘোষণা করে, তারা ডাকাতি বন্ধের লক্ষ্যে এক মাসে ৯৮৩ জনকে হত্যা করেছে। পিইউসিএল বলছে, এসব পুলিশি হত্যার পেছনে অনেক কারণের মধ্যে একটি হলো এসব অপরাধী প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের অপরাধের সঙ্গী হিসেবে পুলিশকে পেয়ে থাকে। যে অপরাধী যত বেশি পুলিশ সঙ্গ পায়, তার পুলিশের হাতে মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এখানে যে মৃত্যুর উদাহরণগুলো দেয়া হয়েছে, সেখানে কোনো মুসলিম নাম নেই কেন? এর জবাবে আরব নিউজে এম গাজালী খান এঁকেছেন এক ভয়াবহ চিত্র। তিনি ন্যাশনাল হিউমান রাইটস কমিশনের (এনএইচআরসি) প্রতিবেদন উল্লেখ করে বলেছেন, আসলে অত্যাচার এবং অবিচারের মূল লক্ষ্য মুসলমানেরা। কিন্তু ভারতের প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলো এসব খবর চেপে যায়। যেমন সাধ্বী প্রজ্ঞা ঠাকুরের ওপর অত্যাচারের কাহিনী খুব ভালোভাবে সংবাদমাধ্যমে এসেছে, কিন্তু খাজা ইউনুস বা ইমরান খানের ওপর তৃতীয় মাত্রার অত্যাচারের কাহিনী আসেনি। ইমরান তার বক্তব্যে পুলিশি অত্যাচারের একটি নমুনা দেন। ‘আমার দুই হাত উপরে বেঁধে, ন্যাংটা করে লিঙ্গের সাথে পাঁচ লিটারের এক বোতল বেঁধে দিয়ে তাদের কাগজে স্বাক্ষর করতে বলে। আমি তা করি।’ এমন যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে হয়তো সবাই করে। কোনো মুসলিম যদি আদালতে বিচার চায় তার অবস্থা আরো করুণ। ভারতীয় ছবিতে সানি দেওলের এক ডায়ালগ উল্লেখ করে তিনি মন্তব্য করেছেন, এটা আমাদের নিয়ে। সানি দেওল বলছেন, ‘আদালত আমায় কী দিয়েছে? কেবল তারিখের পর তারিখ।’ অর্থাৎ বিচারকে দীর্ঘায়িত করে তা বন্ধ করে দেয়া। তবুও তিনি বলেছেন, ভারতীয় বিচারব্যবস্থা প্রায়ই চেষ্টা করে সঠিক বিচার করতে। তবুও এশিয়ান সেন্টার ফর হিউমান রাইটস (এসিএইচআর) তাদের ২০০৯ সালের প্রতিবেদনে বলেছে, সেখানে পুলিশি হেফাজতে ১১৮৪ জনের মৃত্যু ঘটেছে।
আসলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বলে পরিচিত এই শাস্তি এবং আইন প্রয়োগের নামে যে কর্মকাণ্ড চলে তা কখনোই আইনানুগ নয় ও জনকল্যাণে আসে না। জনগণ তাদের নিজেদের সঙ্ঘবদ্ধতার মাঝ দিয়ে যতটুকু স্বস্তি এবং শান্তি নির্ধারণ করতে পারে তাই তারা উপভোগ করে বলে মন্তব্য এসেছে নানা অনুসন্ধানে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের প্রতি বছরের অনুসন্ধানী রিপোর্টে একটি ক্ষোভ বারবার উল্লেখ করে। তা হলো শান্তি ও আইন রক্ষায় নিয়োজিত শক্তি যদি অনাচার ও অবিচারের পথের সাথে না থাকে তবে শান্তি রক্ষা সহজ এবং জনজীবনে বিরাজ করে স্বস্তির রাজ্য।
‘টর্চার অ্যান্ড রেপ ইন পুলিশ কাস্টডি’ বলে একটি বই লিখেছেন শ্রীকৃষ্ণ ঘোষ। ঘোষ পুলিশি নির্যাতনের নিন্দা করেছেন। তিনি নিজেও একজন পুলিশ অফিসার। তবে তিনি একটি বিষয় এড়িয়ে গেছেন। তা হলো কেমন করে তথ্য সংগ্রহের নামে এই নির্যাতনের পদ্ধতিটি পুলিশ কার্যক্রমে ঢুকেছে। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুলিশকে দমন-পীড়ন ও অত্যাচার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার পেছনে কারণ বর্ণনা করেছেন ভারতীয় পুলিশ কমিশনের সদস্য এনএস সাকসেনা। তিনি বলেছেন, ‘যত দিন পর্যন্ত সরকার পুলিশকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অনুসন্ধানপ্রক্রিয়া থেকে বিরত রাখবে তত দিন এই অত্যাচার চলবে।’
যেহেতু পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর কোনো হদিস পাওয়া যায় না এবং গোপন থাকে, তাই এই অনৈতিকতার হিসাব নেয়া সম্ভব হয় না বলে তারা মন্তব্য করেছেন। আরব নিউজের গাজালী বলেছেন, সমাজের কোনো অংশকে যখন রাজনৈতিক শক্তিগুলো একঘরে করে ক্ষমতারোহণ এবং পোক্ত করার জন্য, তখন তাদের পুলিশের ওপর ভর করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এ জন্যই চলে দমন, পীড়ন ও অত্যাচার; যেন জনগণ কোনো ক্রমেই প্রতিবাদ না করতে পারে অথবা ঐক্যবদ্ধ না হতে পারে। এ কাজটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র অথচ ক্ষমতাধর গোষ্ঠী।
ড. জন ডাবলু হোয়াইট হেড তার চমৎকার নিবন্ধ ‘পুলিশ ফর প্রফিটিং’ এ লিখেছেন, পুলিশকে সুবিধা ও সুযোগ না দিয়ে ক্ষমতাবানদের আর কোনো পথ ছিল না। কারণ তাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-নিরাপত্তা পুলিশ দেয়। পুলিশের জন্ম হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে ক্ষমতাবানদের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে নয় বলে তিনি উদাহরণ দিয়ে মন্তব্য করেছেন।
আরো চমৎকার মন্তব্য করেছেন বিখ্যাত লেখক, ঐতিহাসিক এইএল মেনকেন। তিনি এক পরম সত্য উচ্চারণ করেছেন, Laws are no longer made by a rational process of public discussion; they are made by a process of blackmail and intimidation, and they are executed in the same manner. The typical lawmaker of today is a man wholly devoid of principle- a mere counter in a grotesque and Knavish game. If the right pressure could be applied to him, he would be cheerfully in favour of polygamy, astrology or cannibalism. It is the aim of the Bill of Rights, if it has any remaining aim, to curb such prehensile gentry. Its function is to set limitation upon their power to harry and oppress us to their private profit."
উদ্ধৃতিটি ইচ্ছে করেই পুরোটা দেয়া হলো। কারণ লেখক মেঙ্কেন তার নিজের সময়ের চিত্রই তুলে ধরেছেন তা নয়, আজকের চিত্রও এখানে উঠে এসেছে। এখানে দখল-লাভ-ক্ষমতার যে কর্মকাণ্ডের কথা হয়েছে এখন তা সারা বিশ্বে সাধারণ বিষয়। তিনি মার্কিনি বিল অব রাইটসের সমালোচনা করে বলেছেন, জনগণকে ক্ষমতা দেয়ার নাম করে সেখানেও তা সীমিত করা হয়েছে। ঠিক একই চিত্র পাওয়া যায় বিশ্বের সব দেশের বেশির ভাগ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে।
তিনি পুলিশ কর্মকাণ্ডের একটা নমুনা দিয়েছেন। পুলিশ প্রায়ই অবৈধ বিষয় উদ্ধার করে থাকে। ওয়াশিংটন পোস্ট ২০১৪ এক রিপোর্ট দিয়ে বলেছে, এ অবৈধ বিষয়ের মধ্যে আছে গাড়ি-বাড়ি। সে বছর তারা পাঁচ বিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি দখল করে। কিন্তু সে বছর চুরির পরিমাণ ছিল ৩.৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ চোর জনগণের পকেট থেকে পুলিশের চেয়ে কম নিতে পেরেছে বলে ওয়াশিংটন পোস্ট মন্তব্য করেছে।
ড. হোয়াইট হেড পুলিশি প্রক্রিয়ার একটা চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। ‘তারা একটা নকশা তৈরি করে, তারপর লক্ষ্য ঠিক করে এর মাঝে কাদের অন্তর্ভুক্ত করবে এবং কোথায় তাদের ধরবে- কোন ট্রাফিক স্টপে, ট্রেনে, বিমানবন্দরে নাকি কোনো বাড়িতে। এসব লোক সাধারণত অনেক টাকা নিয়ে ঘোরাফেরা করে অথবা এদের সাথে থাকে মূল্যবান বস্তু। সাধারণত কোর্ট ও আইনও তাদের সহায়তা দেয়। পুলিশ তখন এ অর্থ বা মূল্যবান জিনিস (নগদ টাকা, অলঙ্কার, গাড়ি, বাড়ি ইত্যাদি) অবৈধ বলে সিজ করে এবং এর মালিককে মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়।’ ড. হোয়াইট হেড (প্রেসিডেন্ট রাদারফোর্ড ইনস্টিটিউট) তার বই ‘ব্যাটলফিল্ড আমেরিকাতে’ এ ঘটনাগুলো উল্লেখ করছেন সে দেশের জন্য। কিন্তু এটা আজকের দুনিয়ার একটা চমৎকার সঠিক সাধারণ চিত্র। তার সাথে যোগ দিয়েছেন ফিলিপ গিরাল্ডি। তিনি বলেছেন, ‘সর্বত্র পুলিশকে মিলিটারি হিসেবে সজ্জিত করা হচ্ছে। কেন? জনগণের কাছে তো কোনো অস্ত্র নেই।’
এভাবেই দমন-পীড়ন-অত্যাচারের কর্মকাণ্ড চলছে বিশ্বব্যাপী নিরঙ্কুশ। তা প্রবেশ করেছে ব্যক্তিজীবনেও। একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাক। এক হরিজন স্কুলের হেড মাস্টার তার এক ছাত্রকে তার জন্য এক গ্লাস পানি আনতে বললেন। ছাত্রটি তার পাশের ছাত্রকে তা আনার জন্য অনুরোধ করল। তখন শিক্ষক তা দেখতে পেয়ে কারণ জিজ্ঞেস করেন? ছাত্রটি বলল, স্যার, আমি তো অচ্ছুত। আমার স্পর্শের পানি কি আপনি খাবেন? এটা পীড়নের নমুনা। সমাজে এমন ছোট্ট ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে চলছে দমন-পীড়ন-অত্যাচারের অবাধ রাজত্ব। রাষ্ট্রীয় ও গোষ্ঠীগত অবস্থা না হয় বাদই দেয়া গেল। অসহায় জনগণ তা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে, কারণ যারা প্রতিবাদ করার নেতৃত্ব দেবে বা সংগঠন করবে তাদের প্রথমেই শান্ত করে ক্ষমতাবানেরা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন