গোলাম মোর্তোজা
তাঁর দাদার দাদা যে গ্রামে বিয়ে করেছিলেন, সেই গ্রামে যাওয়ার সরাসরি রাস্তা ছিল না। অনেকটা পথ ঘুরে যাওয়া যেত। তিনি যাবেন সরাসরি। সরাসরি গিয়ে বিয়ে করার জন্যে ১৮ মাইল রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন। ১৮৪০ সালে ছেলের খতনায় ১২ হাজার টাকা খরচ করেছিলেন। এর জন্যে আজমিরিগঞ্জ বাজার বিক্রি করে দিয়েছিলেন। বুঝতেই পারছেন, একটি জমিদার পরিবারের কথা বলছি।
.
এই জমিদার পরিবারের সন্তান ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ফিজিক্সে।কয়েক মাস পর চাচা সায়ীদুল হাসানের পরামর্শে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলেন নেভাল আর্কিটেকচারে। দেড় বছর পর তার মনে হলো, নেভাল আর্কিটেক্ট হলে দেশে ফিরে এই শিক্ষাটা কাজে লাগানো যাবে না। ৪ বছরের কোর্স শেষ না করে, দু’বছরের মাথায় লন্ডনে চলে এলেন। ভর্তি হলেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিংয়ে।
১৯৬২ সালে কোর্স শেষ করলেন। ১৯৫৮ সালে মা মারা যাওয়ায় দেশে ফেরার তাগিদটা কমে গেল। চার্টার্ড অ্যাকাউটেন্ট হিসেবে লন্ডনে চাকরি করলেন কিছুদিন। লন্ডন থেকে চলে গেলেন কানাডা। সেখানে চাকরি করলেন কিছুদিন। তারপর নিউইয়র্কে এসে আরও কিছুদিন চাকরি করলেন।
এক দেশ থেকে আরেক দেশ, অনেক টাকা বেতনের চাকরি। সেসব বাদ দিয়ে ১৯৬৮ সালে দেশে ফিরে এলেন। ‘শেল অয়েল’কোম্পানির হেড অব ফাইনান্স হিসেবে চাকরি করতে শুরু করলেন। দেশে আন্দোলন দানা বাঁধছে।
সত্তরের ঘুর্ণিঝড়ের পর কাজ করতে চলে গেলেন মনপুরায়। ৪ মাস পর শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। টিক্কা খান সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তেল কোম্পানি থেকে লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের অফিসে একজনকে বসানো হবে, এবং তাকেই বসানো হলো। দুই তিন দিন সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের অফিসে বসেই সিদ্ধান্ত নিলেন, ইংল্যান্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রাখবেন। কারণ ইংল্যান্ডে তার পরিচিত জায়গা, অনেক বন্ধু আছেন। ভারতের চেয়ে ইংল্যান্ডে গিয়ে তার পক্ষে কাজ করা সহজ হবে।
কিন্তু ইংল্যান্ড যাওয়া তখন খুব কঠিন। প্রতি পদে পদে বাধা পেরিয়ে ঢাকা থেকে করাচি। করাচি থেকে ইসলামাবাদে গিয়ে আইএসআই’র হাতে আটক। কারণ ‘শেল’থেকে অনুমতি না নিয়ে ঢাকা ছেড়েছিলেন। শেল’র ঢাকা অফিস থেকে আইএসআইকে জানানো হয় যে, তিনি দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন। সেই সময় এটা ছিল সবচেয়ে বেশি বেতনের চাকরিগুলোর একটি। তখন তিনি বেতন পেতেন ৪ হাজার ১০০ টাকা।
আইএসআই অফিসারের বিস্ময় ছিল এত টাকা বেতনের চাকরি থেকে না বলে চলে এসেছ কেন! মুক্তি পেলেন কয়েকদিন পর। লুকিয়ে ইসলামাবাদ থেকে চলে গেলেন ট্যাক্সিতে পেশোয়ার। সেখান থেকে বাসে খাইবার পাস চেকপোস্ট দিয়ে আফগানিস্তান। আরেক বাসে জালালাবাদ। আরেক বাসে কাবুল। ‘কাবুল হোটেলে’ কয়েকদিন থেকে, টেলিগ্রাম করে ইংল্যান্ড থেকে টিকেট আনিয়ে ইস্তানবুল হয়ে লন্ডন। গিয়ে দেখেন তার বন্ধুরা ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’নামে একটি সংগঠন তৈরির চেষ্টা করছেন। সবাই মিলে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’গড়ে তুললেন।
যার কথা বলার জন্যে এত বড় ভূমিকা তিনি ফজলে হাসান আবেদ।এত বড় ভূমিকা দিয়েও তার সম্পর্কে সামান্যই বলা হলো। তার জন্ম ১৯৩৬ সালে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গ্রাম সিলেটের বানিয়াচংয়ে। তিনি গড়ে তুলেছেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এনজিও ব্র্যাক।
০২.
ব্র্যাক প্রসঙ্গে আসার আগে, আরও কিছু কথা বলে নেওয়া দরকার। ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’র ব্যানারে শুধু ইংল্যান্ডে নয় ইউরোপের অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা চালাতে শুরু করলেন। শুধু প্রচারণা নয়, মুক্তিযুদ্ধের জন্যে আর্থিক সহায়তা দরকার। গড়ে তুললেন ‘হেলপ বাংলাদেশ’নামে আরেকটি সংগঠন। ব্যাপক সাড়া পেলেন। ইউরোপের বাঙালিরা তো সহায়তা করার জন্যে এগিয়ে এলেনই, কত বিদেশি যে কত ভাবে সহায়তা করলেন।
ফজলে হাসান আবেদের বান্ধবী ম্যারিয়েটা অসাধারণভাবে সহায়তা করেছেন অর্থ সংগ্রহ এবং প্রচারণার কাজে। সেই সময়ের একটি অভিজ্ঞতা সরাসরি ফজলে হাসান আবেদের মূখ থেকে: ‘একজন ব্রিটিশ মহিলা এক পাউন্ড পাঠিয়ে লিখেছিলেন, আগামী দু’মাস আমি ডিম খাব না। সেই ডিমের টাকাটা আমি তোমাদের দিলাম।এই মহিলার সঙ্গে আমার কোনোদিন দেখা হয় নি।’
মাত্র একটি পাউন্ড! কতটা হৃদয় স্পর্শ করে যায়!! এই ব্রিটিশ নারী নিশ্চয় দেখে গিয়েছিলেন তার দেয়া এক পাউন্ড কাজে লেগেছিল। মুক্তিযাদ্ধারা যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন।
০৩.
বাংলাদেশের মাত্র নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে, কত লক্ষ- কোটি ঘটনা! যার কত কিছু এখনও অজানা।তেমন একটা ঘটনা। ‘হেলপ বাংলাদেশ’নিয়ে কাজ করার সময় ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে লন্ডনে একটি গ্রুপের সঙ্গে পরিচয় হল। যারা ভিয়েতনামের পক্ষে ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ রকম গ্রুপ আছে, যারা চরম প্রতিকূল অবস্থাতেও একটি দেশে গিয়ে ভয়ঙ্কর কোনো ঘটনা ঘটাতে পারে। তারা খুবই সাহসী এবং দক্ষ হয়। নির্ভুল নিশানায় অব্যর্থ আঘাত হানতে পারে তারা। ভিয়েতনামের পক্ষে যুদ্ধ করা গ্রুপটির সঙ্গে আলোচনা চলতে থাকল।
এদের দুজন ইংরেজ এবং একজন অস্ট্রেলিয়ান। মুক্তিযাদ্ধাদের পক্ষ হয়ে নাশকতামূলক তৎপরতা চালাবেন তারা। তাদের সঙ্গে কথা হলো, পাকিস্তানের সমুদ্রবন্দরে বা অন্য কোনো জাহাজে যদি বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো যায় তাহলে বড় একটা কাজ হয়।
এই তিনজন একদিন ফজলে হাসান আবেদের লন্ডনের বাসায় এলেন। বন্ধু ভিকারুল ইসলাম চৌধুরীসহ তাঁদের সঙ্গে আলাপ করলেন। তাঁরা বললেন, ‘আমরা গুজরাট উপকূল থেকে মাছ ধরা ট্রলার নিয়ে করাচি সমুদ্রবন্দরে যাব। সেখানে জাহাজে বোমা পেতে বিস্ফোরণ ঘটাব। এজন্য আমাদেরকে অর্থ দিতে হবে।’
এ কাজটি সম্পন্ন করতে তাদের সঙ্গে ১৬ হাজার ৮০০ পাউন্ডে রফা হল।
কিন্তু এই কাজে এত টাকা খরচ করে করা ঠিক হবে কি না, তা নিয়েও ভাবতে থাকলেন। একবার ভাবলেন, এরকম একটি নাশকতামূলক কাজ করতে পারলে সেটা বেশ চাঞ্চল্যকর ব্যাপার হবে। বিশ্ব প্রচারমাধ্যমে উঠে আসবে বাংলাদেশ। মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি ও সাহসিকতার প্রমাণ হবে। কিন্তু এ ধরনের একটি ব্যয়বহুল কাজ করবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না।
সেপ্টেম্বর মাসে ফজলে হাসান আবেদ এবং ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী কলকাতায় এলেন, প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করার জন্য। কলকাতার থিয়েটার রোডে তাঁর অফিস। সন্ধ্যা সাতটার দিকে তারা তাজউদ্দীন আহমেদের কক্ষে ঢুকলেন।
এরপরের বর্ণনা ফজলে হাসান আবেদের মূখে: ‘প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ একটি চেয়ারে বসে আছেন। পরনে লুঙ্গি-পাঞ্জাবি। তাঁকে আমাদের পরিকল্পনার কথা অবহিত করলাম। বললাম, এর জন্য প্রয়োজনীয় ১৬ হাজার ৮০০ পাউন্ড সংগ্রহ করেছি। শত্রুঘাঁটিতে নাশকতামূলক এই কাজটি করে আমরা বিশ্বকে চমকে দিতে চাই।
মুজিবনগর সরকারের পক্ষে প্রায় সব কাজই তখন করছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন বা তাঁর অন্য কোনো পরামর্শ বা পরিকল্পনা আছে কি না, তা আমরা জানতে চাইছিলাম। এত বড় একটি কাজ প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে না জানিয়ে আমরা করতে চাই নি। আর এই কাজটি যে মুক্তিযোদ্ধারা করছে সেটা জানিয়ে রাখাও একটি উদ্দেশ্য ছিল।
আমাদের সব কথা শুনে তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, দেখুন, এ ধরনের অভিযান সফল হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। তাই এই কাজে এত টাকা ব্যয় করা ঠিক হবে না। আমরা খুবই আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে আছি। একেবারেই চলতে পারছি না। ভারত সরকারের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল আমরা। তারা আমাদের অনেক কিছু দিচ্ছেন, আবার অনেক কিছু দিচ্ছেন না। আপনাদের সংগৃহীত অর্থটা পেলে আমাদের যুদ্ধ আমরা নিজেরাই করতে পারব। ভাড়াটে লোকের প্রয়োজন হবে না।
তাজউদ্দীন আহমদকে সেদিন একজন নিরহঙ্কর, অমায়িক এবং আদর্শবান রাজনৈতিক নেতা হিসেবে মনে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রাণপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে তিনি আমাদের সকলের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠকের দায়িত্বপালন করেছিলেন।
০৪.
বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনা বাদ দিলেন। কোলকাতায় তাদের দেখা হলো প্রগতিশীল ছাত্রনেতা রাশেদ খান মেননের সঙ্গে। আসন্ন শীতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে ৬ হাজার সোয়েটারের প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন মেনন। সেই টাকার কিছু দিয়ে সোয়েটার কিনে দিলেন। দেখা হলো মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে। তিনি বললেন, যুদ্ধের জন্যে দূরবিন খুব উপকারী। কিন্তু আমাদের কোনও দূরবিন নেই। দূর থেকে শত্রুর অবস্থান বুঝতে পারি না।
ভিকারুল ইসলাম চৌধুরীকে কোলকাতায় রেখে ফজলে হাসান আবেদ ফিরে এলেন লন্ডন। লন্ডনে ফিরে দূরবিন কিনে জিয়াউর রহমানের কাছে পাঠালেন। যুদ্ধ অনেক দিন চলবে, এই বিবেচনায় অর্থ সংগ্রহের দিকে বেশি মনোযোগ দিলেন। সব অর্থই ভিকারুল ইসলাম চৌধুরীর মাধ্যমে প্রবাসী সরকারের কাছে পাঠাচ্ছিলেন।
এর মধ্যে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল। ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী তখন শিলংয়ে অবস্থান করছিলেন।যুদ্ধ বিদ্ধস্ত সিলেটে খাদ্য পাঠানোর জন্যে আসাম সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। তামাবিল সীমান্ত দিয়ে ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী সিলেটে ঢুকলেন।ফজলে হাসান আবেদ লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরে এলেন ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি।
সিলেটের শাল্লা হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। পাকিস্তানিরা পুরো এলাকা ধ্বংস করে ফেলেছিল। সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের এই এলাকায় কাজ শুরু করলেন। ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ও ‘হেলপ বাংলাদেশ’নামে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের জন্যে কাজ করছিলেন। এবার সদ্য স্বাধীন দেশে, দেশের সব হারানো মানুষের জন্যে কাজ। একটি প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। গ্রামের মানুষের জন্যে কাজ, তাই নাম দিলেন,’বাংলাদেশ রিহ্যাবিলেটশন অ্যাসিসটেন্ট কমিটি’সংক্ষেপে ‘ব্র্যাক’।
০৫.
কাজ করার জন্যে অর্থ দরকার। কিন্তু অর্থ নেই। ভিকারুল ইসলাম চৌধুরীর কোলকাতার অ্যাকাউন্টে ছিল ২৫ হাজার রুপি। প্রয়োজনের তুলনায় যা খুবই কম।ইংল্যান্ডে তার একটি ফ্ল্যাট ছিল। সেটা বিক্রি করে ৬ হাজার ৮০০ পাউন্ড ব্যাংকে রেখেছিলেন, চাকরি না করেও সামনের তিন চার বছর চলার কথা চিন্তা করে।ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী কোলকাতার অ্যাকাউন্ট থেকে ২৫ হাজার রূপি, যে টাকা ইউরোপ থেকে সংগ্রহ করে পাঠানো হয়েছিল- তুলে নিয়ে এলেন।
ফজলে হাসান আবেদ লন্ডনে তার অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে নিয়ে এলেন ফ্ল্যাট বিক্রির পুরো ৬ হাজার ৮০০ পাউন্ড। সেই অর্থ দিয়ে‘ব্র্যাক’র কাজ শুরু হলো যুদ্ধ বিদ্ধস্ত শাল্লায়। তারপর রৌমারিসহ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের সর্বত্র। জমিদারের সন্তান নিজের অর্জিত অর্থ দিয়ে শুরু করলেন ব্র্যাকের কার্যক্রম। আজকের ব্র্যাক নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। ব্র্যাকের কার্যক্রম শুধু বাংলাদেশে নয়, আফগানিস্তান থেকে হাইতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।
০৬.
ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে বাংলাদেশের বহু জায়গায় ঘুরেছি। রাস্তায় যেতে যেতে, চা বাগানের বাংলোতে বসে অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলেছি। ‘ব্র্যাক ও ফজলে হাসান আবেদ’বই লিখেছি। পাঠকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিয়ে নিজের সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলি।
আমার বই লেখার আগে ব্র্যাক ও ফজলে হাসান আবেদ সম্পর্কে এসব তথ্য অজানা ছিল। আমিই প্রথম লিখেছি। আমার বই থেকে প্রায় সব তথ্য নিয়ে পরে আরও দু’একটি বই লেখা হয়েছে, কিন্তু কৃতজ্ঞতা স্বীকারও করা হয়নি। এটা বাঙালির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ধরে নিয়েছি, রাগ বা ক্ষোভ নেই। মনেও রাখিনি। এর আগে কোথাও বলিনি, লিখিনি।
আজ শুধু জানিয়ে রাখলাম। ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে আমার যোগাযোগের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেছিলেন তাজুল ইসলাম। এক সময়ের বিটিভি’র সংবাদ পাঠক তাজুল ভাই কয়েকদিন আগে না জানিয়ে চিরদিনের জন্যে চলে গেলেন। বইটি লেখার জন্যে প্রায় দুই বছর কাজ করেছি, ব্র্যাক থেকে একটি টাকাও নেইনি। তাজুল ভাই যদিও দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বারবার।
নিজের এবং নিজের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে এত কম কথা বলা মানুষ আমি পৃথিবীতে দ্বিতীয়জন দেখিনি, ফজলে হাসান আবেদ ছাড়া। তার থেকে তথ্য বের করে বই লেখা সেই কারণেই অনেক বেশি কঠিন ছিল।
০৭.
এবার ব্রাক ও ফজলে হাসান আবেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ বিষয়ে দু’একটি কথা বলি। অভিযোগ করা হয়, তার সন্তান এবং স্ত্রীকে ব্র্যাকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন। ‘আড়ং’গড়েই উঠেছে তার প্রথম স্ত্রী শেলু আবেদের তত্ত্বাবধানে। শেলু আবেদের মৃত্যুর পর তিনি বিয়ে করেছেন এবং তার স্ত্রী আড়ং পরিচালনা করেছেন। এখন তার মেয়ে তামারা আবেদ আড়ং পরিচালনা করেন। প্রথমত: তার স্ত্রী-সন্তান যথেষ্ট যোগ্য। দ্বিতীয়ত: তারা কাজ করছেন ব্র্যাকে। তারা কেউ ব্র্যাকের মালিক নন।
একদা জমিদার পুত্র ফজলে হাসান আবেদ নিজের নামে কোনো সম্পদ করেননি। তার কোনো বাড়ি- গাড়ি নেই। সব সম্পদ ব্র্যাকের। তার অবর্তমানে কোনো সম্পদ তার স্ত্রী- সন্তানরা পাবেন না। সব কিছুর মালিক ব্র্যাক। একজন মানুষ সারা জীবন দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ করেছেন, গরীব মানুষের জন্যে কাজ করেছেন, নিজের বা সন্তানদের জন্যে কোনো সম্পদ করেননি।
ইচ্ছে করলে নিজে হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হতে পারতেন। সে সব কিছু না করে, স্ত্রী- সন্তান ও পরিবারের দু’একজন সদস্যের চাকরির সুযোগ করে দিয়েছেন নিজের গড়া প্রতিষ্ঠানে। এরা যে কেউ জাতীয় বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে আরও বেশি বেতনে চাকরি করতে পারতেন। দু’একজন তা করেছেনও। তারা ব্র্যাকে কাজ করছেন। এটাকে কী খারাপভাবে দেখার সামান্যতম কোনো কারণ আছে?
তরুণ অনেকে এখন ঢুকছেন, বড় পদে ঢুকছেন। এটা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা প্রবীণদের কাছে হয়ত ভালো লাগছে না। তাদের খারাপ লাগাটা হয়ত ঠিকই আছে। তারচেয়ে বেশি ঠিক ক্রমশ জাতীয়- আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বিকাশমান একটি প্রতিষ্ঠানে যোগ্য তরুণদের জায়গা করে দেওয়াটাও অপরিহার্য। কোনো কর্মীর চাকরি চলে যাওয়া বা কারও প্রতি বৈশম্যমূলক আচরণও হয় বা হয়েছে। কয়েক হাজার কর্মী ব্র্যাকে কাজ করছেন। কিছু মানুষের ক্ষেত্রে যদি এমন হয়েও থাকে, তা একেবারে অস্বাভাবিক নয়।
প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে এসেই ‘ব্র্যাক কত খারাপ’ প্রপাগান্ডা চালানো সুস্থ্য মস্তিস্কের লক্ষণ নয়।
আর একটি অভিযোগ, আড়ংয়ের জিনিসের দাম বেশি। যে নারীরা আড়ংয়ে পোষাক বা অন্যান্য জিনিসপত্র তৈরি করেন, তাদের অনেক কম টাকা দেওয়া হয়। এই অভিযোগ আমারও ছিল এবং ফজলে হাসান আবেদকে প্রশ্নটি করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন:
‘মধ্যবিত্ত সস্তায় পণ্য কিনতে পারবে আমরা সে জন্যে আড়ং গড়ে তুলিনি।আড়ংয়ের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল উৎপাদকরা যাতে কাজ পান সেজন্যে।মধ্যবিত্তের স্বার্থ নয়,উৎপাদকদের স্বার্থটাই এখানে বড়।’
এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার সুযেগ নেই। কারণ উৎপাদক বা দরিদ্র মানুষেরা বাজার মূল্যের চেয়ে কম অর্থ পান না। তারা এবং তাদের সন্তানরা আরও কিছু সুবিধা পেয়ে থাকেন।বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে পণ্যের মান ধরে রেখেছে আড়ং। মান অনুযায়ী বাজার মূল্যের চেয়ে দাম কোনো অর্থেই বেশি না। আড়ংয়ের লাভের পুরো অর্থ প্রতিষ্ঠানের পেছনে ব্যয় হয়। আরও গরীব মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি হয়। কোনো ব্যক্তি লাভের একটি টাকাও পান না।
০৮.
মুক্তিযুদ্ধের ফসল ‘ব্রাক’র বয়স এখন ৪৫ বছর। ফজলে হাসান আবেদের বয়স ৮১ বছর। প্রতিষ্ঠানের যৌবন, টিপটপ স্মার্ট চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট নিজে এখন প্রবীণ। নোবেল ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব পুরস্কার- সম্মান পেয়েছেন। ‘নাইট’উপাধির পর তার নামের আগে যোগ হয়েছে ‘স্যার’।
কিন্তু স্যার ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাকের একজন পরিছন্ন কর্মির কাছেও ‘আবেদ ভাই’হিসেবে পরিচিত। অনেক দিন দেখা হয় না। শুনেছি এখন হাঁটা- চলায় কিছুটা সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। অনেকেই বলেন, তার অবর্তমানে ব্রাকের কী হবে?
এক জীবনে একজন মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে গেলেন, তার অবর্তমানের চিন্তাটা করার দরকার কী! যারা থাকবেন, তারা পরিচালনা করবেন তাদের মত করে। লোক তৈরি করে গেলেন না, এজাতীয় ভাবনা মোটেই জরুরি নয়।
গোলাম মোর্তোজা : সম্পাদক, সাপ্তাহিক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন