গৌতম দাস
অবশেষে এ কথা বলা যায় যে, নেপাল এখন নিজ রাষ্ট্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কায়েম করতে পেরেছে এবং তা এগিয়ে যেতে পারবে। নেপালের প্রধান তিন দলের মধ্যকার দুটোই কমিউনিস্ট পার্টি। এই কমিউনিস্ট অ্যালায়েন্স এবার জোট করে নির্বাচনে লড়ে জিতেছে। অ্যালায়েন্স গঠনের ঘোষণা দেয়ার সময় কমিউনিস্ট মাওবাদী দলের নেতা পুষ্পকমল দাহাল বলেছিলেন, এই অ্যালায়েন্স তারা করছেন নেপালের রাজনীতিকে স্থিতিশীলতা দেয়ার জন্য, স্থিতিশীল সরকার দেয়ার জন্য। নেপাল গত ৯ বছরে বিপুল রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ভেতর দিয়ে গেছে। এখন দাহালের অনুমান সঠিক প্রমাণ হয়েছে। নেপালের নির্বাচনে কমিউনিস্ট অ্যালায়েন্স সংসদে ৭১ শতাংশের মতো আসন লাভ করেছে।
১৯৯৬ সাল থেকে যদি ধরি, মাওবাদী সশস্ত্র দল প্রথম যখন রাজতন্ত্র উৎখাত ও ক্ষমতা দখলের লড়াই ঘোষণা দিয়ে শুরু করেছিল। সেই থেকে হিসাব কষতে বসলে গত ২০ বছরের বেশি সময়, এটা অবশ্যই নেপালের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের দিক থেকে এক বিরাট লম্বা পথপরিক্রমা। আর কে না জানে লক্ষ্যে পৌঁছানোতে পথ যত লম্বা হয়ে যায়, ততই সেখানে আরো বেশি অনিশ্চয়তা, আর তা বিপজ্জনক হয়। তবুও আজ প্রায় ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম শেষে এক কথায় বললে নেপালের সাফল্য অনেক। আর এতে অন্তত তিনটি বড় অর্জন আছে।
এক. শত বছরেরও বেশি পুরনো নেপালি রাজতন্ত্রের শাসনকে উৎখাত ও অবসান ঘটানো। দুই. দুইবারের চেষ্টায় অনিশ্চয়তার সাত বছরের শেষে নেপালকে সর্বপ্রথম একটি রিপাবলিক রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করা সম্ভব হয়। অর্থাৎ রাজতান্ত্রিকতার বিপরীতে রিপাবলিক বা লোকতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন সফল হয়। কনস্টিটিউশন রচনার কাজ সফলভাবে সমাপ্ত করা এবং এই কাজ শেষে প্রথম কনস্টিটিউশন প্রক্লেমেশন-২০১৫ ঘোষণা দিতে নেপাল সফল হয়। আর তিন. নতুন কনস্টিটিউশনের অধীনে প্রথমবার সাধারণ নির্বাচন বা সংসদের নির্বাচন সম্পন্ন করা হয়। শুধু তাই নয়, ভোটের ফলাফলে নেপালের প্রধান তিন রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের কিছু কম (গণনার প্রাথমিকপর্যায়ের ১৬৫ আসনের মধ্যে ৮০ আসন) পেয়ে গেছে। এই দল হলো চেয়ারম্যান খাড়গা প্রসাদ শর্মা অলির কমিউনিস্ট পার্টি (CPN-UML) আর এটা অপর কমিউনিস্ট ‘মাওবাদী সেন্টার’ দলের সাথে মিলে ৭১ শতাংশ আসন পেয়েছে। অর্থাৎ এই তৃতীয় অর্জন সম্পর্কে বলা যায়, এখন সহজেই একটি স্থিতিশীল সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে। ফলে সম্ভাব্য নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অলির নেতৃত্বে নেপাল এক নতুন ও স্থিতিশীল সরকার গঠন করতে পারবে।
প্রায় ২০ বছর পরের নেপাল এই প্রথম স্থিতিশীলভাবেই পূর্ণ সময়কালের সরকার কায়েম করতে পারবে, আর সেই সরকার দৃঢ়তার সাথে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হবে। এর প্রধান কারণ হলো, অপর কমিউনিস্ট পার্টি চেয়ারম্যান পুষ্পকমল দাহালের ‘মাওবাদী সেন্টার’-এর সাথে ইতোমধ্যে গত অক্টোবরে এরা একটি জোট গঠন করেছে। এটি শুধু কোনো নির্বাচনী জোট নয়, এক দলে পৌঁছানোর লক্ষ্যে জোট। ফলে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ঘাটতি মিটানো নয়, নানান রাজনৈতিক কর্মসূচি ও নীতি সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে মতের মিল বেশি থাকবে। মাওবাদীরা দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনপ্রাপ্ত দল (১৬৫ আসনের মধ্যে ৩৬ আসন), আর তৃতীয় নেপালি কংগ্রেস (১৬৫ আসনের মধ্যে ২৩ আসন)। তবে নতুন গঠিত এই কমিউনিস্ট অ্যালায়েন্সে আরো একটা দল আছে। সেটা বাবুরাম ভট্টরায়ের নয়াশক্তি পার্টি, এই দলের একা তিনি জিতেছেন। তিনি আসলে ছিলেন মাওবাদী দলের সাবেক দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা, রাজতন্ত্রের পরাজয়ের পর ২০১১ সালের প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন, পরে দল ছেড়ে বের হয়ে যান। তাহলে অল্পকথায় তিনটি অর্জন হলোÑ রাজতন্ত্রের উৎখাত, নতুন লোকতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কনস্টিটিউশন রচনা ও ঘোষণা আর শেষে এক স্থিতিশীল ও নির্বাচিত সরকার গঠন।
নেপালের রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামো তিন স্তরবিশিষ্ট ফেডারল (কেন্দ্র), প্রাদেশিক ও স্থানীয় সরকার- এভাবে লেখা নতুন কনস্টিটিউশন অনুসারে গঠিত। আর তিন স্তরের নির্বাচন এ বছরই অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা এক বিরাট সাফল্য। কারণ গত বছরের এই সময়েও নেপালের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এত চরমে ছিল যে, এক বছর পরে এই সময়ে নেপালের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অর্জন আজ এই উচ্চতায় উঠবে তা তখন বিশ্বাস করা যেত না। আচ্ছা, গত ২০ বছরের পথপরিক্রমায় কারা নেপালের গণস্বার্থের দিক থেকে বিচারে এর রাজনীতিক-ভিলেন ছিল? এই প্রশ্নের জবাব হবে, ২০০৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত স্বভাবতই সেই ভিলেন, তিনি নেপালের রাজা। তবে এরপর রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে মাওবাদীসহ পাল্টা নেপালের রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে নিয়ে জোট বাঁধা ও এর ওপরে ভারত ও আমেরিকার সমর্থন আনা এই ঘটনাগুলো ঘটার সময় নির্ধারক ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল ভারত। তা সত্ত্বেও নতুন সরকারের আমলে কনস্টিটিউশন গঠনের কাল থেকে ক্রমেই ভারত ভিলেনের ভূমিকায় হাজির হতে থাকে। সেই থেকে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বাজে ভিলেন হয়ে আছে ভারত। গানের ভাষায় বললে- ‘ওরা চাহিতে জানে না দয়াময়’। ভারত চাইতে জানে না। কিভাবে ও কী চাইতে হয় তা জানে না। নেহরুর হাতে ভিত্তি পাওয়া স্বাধীন ভারত, আর এ থেকে সবচেয়ে বাজে ও ভুল শিক্ষা পাওয়া আমলা-গোয়েন্দা প্রশাসনের ভারত, এরাই মূলত সেই ভিলেন। নেহরু ভেবেছিলেন কলোনি-উত্তর স্বাধীন ভারত, একালে ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া সুবিধাগুলো তিনি ব্রিটিশদের মতো নিজেই ব্যবহার করবেন। এটা তার প্রিরোগেটিভ বা পড়ে পাওয়া চারআনা বিশেষ সুবিধা, প্রাধিকার। তিনি বুঝতেই পারেননি যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের যে নতুন দুনিয়া গড়ে তোলা হচ্ছিল, সেটা আর কলোনি-শাসিত দুনিয়া নয়, কোনো ইউরোপীয় কলোনি-শাসকের দুনিয়া নয়, এটা বরং খোদ পুরনো কলোনি-অর্থনৈতিক-সম্পর্কেরই অবসান। আর আমেরিকার নেতৃত্বে গড়ে তোলা নতুন এক গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের অর্থনীতি সম্পর্কের ও কলোনি শাসনমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের দুনিয়া।
মূল কথায় এখানে অপর রাষ্ট্রের ওপর প্রভাব ও সম্পর্ক রাখা এবং সুবিধা নেয়া ও কিছু দেয়ার তরিকাই আলাদা। এখানে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বিনিময় সম্পর্ক আর কলোনিয়াল একেবারেই নয়, আলাদা। নেহরু এর খবর জানতেন না বা রাখেননি। এ কথার সবচেয়ে ভালো প্রমাণ হলো নেহরুর করা ‘নেপাল-ভারত চুক্তি-১৯৫০’। যেটা আসলে এর আগে ব্রিটিশদের করা ‘নেপাল-ব্রিটেন চুক্তি-১৯২৩’ এর কার্বন কপি। এই চুক্তি থেকে এটা পরিষ্কার, তিনি ভারতকে কলোনি-শাসকের ভূমিকায় নামিয়েছিলেন, দেখেছিলেন। ব্রিটিশ কলোনির এক ভেসেল রাষ্ট্র বা করদরাজ্য ছিল নেপাল। কলোনি না করে ভেসেল রাষ্ট্র করে সুবিধা দেয়ার পেছনে অনেক কারণ আছে। এর একটি কারণ হলো সিপাহি বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের আগে পুরো নেপাল ব্রিটিশরা দখলে নিয়েছিল। কিন্তু সিপাহি বিদ্রোহে ব্রিটিশদের পক্ষ নেয়াতে বিদ্রোহ পরাজিত করার শেষে এই ভেসেল রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আগে এমন অনেক চুক্তি ছিল। বিভিন্ন সময়ে ব্রিটিশরা তাতে অনেক নতুন ছাড় দিয়েছিল। এমন সর্বশেষের চুক্তিটিই হলো ১৯২৩ সালের চুক্তি। কিন্তু সেটিই অনুসরণ বা অনুকরণ করে একই দাসত্ব চুক্তি করেছিল নেহরুর ‘রিপাবলিক ভারত’। ওই চুক্তিটিই এখনো বহাল আছে। প্রশ্নটা আসলে, একালে কাউকে দাস বানানোর সুযোগ পেলেও আপনি তা নেবেন কি না? নেহরু সেটা দাবির সাথে নিয়েছিলেন। আর নিজ নতুন আমলা-গোয়েন্দা প্রশাসনের ভিত গড়েছিলেন কলোনি ওরিয়েন্টেশনে।
গত অক্টোবরে কমিউনিস্টদের লেফট অ্যালায়েন্স গঠন হওয়ার পর তাদের যৌথ ম্যানুফেস্টো প্রকাশিত হয়। জাপান থেকে ১ ডিসেম্বর প্রকাশিত ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিন বলছে, ওই ম্যানুফেস্টোতে বলা হয়েছে- ওই লেফট অ্যালায়েন্স নির্বাচনে জিতলে পরে তাদের দ্বারা গঠিত অ্যালায়েন্স সরকার এরপর ‘ইন্ডিয়া-নেপাল শান্তি ও বন্ধুত্ব চুক্তি-১৯৫০’ বাতিল করবে এবং একটা নতুন চুক্তি করবে। এখন নির্বাচন সমাপ্ত হয়েছে। আর ওই আকাক্সক্ষা মতোই অ্যালায়েন্সের পক্ষে ফলাফল এসেছে। ফলে এখন স্বভাবতই ওই চুক্তি বাতিলের প্রসঙ্গ উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই নির্বাচনের শুরু থেকে নয়াদিল্লি খুবই অস্বস্তিতে ছিল। আর ফল প্রকাশের পর সেটা আরো বেশি হয়ে এখন অনুভূতিশূন্য হয়ে গেছে। এমনিতেই গত অক্টোবরে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির অ্যালায়েন্স গঠন হওয়ার পর থেকে নয়াদিল্লি আসন্ন নির্বাচনে বিপদ আঁচ করতে শুরু করেছিল। যেমন সুবীর ভৌমিকের নেপালের নির্বাচন প্রসঙ্গে ‘সাউথ এশিয়ান মনিটর’ অনলাইনে তার লেখা দিয়েছেন। সেই লেখার শিরোনাম দিয়েছেন, ‘ভারত কি নেপালের নির্বাচনকে নিজের পরাজয় হিসেবে দেখবে!’ তবে সুবীরের এবারের লেখাটি ভারতের আমলা-গোয়েন্দা প্রশাসনকে সান্ত্বনা দেয়ার ভঙ্গিতে লেখা। তাই নিজেদের অনেক ভুলত্রুটি এখানে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। স্বীকার করা হয়েছে ২০১৫ সালের অক্টোবরে ভারতকে আমল না করে কনস্টিটিউশন ঘোষণা করলে টানা ছয় মাস নেপালে পণ্য অবরোধ করে রেখেছিল। এটাই নেপালের সাধারণ মানুষকে ভারতের বিরুদ্ধে চূড়ান্তভাবে বিমুখ করে তোলে, যার প্রভাব এখনো প্রবল। আবার শ্রীলঙ্কার গত নির্বাচন ও পরবর্তী পরিস্থিতির সাথে তারা নেপালকে তুলনা করে দেখে। আর তাদের এখনকার মূল্যায়ন হলো শ্রীলঙ্কায় সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ও অন্যান্য ইস্যুতে চীনকে আসলে ঠেকানো যায়নি।
নেপালের বেলায় সমুদ্রবন্দর নির্মাণ না হলেও বাঁধ নির্মাণ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের আড়াই বিলিয়ন ডলারের এক প্রকল্প আছে। যে সরকারের অধীনে এই নির্বাচন সমাপ্ত হলো সেটা নেপালি কংগ্রেস দলের, তবে তা মাওবাদী দলের সমর্থনে এক কোয়ালিশন সরকার। নেপালে পানিবিদ্যুতের প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সুবীর বলছেন, এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় মাত্র ৭৫৩ মেগাওয়াটের মতো। ২০১৫ সালের শেষে কমিউনিস্ট অলির সরকারের আমলে চীনের সাথে তিনি ১২০০ মেগাওয়াটের এক বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের চুক্তি করেন, সেটাই ওই আড়াই বিলিয়ন ডলারের চুক্তি ছিল। কিন্তু এ বছর নেপালের প্রথমপর্যায়ের নির্বাচন শুরুর কয়েক দিন আগে গত নভেম্বরে নেপালি কংগ্রেস সরকারের আমলে তারা ওই চুক্তি বাতিল করে দেয়। নেপালকে ঘিরে চীন-ভারত রেষারেষি আরো সরাসরি নির্বাচনে হাজির হয়ে পড়ে তখন থেকেই। স্বভাবতই কমিউনিস্ট অ্যালায়েন্স এখন নির্বাচনে বিজয় লাভ করাতে ওই প্রকল্প চুক্তি আবার জীবিত হবে বলে সবাই অনুমান করছেন। মজার কথা হচ্ছে, সুবীর ভৌমিক ওই চুক্তি প্রসঙ্গে নেপালের পক্ষে কথা বলেছেন। এমনকি চীনের বেল্ট-রোড প্রকল্পে যুক্ত হয়ে আরো অবকাঠামো প্রকল্প আনার পক্ষে কথা বলছে।
নয়াদিল্লি ঘোরতরভাবে চীনের বেল্ট-রোড প্রকল্পের বিরোধী; তার কোনো বন্ধু বা পড়শি রাষ্ট্র এতে যুক্ত থাকুক এটা দেখতে সে একেবারেই রাজি নয় (ফলে বাংলাদেশের সাথেও এটি একটি অনৈক্যের বিরাট ইস্যু), কিন্তু নেপালের বেলায় সুবীর বলতে চাইছেন, নেপালের এখন দরকার বিদ্যুৎসহ অবকাঠামোগত খাতে প্রচুর বিনিয়োগ। না হলে নেপালের অর্থনীতি দাঁড়াবে না। ইতোমধ্যে সদ্যগঠিত ওই কমিউনিস্ট অ্যালায়েন্স আগামী ১০ বছরের মধ্যে নেপালকে মাথাপিছু পাঁচ হাজার ডলার আয়ের অর্থনীতির দেশে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছে। অপর দিকে চীনের মতোই ভারতকেও কিছু বিদ্যুৎ প্রকল্প নেপাল দিয়েছে ২০১৫ সালের শুরুর দিকে। কিন্তু আজো সেসব প্রকল্পের কোনো কাজই শুরু হয়নি বলে সুবীর জানাচ্ছেন। অর্থাৎ এক দিকে ভারতের সক্ষমতা দক্ষতা সামর্থ্য নেই, অন্য দিকে চীনের আছে, সুবীর এই তুলনা আনছেন। আবার চীনের বিনিয়োগ সক্ষমতার তুলনায় ভারত যে কিছুই না, সেটা শ্রীলঙ্কাতেও দেখা গেছে। ফলে সুবীর ভারতের আমলা-গোয়েন্দা প্রশাসনের কাছে ‘স্মার্ট হতে’ যুক্তি তুলে ধরে বলছেন, তাদের উচিত চীন-নেপালকে বিদ্যুৎ প্রকল্পে বাধা না দিয়ে বরং সহযোগিতা করার। আর সে ক্ষেত্রে ওখানে যে বাড়তি বিদ্যুৎ তৈরি হবে তা কিনে নেয়া। ইঙ্গিত দিয়েছেন বাংলাদেশকে ওই বিদ্যুৎ বিক্রির টাউটারি নেয়ার, নগদ লাভ এখানেই। এখানে জানা থাকা ভালো, ভারত নেপালকে এমন কলোনি-চুক্তিই করে রেখেছে যে, ভারতের অনুমতি ছাড়া অন্য কাউকে নেপাল বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারে না।
তবে আমাদের মতো দেশের বেলায় পাল্টা আরেকটা কথা সমান গুরুত্ব দিতে হবে। চীনের নেয়া অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে (যেমন বাংলাদেশেও) এক বিরাট কালো দাগ আছে। এখানে প্রতিযোগিতামূলক বাজার যাচাই, কোনো ওপেন টেন্ডার হয় না বা প্রকল্পের কোনো টেন্ডার করতে যাতে না হয়, বালাই যেন না থাকে; তাই প্রকল্পগুলো জিটুজি (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট)-এর অধীনে নেয়া হয়ে থাকে। আর এতে স্বভাবতই প্রকল্প মূল্যের কোনো মা-বাপ থাকে না। এ ছাড়া লোকাল এজেন্টের নামে অর্থ সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা বা সুযোগ থাকে। আর বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পের সাথে তুলনা করলে কোনো ওপেন আন্তর্জাতিক টেন্ডার ছাড়া সে ক্ষেত্রে কোনো প্রকল্প সেখানে কাউকে দেয়ার সুযোগই নেই। এমনকি জাপান সরকার দাতা হলেও জাপানি ঠিকাদারকে কাজ দেয়ার কোনোই বাধ্যবাধকতা থাকে না।
তবে সেটা যাই হোক, সুবীরের লেখায় এই প্রথম ভারতের অভ্যন্তরীণ আমলা-গোয়েন্দা প্রশাসনকে নিজেদের দুর্বলতা ও সক্ষমতা-দক্ষতা সামর্থ্যরে দিকে নজর ফেরাতে তাগিদ দিতে দেখা গেল। সুবীরের এই লেখা থেকে মনে করার কারণ আছে যে, ভারতের প্রশাসন বিপদে আছে, এ নিয়ে টনক নড়ারও কেউ কেউ আছে। ভারত বিপদ দেখছে, একের পর এক ভারতের পড়শি রাষ্ট্রে চীন প্রকল্প নিয়ে ঢুকে পড়ছে, ভারতের কিছু করার থাকছে না। ভারত এখন শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও আসলে শেষে কিছু ঠেকানো যায়নি বলে তারা মনে করে।
কিন্তু আসলেই ব্যাপারটি এমন হওয়ার কথা নয় কি? ভারতের যদি সক্ষমতা-দক্ষতা-সামর্থ্য না থাকে, আর তা থেকে সৃষ্ট নানা দুর্বলতা তাকে ঘিরে রাখে, তবে এমনই কি হওয়ার কথা নয়। আসলে প্রথম প্রশ্ন করা উচিত যে, ভারত কেন অর্থনৈতিক বা বৈষয়িক সক্ষমতার দিক থেকে নিজেকে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্য বলে বিবেচনা করছে? কিসের ভিত্তিতে?
দেখা যাচ্ছে, ভিত্তিহীন সব অনুমানের ওপর দাঁড়িয়ে ভারতের আমলা-গোয়েন্দা প্রশাসন ছড়ি ঘোরানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে আর ধপাধপ পড়ছে, শ্রীলঙ্কা আর এরপর নেপাল...। সুবীর ভৌমিকই বলছেন, শ্রীলঙ্কার পর নেপালেও নাকি নয়াদিল্লি, শ্রীলঙ্কার ভূত দেখতে পাচ্ছে। তা হলে? এরপর কোথায়?
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন