মশিউল আলম
গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধান লক্ষ্য দারিদ্র্যবিমোচন। আর দুর্নীতি থাকলে দারিদ্র্যবিমোচন হবে না। তাই সরকার জোরালো, সাহসী ও সৎ সাংবাদিকতা চায়।
সাধারণভাবে এ ধরনের বক্তব্য সাংবাদিকদের জন্য প্রীতিকর ও উৎসাহব্যঞ্জক হওয়ার কথা, কিন্তু বাংলাদেশে এখন এটা পরিহাসের মতো শোনাতে পারে। কারণ, অনেকের মতে, এ দেশে জোরালো, সাহসী ও সৎ সাংবাদিকতা করার অনুকূল পরিবেশ নেই। একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। একধরনের আড়ষ্টতা, দ্বিধা, সংকোচ কাজ করছে সাংবাদিকদের মনে। জনপ্রিয় এক সহকর্মীকে বলতে শুনি: ‘মন খুলে লিখতে পারি না।’
প্রশ্ন উঠতে পারে: কিসের ভয়? সাংবাদিকদের ভয় দেখাচ্ছে কে?
এই প্রশ্নের উত্তরও মন খুলে দেওয়ার সাহস নেই। আমরা এমনই এক ভয়ের মধ্যে আছি যে ‘আমরা ভীত’—এই কথাটা বলতেও পারছি না।
কিন্তু কেন? কী করে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হলো যে সাংবাদিকেরা এমন আড়ষ্টতা, দ্বিধা, সংকোচ ও ভয়ের সঙ্গে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন? গওহর রিজভীর সেদিনের বক্তব্যের মধ্যেই এই প্রশ্নের একটা উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, ‘দেশের জন্য সাংবাদিকদের অবদান যদি কেউ না বোঝে, তাহলে তা হবে দুঃখজনক।’ অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন, সাংবাদিকদের অবদান বোঝার ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে।
কার বোঝার ক্ষেত্রে? কে সাংবাদিকদের অবদান বুঝতে পারছে না?
গওহর রিজভীর ইঙ্গিতটা যদি সরকারের প্রতি হয়ে থাকে, তাহলে ‘সরকার জোরালো, সাহসী ও সৎ সাংবাদিকতা চায়’—তাঁর এই বক্তব্যের সদর্থ থাকে না।
২.
আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের ২০১৭ সালের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স রিপোর্ট অনুযায়ী, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ভোগের দিক থেকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬। অর্থাৎ, ১৪৫টি দেশ আমাদের ওপরে আছে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আমাদের অবস্থান সবচেয়ে নিচে: ভুটান ৮৪, নেপাল ১০০, ভারত ১৩৬ ও পাকিস্তান ১৩৯ নম্বরে আছে।
শুধু তা-ই নয়, গত এক বছরে আমরা আরও দুই ধাপ নেমে গেছি। ২০১৬ সালে আমাদের অবস্থান ছিল ১৪৪। এর কারণ হিসেবে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তার সমালোচনাকারী ও সাধারণভাবে সংবাদমাধ্যমের ব্যাপারে আরও শক্ত অবস্থান নিয়েছে। এই শক্ত অবস্থান পরিষ্কার হয়েছে সংবাদমাধ্যমের প্রতি বৈরী সরকারি বক্তব্য (অফিশিয়াল স্টেটমেন্টস এক্সপ্রেসিং হোস্টিলিটি টুওয়ার্ডস মিডিয়া), কয়েক ডজন ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেওয়া, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রচুর মামলা দায়ের করা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে বিটিআরসি দেশের ৩৫টি নিউজ ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়েছে। সংবাদমাধ্যমের প্রতি সরকারি কর্তৃপক্ষগুলোর বৈরী বক্তব্য ও পদক্ষেপ বাড়লে সংবাদপ্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিকদের মধ্যে সেল্ফ সেন্সরশিপ বা আত্মনিবৃত্তির প্রবণতা বাড়ে। এ কারণেও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে আমরা গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ নিচে নেমে গেছি।
ভারত-পাকিস্তানের মতো আমাদের দেশে প্রতিবছর দু-চারজন করে সাংবাদিক খুন হচ্ছেন না বটে, কিন্তু তাই বলে আমরা মুক্তমনে স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করতে পারছি—এ কথা বলার উপায় নেই। এ দেশে সাংবাদিকদের মেরে হাত-পা ভেঙে দেওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে, প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। একই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে একযোগে ষাট-সত্তরটা মামলা দায়ের করার মতো ঘটনাও এ দেশে ঘটে বৈকি। দৃষ্টান্ত ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর সম্পাদক নঈম নিজাম প্রমুখ। এ ছাড়া বিভিন্ন সংবাদপ্রতিষ্ঠানের অনেক জেলা প্রতিনিধির বিরুদ্ধে হয়রানির উদ্দেশ্যে মিথ্যা অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়।
এ ছাড়া প্রত্যেক সচেতন ও স্বাধীনচেতা নাগরিকের মতো সাংবাদিকদের মাথার ওপরও অদৃশ্য খাঁড়ার মতো ঝুলে রয়েছে ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়ার ভয়।
খুন কিংবা গুম হওয়ার ভয়, শারীরিকভাবে আক্রান্ত হওয়ার ভয়, মামলার হয়রানি বা গ্রেপ্তার হওয়ার ঝুঁকি ইত্যাদি ছাড়াও সাংবাদিকদের জন্য অনেক রকমের ভয়ের ব্যাপার আছে। কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়ার ভয় স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে এক বড় বাধা। আমাদের দেশে এখন এই ভয় কাজ করছে। কারণ, সরকারি কর্তৃপক্ষ ভিন্নমত ও সমালোচনার ব্যাপারে কিছুটা অসহিষ্ণু।
শুধু সাংবাদিকতায় নয়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সব ধরনের বিরুদ্ধমত ইতিমধ্যে কোণঠাসা; প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল প্রবল সরকারি দমন-পীড়নের শিকার। ছাত্র-যুবসমাজ কোনো ইস্যুতে রাস্তায় নামলে নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছে। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ও নাগরিক সমাজ সরকারি কর্তৃপক্ষগুলোর ভুল-ত্রুটির সমালোচনার ব্যাপারে অতি নিম্নকণ্ঠ। আর সাংবাদিক সমাজের একটা অংশ সরকারের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে এবং অনুগ্রহ লাভের আশায় সরকারের প্রশংসা করার সুযোগ ও উপলক্ষ খোঁজে। এটা বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়, প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের সময়; অধিকাংশ সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করার পরিবর্তে তাঁর সুনজর আকর্ষণের চেষ্টা করেন। সরকারও সাংবাদিকদের এই অংশকে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে নানাভাবে প্রভাবিত করে।
৩.
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার বিধান স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে এক বিরাট আইনি বাধা হিসেবে কাজ করছে এক দশক ধরে। বাংলাদেশে ইন্টারনেট মাধ্যমে সাংবাদিকতা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হয়ে উঠেছে এই ধারার কারণে। এই ধারায় বিচার্য অপরাধগুলো সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত নয় বলে এর ব্যাপক বিস্তৃত ব্যাখ্যা সম্ভব এবং সে কারণেই এ পর্যন্ত এই ধারার ব্যবহারের ঘটনাগুলোর অধিকাংশই অপব্যবহার বলে মনে করা হয়। এ ছাড়া ৫৭ ধারায় মামলা হলে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার এবং জামিন না পাওয়ার আশঙ্কা আছে। আর বিচারে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ন্যূনতম সাজা ৭ বছরের কারাদণ্ড, অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড। এই রকমের একটা মারাত্মক কালাকানুন যে দেশে আছে, সেখানে ইন্টারনেটভিত্তিক সাংবাদিকতায় স্বাধীনতা চর্চার সুযোগ থাকতে পারে না। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই ১৯ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন স্থানীয় মন্ত্রী-সাংসদদের ঘনিষ্ঠজনেরা।
৫৭ ধারা শুধু সাংবাদিকদের জন্য নয়, দেশের সব নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য। ফলে শুধু পেশাদার সাংবাদিকতা নয়, এই বিধান ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও স্বাধীন মতামত প্রকাশের পথ সংকুচিত করেছে। সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে, ৫৭ ধারার অধীনে বিচার্য অপরাধগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামের এক নতুন আইনে সন্নিবেশিত করা হবে এবং নতুন আইনটি চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ৫৭ ধারা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু বিষয়টা মোটেও স্বস্তিদায়ক হবে না, যদি নতুন আইনে ওই সব অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়ার বিধান (আমলযোগ্য, জামিনের অযোগ্য) বদলানো না হয় এবং দণ্ডের মাত্রা (ন্যূনতম ৭ বছর, অনধিক ১৪ বছর) কমানো না হয়।
৪.
বাংলাদেশে এখন ২৩টি বেসরকারি টেলিভিশন স্টেশন চলছে। কিন্তু সম্প্রচারমাধ্যমের জন্য কোনো আইন নেই। আইন নেই মানে এই মাধ্যমের কোনো আইনি সুরক্ষা নেই। এটা চলছে সরকারের মর্জিমাফিক। সরকারি কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলেই যেকোনো সময় যেকোনো টিভি স্টেশনের সম্প্রচার বন্ধ করে দিতে পারে। এটা টিভি সাংবাদিকতার স্বাধীনতার পথে কত বড় মানসিক অন্তরায়, তা বলাই বাহুল্য।
অনেক দাবিদাওয়া উচ্চারণের পর গত বছর সম্প্রচার আইনের এখটা খসড়া তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সেটাতে সম্প্রচার সাংবাদিকতার জন্য প্রতিকূল হতে পারে এমন কিছু বিধান আছে বলে সম্প্রচারমাধ্যমের সাংবাদিকেরা অভিযোগ করেন। আইনের খসড়াটি করা হয়েছে সম্প্রচারমাধ্যমকে সুরক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমাদের টিভি সাংবাদিকদের সাহসী হওয়ার সুযোগ নেই। এমনকি টিভি টক শোগুলোতে সাহসী কথাবার্তা বলার মতো লোকজনও এখন কমে গেছেন। অভিযোগ আছে, টক শোর কিছু বক্তাকে আর না ডাকার জন্য সংশ্লিষ্ট টিভি স্টেশনকে বলে দেওয়া হয়।
৫.
শারীরিক আঘাত বা আঘাতের হুমকি, প্রতিকূল আইন, ক্ষমতাসীনদের প্রকাশ্য অসহিষ্ণুতা ইত্যাদি মিলিয়ে সাংবাদিকদের মনে যে ফিয়ার অব পারসিকিউশন বা নির্যাতনের ভীতি সৃষ্টি করে, তা এখনকার বাংলাদেশের সাংবাদিকতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। সত্য তথ্য ও স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য সাংবাদিক বা সংবাদপ্রতিষ্ঠান যে নির্যাতনের মুখোমুখি হতে পারে, তার নানান রূপ আছে। বাংলাদেশে এর এমন চূড়ান্ত ও অকল্পনীয় রূপও দেখা যায়, যখন কোনো নির্দিষ্ট সংবাদপ্রতিষ্ঠানের ওপর রুষ্ট হয়ে তার সরকারি ও বেসরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়ার পথগুলো বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা চলে।
৬.
গণতন্ত্র ও জনস্বার্থের সঙ্গে ক্ষমতাসীন সরকারের স্বার্থের বোধ সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে দেশের জন্য সাংবাদিকদের অবদান বোঝা সেই সরকারের পক্ষে সম্ভব হয় না এবং তা হয় না বলেই দুঃখজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে সরকার ‘জোরালো, সাহসী ও সৎ সাংবাদিকতা’ চাইতে পারে না। বরং সত্য খবর ও স্বাধীন মত প্রকাশের পথগুলো বন্ধ করে দেওয়ার নানা কায়দা-কানুন করে।
কিন্তু সরকার কেমন সাংবাদিকতা চায় বা চায় না, তার ওপর সংবাদমাধ্যমের আচরণ নির্ভর করে না। স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করার সব সরকারি প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বশীল অংশ গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও জনস্বার্থে কাজ করার চেষ্টা
করে চলে।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন