জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী
কলকাতায় প্রথম সপ্তাহে যা দেখলাম জানলাম
দুদিন পর ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসে রাতে কলকাতা দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছলাম। উৎসাহ ও উত্কণ্ঠা নিয়ে ট্যাক্সি করে সোজা বাংলাদেশ হাইকমিশনে। ধারণা ছিল যুদ্ধ যখন চলছে, তখন নিশ্চয়ই সারা রাত কমিশন খোলা, সবাই ব্যস্ত, কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর। পৌঁছে চমকে দেখলাম হাইকমিশন নীরব নিষ্প্রভ। অনেক চেষ্টার পর খবর পৌঁছালাম পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হোসেন আলীর কাছে। তিনি আমাদের কথা শুনে বিরক্ত মনে বললেন, আপনারা কষ্ট করে কেন এসেছেন, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। যান রাতটা নিকটবর্তী লিটন হোটেলে কাটান, তাদের এয়ারকন্ডিশন রুম আছে। ধাক্কা খেলাম, এয়ার কন্ডিশন রুমে আরাম-আয়েশে থাকার জন্য তো আমরা লন্ডন থেকে কলকাতায় আসিনি। হাইকমিশনের মেঝেতে শয়ন ব্যবস্থা করলে বেশি খুশি হতাম। এসি হোটেলে অর্থ ব্যয় না করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সে টাকা ব্যয় তো সঠিক কাজ।
পরের দিন অনেকের সঙ্গে দেখা হলো— বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী। সবার একই কথা, তারা ভয়ানক কষ্টে আছেন, আহার-বাসস্থানের ব্যবস্থা নেই; একই প্রশ্ন, ‘প্রাণের তাগিদে আমরা দেশ ছেড়েছি, আপনারা কেন এসেছেন?’ কেউ কেউ বললেন, বিদেশে যাওয়ার জন্য আমরা সাহায্য করতে পারব কিনা?
দেখা হলো ব্যারিস্টার মওদুদ, আমিরুল ইসলাম ও প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম চাষীর সঙ্গে। চাষী আমাদের নিয়ে গেলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ে ৮ নং থিয়েটার রোডে। প্রথমে সাক্ষাৎ করালেন কর্নেল (অব) মহম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর সঙ্গে। ছাত্রজীবনে তার সঙ্গে একবার পরিচয় হয়েছিল। তিনি ১৯৬২-৬৩ সালে রাওয়ালপিণ্ডি থেকে ঢাকা এসেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানি ছাত্রদের সামরিক বাহিনীতে যোগদানে উৎসাহিত করার জন্য। তিনি সিলেটি ভাষা ভালো বলেন, আলাপনে বাংলার চেয়ে ইংরেজি বেশি বলেন।
আমরা লন্ডন থেকে এসেছি শুনে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘ওয়েলকাম ইয়ং ম্যান। হাউ ইজ লন্ডন নাও এ ডেইজ, হাউ ইজ তাসাদ্দুক? গ্যানজেস কেমন চলছে? সিলেটিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন, আমার কথা বলবেন, সকল সিলেটবাসী আপনাদেরকে সাহায্য করবে অকাতরে।’ তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে। তখন তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। বসতে বলেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী কেমন আছেন? বাঙালিদের বিভেদ, দলাদলি কীভাবে সামাল দিচ্ছেন? বাম রাজনৈতিক দলগুলো চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে আছে তো? যুদ্ধ চলছে, দেশ পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে পুরো মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। নিজেরা গিয়ে দেখুন, বিলেতের প্রবাসী বাঙালিদের সংঘবদ্ধভাবে সাহায্য করতে বলবেন। বিলেতের ডাক্তারদের তো অনেক আয়।’
তিনি আরো বললেন, ‘যুদ্ধ চলছে যশোর ক্যান্টনমেন্ট, আগরতলা সীমান্তে, নিজেরা গিয়ে দেখেন। প্রস্তুতি চলছে গেরিলা যুদ্ধেরও, মুক্তিবাহিনী সত্বর দেশের অভ্যন্তরে আক্রমণ শুরু করবে।’ তাজউদ্দীন সাহেবের বক্তব্যে আমরা আশান্বিত হলাম। বুঝলাম, যোগ্য লোকের হাতে নেতৃত্ব আছে। এখানে নিশ্চয়ই বিলেতের মতো দলাদলি নেই। ভুল ভাঙল কয়েক দিন পরে।
পরের দিন গেলাম যশোর সীমান্তে। ক্যাপ্টেন হাফিজ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, যদিও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড চাপে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পিছু হটে ভারতীয় সীমান্তে আশ্রয় নিয়েছেন কিন্তু ক্লান্তি বা হতাশার চিহ্ন নেই। অধিকতর উদ্যমে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা ছাত্র ও শ্রমিকদের রণকৌশল শেখাচ্ছেন। ক্যাপ্টেন হাফিজ নিজের জন্য কিছু চাইলেন না। বললেন, ‘তরুণ গেরিলাদের কাপড়চোপড় ও খাদ্য দিয়ে সাহায্যের চেষ্টা করুন।’
সেখান থেকে ফিরে দেখা হলো কাজী জাফর ও মেননের সঙ্গে। মেননের ভাই সাদেক খান বললেন, ‘যুদ্ধ দেখতে হলে আগরতলা যান, সেখানে খালেদ, জিয়া, শফিউল্লার নাগাল পাবেন, দেখবেন বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর ও পুলিশ কীভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, তরুণ গেরিলারা প্রস্তুতি নিচ্ছে ঢাকা আক্রমণের জন্য।’
সাদেক খান খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। ম্যাট্রিক, ইন্টারমিডিয়েটে প্রথম হয়েছিলেন। সার্বক্ষণিক কমিউনিস্ট কর্মী হয়ে অনিয়মের কারণে যক্ষ্মা আক্রান্ত হন এবং কয়েক বছর লেখাপড়া বন্ধ রাখেন। পরে কিছুদিন অভিনয়ে ও চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে ব্যবসায়ে অত্যন্ত সফল হয়েছিলেন।
আমরা বোকার মতো সরল মনে কলকাতা পুলিশের কাছে আগরতলা ও আসাম যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করি। দুদিনের মধ্যে অনুমতি পেয়ে যাব আশ্বাস দিলেও চারদিনেও অনুমতিপত্র না পাওয়ায় বিষণ্ন হয়ে পড়ি। আমাদের দুঃখের কথা শুনে সাদেক ভাই বললেন, ‘বোকামি করেছ, পুলিশের কাছে কেন গিয়েছ, কখনো তোমরা অনুমতি পাবে না। নাম বদলিয়ে টিকিট কেটে সোজা আগরতলা চলে যাও। সেখানে খালেদ মোশাররফের সাক্ষাৎ পাবে।’ সাদেক খান এজেন্টের মাধ্যমে মি. জেড চৌধুরী ও মি. মবিন নামে টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেন।
সপ্তম দিনে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসে কলকাতা থেকে আগরতলা। পূর্ব পাকিস্তানের মহকুমা শহরের চেয়েও ছোট। হোটেলের সন্ধানে শহরের প্রবেশপথে প্রথম দেখা হলো ছাত্রলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে। ছাত্রজীবনে আমি ছাত্র ইউনিয়ন করতাম বলে মনির সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল না। তাই একটু শঙ্কিত হয়ে তাকাতেই মনি বললেন, ‘ডাক্তার, আমি জানতাম আপনি আসবেন, কমিউনিস্টরা লন্ডনে বসে থাকবে না।’ হাসিমুখে ভালো ব্যবহার করলেন। জিজ্ঞেস করলেন কলকাতায় কার কার সঙ্গে দেখা হয়েছে।
‘প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ’ বলার সঙ্গে সঙ্গে ফজলুল হক মনি হঠাৎ রেগে গেলেন। বললেন, ‘কোথাকার প্রধানমন্ত্রী? কে তাকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন? প্রতারক তাজউদ্দীন, নিজে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছেন। আওয়ামী লীগের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কমিউনিস্ট।’ আমরা হতভম্ব হয়ে গেলাম। ভাবলাম যুদ্ধের সময় যদি এরূপ বিভেদ থাকে, ভবিষ্যতে কী হবে? নিশ্চয়ই তাজউদ্দীন সাহেবের জীবনটা সুখের হবে না। স্বাধীনতা উত্তরকালে তা-ই প্রমাণিত হয়েছিল। ‘কৃতঘ্ন’ শব্দটা অন্য ভাষায় নেই। ষড়যন্ত্র থেমে ছিল না। যুদ্ধকালীন ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মনির সহায়তায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অজ্ঞাতে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) সৃষ্টি করেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সমান্তরাল অন্য একটি বাহিনী হিসেবে।
দেখা হলো চট্টগ্রামের এমআর সিদ্দিকী সাহেবের সঙ্গে। তিনি ওই রাতে তাদের সঙ্গে আগরতলা সার্কিট হাউজে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। পরের দিন ভোরেই রওনা হলাম দুই নম্বর সেক্টরের উদ্দেশে, মেলাঘরের পথে। সাক্ষাৎ হলো মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর জিয়া, শফিউল্লাহ, মীর শওকত আলী ও অন্যদের সঙ্গে। যুদ্ধে ফিল্ড হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে বলার পর খালেদ বললেন, ‘আমার ডাক্তারের প্রয়োজন নেই। আমার প্রয়োজন অস্ত্র এবং বুলেট অ্যান্ড বুলেটস। আপনারা লন্ডন ফিরে গিয়ে আইআরএর সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আমাদের জন্য রাতে দেখা যায় এরূপ বাইনোকুলার, ছোট ডুবুরি যান মিডগেট এবং ছোট ছোট অস্ত্র জোগাড় করে পাঠান। চেকোশ্লোভাকিয়ায় অল্প মূল্যে স্বয়ংক্রিয় ছোট অস্ত্র পাওয়া যায়।’
কয়েক দিনের মধ্যে আহত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়ে গেলে মেজর খালেদ তার মত বদলাতে বাধ্য হন। দুই মাসের মধ্যে গড়ে ওঠে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর দেহরক্ষী হাবুল ব্যানার্জির আনারস বাগানে ৪৮০ বেডের ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। প্রবাসী সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রাথমিকভাবে কিছু অর্থ সাহায্য করেছিলেন। বেশির ভাগ খরচ ও সব যন্ত্রপাতি পাঠিয়েছিল লন্ডনস্থ বিডিএমএ। হাসপাতাল তৈরির মূল কৃতিত্ব ডা. মবিনের। এ হাসপাতালে ২২ অক্টোবর মাথায় গুলিবিদ্ধ মেজর খালেদ মোশাররফ প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছিলেন, পরে স্থানান্তর হয়েছিলেন লক্ষৌতে, ভারতীয় সেন্ট্রাল কমান্ডের বড় মিলিটারি হাসপাতালে।
বিডিএমএ থেকে অন্য চার চিকিৎসক— ডা. কাজী কামরুজ্জমান, বরকত আলী চৌধুরী, আলতাফুর রহমান ও মাহফুজ অক্টোবরে ভারতে এসে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা দেন। বিজয়ের প্রাক্কালে বিলেত থেকে আসেন ডা. মোশাররফ হোসেন জোয়ারদার, যার ঢাকায় শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ছিল। ডা. বরকত চৌধুরী বর্তমানে অসুস্থ, আলজেইমার রোগে আক্রান্ত, ডা. কাজী কামরুজ্জমান বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় ঢাকায় মগবাজারস্থ কমিউনিটি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন করেছেন। ডা. মাহফুজ একজন বিশেষজ্ঞ রেডিওলজিস্ট হিসেবে বিলেতে অবসর জীবন যাপন করছেন। তিনি বাংলাদেশের এনআরবি ব্যাংকের একজন উদ্যোক্তা পরিচালক। ডা. আলতাফ লন্ডনে অবসর জীবন যাপন করছেন। মধ্যে মধ্যে বেড়াতে দেশে আসেন।
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানীর অজ্ঞাতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভারতের সঙ্গে চুক্তি
ফরাসি কবি-সাহিত্যিক, রোমান্টিক রাজনীতিবিদ ও ফরাসি সরকারের সংস্কৃতিমন্ত্রী আঁন্দ্রে মালরো স্প্যানিস সিভিল ওয়ারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ষাটের দশকে নাইজেরিয়ায় বিয়াফ্রার যুদ্ধে মালরো বিয়াফ্রার বিদ্রোহীদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। সেই যুদ্ধ হঠাৎ থেমে যাওয়ায় তার কাছে বহু অব্যবহূত অস্ত্র ছিল।
মালরোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সেপ্টেম্বরে ওসমানী সাহেব আমাকে ফ্রান্সে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। ভারত ত্যাগের প্রাক্কালে ভারতীয় পুলিশ আমার ডায়েরিটি এবং কাস্টমস কর্তৃপক্ষ দামি ক্যামেরাটা রেখে দেয়।
প্যারিসের উপকণ্ঠে আঁন্দ্রে মালরোর প্রাসাদসম বাড়ি। আমার সঙ্গে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর মালরোর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার জন্য ওসমানী সাহেব একটি চিঠি লিখে দিয়েছিলেন, যা ভারতীয় পুলিশ পরীক্ষার নিমিত্তে রেখে দিয়েছিল। বিষয়টি জেনে লন্ডনস্থ ভারতীয় দূতাবাস চক্রান্ত করে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ফ্রান্স যাত্রায় বাধা সৃষ্টি করেছিল। আমি একলা আঁন্দ্রে মালরোর সঙ্গে দেখা করি। সাক্ষাৎ কাহিনী পরে কখনো লেখার চেষ্টা করব।
প্যারিস থেকে লন্ডন, লন্ডন থেকে কলকাতা ফেরার পর পরই ওসমানী সাহেব আমাকে লক্ষৌতে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত খালেদ মোশাররফকে দেখে আসতে অনুরোধ করেন। খালেদ মোশাররফ নিজে আমাকে দেখতে চেয়েছেন। খালেদ মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের অত্যন্ত প্রিয়জন। কলকাতা থেকে সরাসরি লক্ষৌ ফ্লাইট না পাওয়ায় দিল্লি হয়ে লক্ষৌ যাত্রা করি। দিল্লিতে বিশিষ্ট বাঙালি ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তারা সাক্ষাতে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘সব ঠিক হয়ে গেছে, আপনারা ডিসেম্বরে ঢাকা ফিরতে পারবেন। প্রবাসী সরকারের সাথে ভারতের চুক্তি হয়েছে।’ আশ্চর্য হলাম, ওসমানী সাহেব আমাকে কিছুই বলেননি!
লক্ষৌ সেন্ট্রাল কমান্ড হাসপাতালে খালেদ মোশাররফ আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘আমাকে লন্ডনে নিয়ে চলুন, ভারতীয়রা আমাদেরকে ভুটান সিকিম বানাবে। তারা আমাদের চাইনিজ অস্ত্র নিয়ে ভারতীয় নিম্নমানের অস্ত্র দিচ্ছে, আমাদেরকে তাদের পদানত করে রাখার জন্য।’ আমি বললাম, ‘আপনার জন্য টিকিটের ব্যবস্থা তো আমিই করতে পারি কিন্তু ভারতীয়রা আপনাকে ভারত ছাড়ার অনুমতি দেবে তো? বিষয়টি আমি সর্বাধিনায়ককে জানাব।’
ফেরার পথে আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। দিল্লি-কলকাতার একটা ফ্লাইট লক্ষৌ হয়ে যায়। প্লেনে ওঠার পর দেখি আমার পাশে আবদুস সামাদ আজাদ এমএনএ। তিনি দিল্লি থেকে উঠেছেন। তার সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। তিনি ন্যাপ-ভাসানী দল করতেন। বহুদিন জেলে ছিলেন। চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এলে তার পুলিশ গার্ডকে আমাদের ক্যান্টিনে বসিয়ে ভালো করে খাওয়াতাম এবং সামাদ ভাইকে গোপনে তার আগা মসিহ লেনের বাসায় পাঠিয়ে দিতাম। স্ত্রীর সঙ্গে সারা দিন কাটিয়ে বিকালে জেলে ফেরত যেতেন। তার চিকিৎসাপত্রে পুনরায় পরের সপ্তাহে চিকিৎসার জন্য আসার নির্দেশ লিখে দেয়ার ব্যবস্থা করতাম। আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক, আমার দৌর্দণ্ড প্রতাপ, আমি সবার প্রিয়। সামাদ ভাই বললেন, ‘তুমি আমাকে দেখোনি। কাউকে বলবে না। এয়ারপোর্টে আমার গাড়ি থাকবে, সেটা নিয়ে তুমি চলে যেয়ো। আমার জন্য অন্য আরেকটি গাড়ি থাকবে।’ তুমি আমার কথা কাউকে বলো না। আমার অনুসন্ধিৎসা বাড়ল, জিজ্ঞেস করলাম, ‘দিল্লিতে কী করলেন? কোনো চুক্তি হয়েছে কি?’ তিনি উত্তর দিলেন না। আমার মনে সন্দেহ দৃঢ় হলো। কলকাতা পৌঁছে সোজা থিয়েটার রোডে ওসমানী সাহেবের রুমে। রেগে বললাম, ‘দেশ বেচে দিয়েছেন।’ তিনি আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। আমি খালেদ মোশাররফ ও আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে আমার কথোপকথনের কথা বললাম, আবদুস সামাদ আজাদের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে। তাদের সঙ্গে আলাপের বিস্তারিত তথ্য জানালাম। আরো জানালাম দিল্লির বিশিষ্টজনরা আমাকে কী বলেছেন। ওসমানী সাহেব সোজা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের ঘরে ঢুকে উচ্চৈঃস্বরে বললেন, ‘You sold the country, I will not be a party to it.’ তাজউদ্দীন সাহেব কর্নেল ওসমানীকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, নিচু স্বরে কী বললেন আমি শুনতে পেলাম না। আমি দরজার বাইরে ছিলাম।
কয়েক দিন পরে উভয়ের মধ্যে পুনরায় বাগিবতণ্ডা ভারতীয় একটি প্রস্তাবনা নিয়ে। ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হলে আইন-শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য বেশ কয়েকজন ভারতীয় বাঙালি আইএএস ও আইপিএস বাংলাদেশের সব বড় শহরে একটা মেয়াদে অবস্থান নেবেন। ওসমানী সাহেব বললেন, ‘এটা হতে পারে না, আমাদের বহু বাঙালি সিএসপি, পিএসপি আছে। কেউ কেউ পাকিস্তানে আটকা পড়েছেন। এরা তো নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন।’
ওসমানী সাহেবের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের মতপার্থক্যের কথা জেনে ভারতীয়রা আরো সতর্ক হলেন। ওসমানী সাহেবকে কড়া নজরে রাখলেন। কাগজে-কলমে যৌথ কমান্ডের কথা থাকলেও বস্তুত তারা ওসমানী সাহেবকে একাকী করে দিলেন। ভারতীয়রা সব কমান্ড নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলেন। ওসমানী সাহেবের সঙ্গে ভারত কর্তৃপক্ষের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি হলো। (চলবে)
লেখক: গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন