মিনা ফারাহ
অহিংসা পরম ধর্মের জনক গৌতম বুদ্ধই যখন পারলেন না, যিশু পারবেন কেন? ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি পোপ উচ্চারণ করলেন কি করলেন না, তা একেবারেই মূল্যহীন। বুদ্ধের শিক্ষার ওপর রক্ত ঢেলে দিয়ে এবং শান্তির নোবেল পেয়েও গণহত্যার প্রমাণ রেখে- প্রকৃত অর্থেই যুদ্ধাপরাধের খাতায় নাম লেখালেন সু চি। ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ঢাকায় উচ্চারণের পরেই পোপের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে গেরুয়া ভিক্ষু এবং সাধারণ বর্মিরা। তাদের দাবি, রোহিঙ্গাদের ফেরত আসতে দেবে না। ভেবেছিলাম, এ বিষয়ে আর লিখব না, কিন্তু দ্বিপক্ষীয় স্মারকের পর লিখতেই হলো। স্মারকটি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যেন ‘দ্বিপক্ষীয় ষড়যন্ত্র’, প্রকৃত অর্থেই যা- ভিকটিমদের মৌলিক অধিকার ফেরত পাওয়ার সব দরজা বন্ধ করে দিলো। এর কিছুই মানতে বাধ্য নয় মিয়ানমার। এইচআরডব্লিউ এর নাম দিয়েছে- স্টান্ট অর্থাৎ ভাঁওতাবাজি (যুগান্তর, ২৫ নভেম্বর)।
জমিজমা কেড়ে নিয়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য করে, প্রাথমিকভাবে ‘অস্থায়ী আশ্রয়শিবিরে’ রাখার নামে আসলেই ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের’ আদলে ব্যবস্থা এসব। রাখাইনে এখনো যাদেরকে ঘিরে রেখে ভাতে ও পানিতে মারছে, বাংলাদেশ থেকে ফেরত নিয়ে সে রকমই কিছু করবে। কারণ স্মারক থেকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ বাদ পড়েছে। স্মারকের চিফ আর্কিটেক্ট চীন এভাবেই আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ থামিয়ে দিলো। কারণ প্রতিটি মুহূর্তেই তারা আন্তর্জাতিক মহলের চোখে হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছিল। লাখ লাখ শরণার্থীকে ঢুকতে দেয়ার আগে দেশের বৈধ বিরোধী দলসহ সাধারণ মানুষ, কারো সঙ্গেই আলোচনা না করে, একাই সর্বনাশা সিদ্ধান্ত নিলো আওয়ামী লীগ! একটার পর একটা ভুল করবে তারা আর মাশুল দিতে থাকবে সাধারণ মানুষ?
সবাই জানে, আরাকানের ভূমি দখলই রোহিঙ্গা ক্রাইসিসের মূলে, যার অন্যতম পক্ষ বাংলাদেশও। চীন বলেছে, ‘মিয়ানমারের উন্নতির সঙ্গে বাংলাদেশও জড়িত।’ অথচ মিয়ানমারের বিপুল খনিজ ভাণ্ডার এবং এশিয়াজুড়ে কানেকটিভিটির লাভের অঙ্কই লাখ লাখ রোহিঙ্গার বাস্তুহারা করার মূলে। ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে আছে চীন, রাশিয়া, ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য যারা জাতিসঙ্ঘে ভেটো দেয় কিংবা নিরপেক্ষ থাকে। আবার বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদেরকে স্থায়ী করতে সব রকমের সাহায্য দিচ্ছে। থেমে নেই ত্রাণের নামে মায়াকান্না।
বাংলাদেশের কাছ থেকে ভারতকে দূরে রাখতে মরিয়া চীন এবং ‘ভাইস-ভার্সা’। আবার রোহিঙ্গা প্রশ্নে মোদি-পুতিন-চীন সবাই এক। সু চির মেগা উন্নয়নের খাতায়, রোহিঙ্গা বিতাড়নে তিন প্রভাবশালীর অবস্থানও অভিন্ন।
রোহিঙ্গা ক্রাইসিস বহু পুরনো হলেও কোনো সরকারই মিয়ানমারের সঙ্গে পেরে ওঠেনি, কিংবা সে রকম চেষ্টাও দৃশ্যমান নয়। এই দফায় যা ঘটল, অতীতের কোনো সরকারই এত বড় ভুল করেনি, বরং কিছুসংখ্যক ফেরত দিয়েছিল। এই দফায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা ঢুকিয়ে এখন দুয়ারে-দুয়ারে ধরনা দেয়া হচ্ছে, ‘বাঁচাও...বাঁচাও!’ কথায় বলে, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।’ রোহিঙ্গা গলায় ঠেকে মরার দশার জন্য দায়ী হাইকমান্ড একা।
সন্দেহ হয়, কারো অদৃশ্য ইশারায় বর্ডার খুলে দিতে বাধ্য হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে, ওদের ভরণপোষণের স্থায়ী ব্যবস্থা করতে সবধরনের সাহায্য অব্যাহত। এ জন্য অনেকটা দায়ী ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’- পররাষ্ট্রনীতি, যা একবিংশ শতাব্দীতে অচল। চুক্তি করেও বিপুলসংখ্যক বিহারিকে ফেরত দিতে না পারা এর অন্যতম উদাহরণ। সুতরাং সংশোধনের সময় এখনই। গণহত্যাকারীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর বদলে, তাদের সঙ্গে স্মারকে সই দিতে হলো- এটা ষড়যন্ত্রেরই অংশ। এভাবেই বন্ধ হয়ে গেল মৌলিক অধিকার ফেরত দেয়া এবং প্রত্যাবর্তনের সব সম্ভাবনা।
‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিকেই মুছে ফেলতে ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ নাম দিয়েছেন সু চি। তার দাবি, ওরা সবাই বাঙালি। তাকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট বন্ধুরা। যে ক’টি দেশ জাতিসঙ্ঘে বিভীষণের ভূমিকায়, প্রত্যেকেরই অঢেল ভূমি। রোহিঙ্গারা হেঁটে সুদূর সৌদি আরব বা তুরস্কে যেতে পারবে না। তাহলে যাবে কোথায়?
বাস্তবতা এই রকম। চীন ও ভারতের বিশাল ভূখণ্ড এবং এরাও মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ। জনশূন্য দণ্ডকারণ্যে ভারত নিতে পারত তিন লাখ। রাশিয়ার অনুন্নত শোচিতে দুই লাখ। চীনের কুনমিংয়ে দুই লাখ। নেপাল-ভুটান-শ্রীলঙ্কা মিলে তিন লাখ। নেগেটিভ পপুলেশন জাপানে চার লাখ। তাহলে এই সমস্যা শেষ। কারণ প্রত্যেকেই জানে, পৃথিবীতে বাংলাদেশই সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ এবং এখানে পাহাড়ে এভাবে অবস্থান একেবারেই অবাস্তব, যা একমাত্র সিনেমাতেই সম্ভব। সিরিয়া ক্রাইসিসের সময় ইউরোপ কি শরণার্থী ভাগাভাগি করেনি? বন্ধু হলে তারাও তো কিছু রোহিঙ্গা নিয়ে স্বস্তি দিতে পারত বাংলাদেশকে, নয় কি? হয়তো বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থীশিবির হতে চলেছে বাংলাদেশ। এখানেই ৫ জানুয়ারির সরকারের উন্নয়ন এবং ক্ষমতার তেলেসমাতি, যা সু চিরও মেগা উন্নতির তেলেসমাতি।’ ২৫ ভাগ গণতন্ত্রের অজুহাতে ৭৫ ভাগ ক্ষমতা হন্তাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে গৌতমবুদ্ধের আদর্শের সর্বনাশ করলেন সু চি!
এই সুযোগে বিরাট মানবাধিকারের ধ্বজা ধরেছে আওয়ামী লীগ। মানবতার ভূয়সী প্রশংসায় যারাই পঞ্চমুখ, কিছু রোহিঙ্গা নেয়ার বদলে তারাই স্থায়ী ক্যাম্পের মসলা দিচ্ছে। এমনিতেই ঢাকায় ড্রেনের অবস্থা খারাপ। অল্প বৃষ্টিতেই নৌকা চলে। অথচ এক দিনেই গণভবনে চার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মায়াকান্নায় যেন ভেসে গেল ঢাকা শহর। আন্তর্জাতিক হেভিওয়েটদের চোখে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার এক চুল সুযোগও নষ্ট করা হয়নি। একটি নোবেলের প্রত্যাশায় এত চরম মূল্য গরিব দেশের জন্য বোঝা। সন্ধ্যা হলেই শরণার্থীশিবিরে যা চলছে, বলার নয়। প্রতি হাজারে আটজনের এইডস। মলমূত্রের ভাগাড়ে বসবাস ছাড়া উপায় নেই। নোবেলের জন্য লবিং কোন পর্যায়ে সেটাও অনুমেয়। এমনকি ১৬ কোটি টাকার প্লাস্টিকের পুতুল এনে টেপরেকর্ডার সেঁটে দিয়ে যা বলানো হলো- সিনেমার জন্য চলে।
আসল কথা, ভোটে নির্বাচিত না হলে জনগণের কাছে জবাবদিহিতা থাকে না। এ কারণেই নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রয়োজন আরো বেড়ে গেল। বিডিআর থেকে রোহিঙ্গা, সব ক্রাইসিস মুহূর্তেই হজম। অন্যথায়, সিনহার মতো ক্রাইসিস হজম করা কি সম্ভব?
২
জাতিসঙ্ঘ বলছে, ‘এটি জাতিগত নিধনযজ্ঞের পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ।’ রোহিঙ্গারা বলছে, অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ফেরত যেতে চাই না, বরং এ দেশের মানবেতর জীবনই নিরাপদ। ওদের অনেকেই ক্যাম্প ছেড়ে মেইনস্ট্রিমে ঢুকে পড়ছে। সাময়িক কষ্টের পর ভবিষ্যতের আলো দেখছে। এটাই স্বাভাবিক। দ্বিপক্ষীয় স্মারকে জমিজমা ঘরবাড়ির হদিস নেই। নেই কোনো কমিটমেন্ট। সবচেয়ে বড় অশনি সঙ্কেত, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিরুদ্ধে জাতি ঐক্যবদ্ধ। কারণ ফেরত গেলেই বিপদ।
যৌথ প্রেস কনফারেন্স ছাড়াই সমঝোতা স্মারক সই! দেশে ফিরে প্রেস কনফারেন্সের বেশির ভাগ প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারেননি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। স্মারকের পরও রোহিঙ্গারা কেন আসছে, জবাব তার কাছে থাকা কি উচিত নয়? লাখ লাখ রোহিঙ্গার দীর্ঘমেয়াদি ভরণপোষণের খরচ কারা দিচ্ছে এবং কেন? চীন-ভারত কেন মিয়ানমারের জন্য সব কিছুই করে দিতে চায় (দ্রষ্টব্য : মানবজমিন, ২৭ নভেম্বর)- হিসাব মিলছে না।
স্মারক অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের ১. নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে; ২. যারা ফেরত যেতে চাইবে না তাদের ফেরত নেবে না; ৩. আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, জাতিসঙ্ঘকে বাইরে রাখা।
নিউ ইয়র্কস্থ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ‘এই চুক্তি একটি স্ট্যান্ট (যুগান্তর, ২৫ নভেম্বর)। রোহিঙ্গাদের ভস্ম হয়ে যাওয়া গ্রামে জায়গা পাওয়া হাস্যকর। জমিজমা, বাড়িঘর ফেরতের গ্যারান্টি দেখতে চায় এইচআরডব্লিউ।’ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ছাড়া কোনো প্রত্যাবর্তন হবে না বলে দাবি শরণার্থীবিষয়ক পরিচালক বিল ফ্লেকিকের।
যারা ভেটো দিচ্ছে, তারাই কেন মিয়ানমারে বাড়িঘর নির্মাণ করে দিতে চায়। এর একটি অর্থবহ উত্তর জানা খুব প্রয়োজন। এ দিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য, তিনি ভারত ও চীনের সঙ্গে বাড়িঘর নির্মাণের বিষয়ে যোগাযোগ করেছেন। ‘অস্থায়ী ক্যাম্প’ অথবা ‘আশ্রয়স্থল’ যে নামেই ডাকুক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জার্মানিতে ওদের ফেরত পাঠাতে চান? আসলেই যা প্রয়োজন, বক্তব্য থেকে সেটাই মাইনাস। অর্থাৎ বন্ধুরাষ্ট্রগুলোতে গিয়ে সশরীরে হাইকমান্ডের প্রতিবাদ।
আন্তর্জাতিক জনমত আদায় এবং পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সফল না ব্যর্থ, উত্তর দ্বিপক্ষীয় স্মারকে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এটা করে সর্বনাশ ঘটাল বাংলাদেশ।
৩
গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানেন, মিয়ানমারে গণহত্যা আর এথনিক ক্লিনজিং দুটোই হচ্ছে এবং এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের অবস্থান কী! জাতিসঙ্ঘ এটাকে বলছে, ‘জাতিগত নিধনের পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ।’ বিভিন্ন দেশের গণহত্যার উদাহরণ দিয়ে নিন্দাও করেন। কম্বোডিয়া থেকে ফিরে দেশের গণহত্যার সঙ্গে ’৭১ কে জড়িয়ে অনেক কথাই বললেন সংবাদ সম্মেলনে। সাংবাদিকরা কেউ আজঅবধি জানতে চাইল না, ‘গণহত্যা’ শব্দটি আন্তর্জাতিক মহল বললেও ঢাকা কেন উচ্চারণ করছে না? বরং সু চিকে অসহায় প্রমাণের চেষ্টা কেন! হিটলার-পলপট-ইয়াহিয়া-মিলোসেভিচ গণহত্যা করলে, সু চি এবং তার দেশের হন্তারাও করেছে। বর্মিদের যুদ্ধাপরাধের সব তথ্যপ্রমাণই আন্তর্জাতিক মহলের হাতে। একই রকম বক্তব্য এখানেও কাম্য নয় কি?
চীনের উদ্ভট তিন প্রস্তাব (নয়া দিগন্ত, ২০ নভেম্বর)। ১. অস্ত্রবিরতি কার্যকর করা; ২. প্রথম পর্ব সফল হওয়ার পর প্রত্যাবর্তনের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার আলোচনায় বসা; ৩. দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে রাখাইনের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান।
প্রতিটি প্রস্তাবই রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশে তাদের স্থায়ী করার পক্ষে। কারণ, ওদের নাগরিকত্ব প্রমাণ একেবারেই অসম্ভব করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ ‘আরসা’র প্রশ্ন তুললেও উল্লেখযোগ্য কিছু বলেনি আন্তর্জাতিক মহল। অস্ত্রবিরতি কখন হলো? বর্মি সৈন্যদের সঙ্গে আরসা’র কি আফগানিস্তান বা নাইজারের মতো যুদ্ধ চলছে? তাহলে সেটা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রচার করত। বরঞ্চ বর্মি সৈন্যরাই যুদ্ধাপরাধের পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ তৈরি করেছে। আরসা’র অজুহাতÑ আইওয়াশ নাকি বাস্তবতা, দ্বিপক্ষীয় স্মারকে স্পষ্ট। দারিদ্র্য বিমোচনের নামে যা বলছেন সু চি, সেটাই খনিজসম্পদ এবং কানেকটিভিটি আদায়ে রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগে বাধ্য করা। সু চির দাবি, অবৈধ অভিবাসীরা নাকি পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে; সঙ্ঘাত, সামাজিক শান্তি নষ্ট করছে। এর পরিণতি হচ্ছে অনুন্নয়ন ও দারিদ্র্য।’ সু চির মুখের ভাষায় গৌতমবুদ্ধ নিশ্চয়ই কষ্ট পাচ্ছেন!
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্র“প একই সন্দেহের পুনরাবৃত্তি করেছে (মানবজমিন, ৮ ডিসেম্বর)। তাদের ভাষায়, চুক্তি অনুযায়ী খুব কমসংখ্যক রোহিঙ্গা ফেরত যেতে পারবে। প্রতিদিন ৩০০ রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের তদারকি করা হবে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা যে এলাকাকে গ্রাস করেছে, সেখানে তারা ফেরত যেতে চান কি না। ক’জন রোহিঙ্গা নিজেদের বৈধতা প্রমাণ করতে পারবে? আর এখানে এসে ‘মধ্যস্থতাকারী’র ভূমিকায় অবতীর্ণ মিয়ানমারের বন্ধু চীন! ক্রাইসিস গ্রুপের ভাষায়, আমেরিকা যখন টার্গেট করা অবরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক তখনই এই চুক্তি।
৪
বসনিয়া গণহত্যার সমান্তরালে তুলনাটি হুবহু। হেগের আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনালের বিচারক তার রায়ে লিখেছেন, ‘বসনিয়ার মুসলিমদেরকে নিশ্চিহ্ন করতেই সার্ব সৈন্যরা গণহত্যায় লিপ্ত হয়েছিল। তাদের টার্গেট ছিল ৪০ হাজার মুসলিম। সৈন্যরা আট হাজার পুরুষ আলাদা করে, পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। নারীদের ধর্ষণ করেছে। একমাত্র কারণ তাদের আইডেনটিটি।’
বসনিয়া ম্যাসাকারের সাথে তুলনা করলে রোহিঙ্গা ম্যাসাকারের আকার ও পরিধি বিশাল। নৃশংসতাও বিশাল। বসনিয়ায় বাস্তুহারা প্রায় দুই লাখ এবং গণহত্যার শিকার প্রায় ৩০ হাজার। রোহিঙ্গাদের বেলায় কত? গৃহযুদ্ধ চলাকালে জাতিসঙ্ঘের বানানো ‘সেইফ জোনে’ ঢুকে ১৯৯৫ সালের ১১ জুলাইতে উদ্বাস্তুদের ওপর গুলি চালিয়ে গণহত্যা করেছিল সার্ব সৈন্যরা। বর্মিদের মতোই সার্ব সৈন্যদেরও উদ্দেশ্য, ‘মুসলিমমুক্ত বৃহৎ সার্বিয়া।’ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ন্যাটো, জাতিসঙ্ঘ, আমেরিকা মিলে বিশেষ অধিবেশন শেষে যুদ্ধের নিয়মনীতি শিথিল করে, বসনিয়ায় টার্গেট করা বিমান হামলা শুরু করলে ২৩ সেপ্টেম্বরে সমাপ্তি। পালাতে শুরু করে সার্ব সৈন্যরা। ওহাইওর ডেটনে শান্তিচুক্তি শেষে জাতিসঙ্ঘের ৬০ হাজার সৈন্য পাহারা ছিল বসনিয়ায়। ওই যুদ্ধে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীও ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু মূল টার্গেট ছিল মুসলিমরা। আজ অবধি ৪৫ সার্ব, ১২ ক্রোশিয়ান, চার বসনিয়ান যুদ্ধাপরাধীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। মিলোসেভিচের বিচার শেষ হওয়ার আগেই কারাগারে তার মৃত্যু। বিচারকাজ এখনো চলছে।
হন্তাদের ভ্রমণ নিষিদ্ধ করাই যথেষ্ট নয়। টার্গেট করা অবরোধও তেমন কাজে আসবে না। কারণ তাদের পাশে আছে চীন-রাশিয়া-ভারত-জাপান...। একমাত্র বসনিয়ার মতো দৃষ্টান্তই এই ক্রাইসিস থামিয়ে দিতে পারে। পাঠ্যপুস্তকের উদাহরণের কথা বলে জাতিসঙ্ঘ নিজেই ফেঁসে গেছে। এরপর সু চিসহ হন্তাদের বিচার না করে উপায় নেই।
প্রয়োজন ‘গণহত্যা’ শব্দটিকে গণভবনের তরফ থেকে স্বীকার করে আন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপ কামনা। এভাবেই বসনিয়ার মুসলিমরা তাদের মৌলিক অধিকার ফেরত পেয়েছে। বৈধ বিরোধী দলসহ জনগণেরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকা উচিত। বুদ্ধিজীবীরাও বসনিয়ার রেফারেন্সটিকে কাজে লাগাতে পারেন। বিচার চেয়ে রাষ্ট্রদূতদের কাছে চিঠিও দিতে পারেন। অন্যথায় বিহারিদের মতোই রোহিঙ্গারাও এ দেশেই থেকে যাবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন