সাইদ রহমান
প্রশ্ন দুটি। এক. বুদ্ধিজীবী কারা? দুই. বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী কারা? এটা আমাদের জন্য দূর্ভাগ্য যে, প্রশ্ন দুটির উত্তর আলাদা। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপারে সাধারণের মধ্যে যে ধারণা বিরাজমান তা অনেকটা এদেশের রাজনীতিবিদদের ব্যাপারে তাদের ধারণার কাছাকাছি। অর্থাৎ, প্রচলিত ধারণা হলো, এই গোষ্ঠিটি সুবিধাবাদী। দু-একটা ব্যতিক্রম নিয়ে এখানে কথা হচ্ছে না।
বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে বুদ্ধিজীবী অর্থ, ‘যারা বুদ্ধির বলে বা বুদ্ধির কাজ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে’। এটি অতি সরলীকরণ অর্থ। এই বাক্য দিয়ে বুদ্ধিজীবীদের চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব। যিনি একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করেন এবং নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে পণ্যের নতুন নতুন প্রচার কৌশল আবিস্কার করেন, সংজ্ঞা অনুযায়ী তিনিও বুদ্ধিজীবী হওয়ার কথা। কিন্তু নিশ্চয়ই আমরা তাকে বুদ্ধিজীবি হিসেবে মেনে নিতে পারি না।
কথা হচ্ছে, এই বুদ্ধিটা তিনি কার জন্য খরচ করবেন? কোন উদ্দেশ্যে খরচ করবেন? এর উত্তরে এসে পৃথিবীর অন্য সব বুদ্ধি খরচের উদ্দেশ্যের সাথে বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধি খরচ করার উদ্দেশ্যের একটা মৌলিক পার্থক্য দাড়িয়ে যায়। বুদ্ধিজীবীর থাকে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব, যা অন্যদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। পৃথিবীর কোনো দায়িত্বের মতো এটি ¯্রফে কোনো দায়িত্ব নয়। এই দায়িত্ব সমগ্র মানব জাতির অগ্রগতির সাথে, সভ্যতার অগ্রগতির সাথে জড়িত।
এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Representations of the Intellectuals’ বইয়ে বলেন, ‘বুদ্ধিজীবী হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি জনগণের প্রতি ও জনগণের জন্য সোচ্চার। আর সেই ব্যক্তি ছাড়া এই ভূমিকা পালন করা সম্ভব নয়, যে ব্যক্তি লজ্জাজনক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে সক্ষম। এ সকল ব্যক্তি সরকারি কিংবা অন্য কোনো কপোরেশনের সুবিধা বঞ্চিত হন।
তিনি আরও বলেন, এই গোষ্ঠিকে প্রচলিত বিশ্বাস ও সংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। প্রতিকুল পরিবেশ মোবাবিলা করার কারণে উদ্ভুত দু:খজনক ঘটনাগুলোকে একজন বুদ্ধিজীবীকে নিয়মিত ভুলে যেতে হয় এবং পায়ে দলে চলতে হয়। বুদ্ধিজীবী হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যার সাধারণ জনগনের কাছে গ্রহযোগ্যতা আছে এবং যার নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য একান্ত নিজের উপর নির্ভর করতে হয়। বুদ্ধিজীবীর প্রধান শর্ত হচ্ছে, সকল ধরনের ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের আনুগত্য থেকে আপেক্ষিক মুক্তিলাভ করা।’
বুদ্ধিজীবী কারা, জানতে আমরা আরও কয়েকজনকে হাজির করতে পারি। ফ্রান্সের বিখ্যাত দার্শনিক ও ঔপন্যাসিক জুলিয়েন বেন্দা The Betrayal of the Intellectuals বা ‘বুদ্ধিজীবীদের বিশ্বাসঘাতকতা’ নামক বইয়ে বলেন, ‘বুদ্ধিজীবীরা হচ্ছে একটি ক্ষুদ্র দল যারা মানবজাতির বিবেককে নিয়ন্ত্রন করে।’ তিনি প্রকৃত বুদ্ধিজীবীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘প্রকৃত বুদ্ধিজীবী খুব দুর্লভ এবং এরা সে সব বিষয়গুলো উন্মোচন করে, যেগুলো চিরন্তন সত্য ও ন্যায়বিচারের মানদন্ড।’ জুলিয়েন বেন্দা ‘প্রকৃত বুদ্ধিজীবী’র কথা বলেছেন। অর্থাৎ অপ্রকৃত বুদ্ধিজীবিও আছেন, তারা হলেন বুদ্ধিজীবীর ভেক ধরা কোনো গোষ্ঠি বা প্রতিষ্ঠানের দাস।
বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব কি?
এক্ষেত্রে এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদের মন্তব্য, ‘বুদ্ধিজীবীর প্রধান কাজ হলো প্রাসঙ্গিক বিষয়কে জনসম্মুখে নিয়ে আসা এবং স্পষ্ট করা; যে কোন জায়গায় এবং যে কোন সময় অদৃশ্য (শোসকগোষ্ঠীর) শক্তির ক্ষমতার বলয়কে চ্যালেঞ্জ করা এবং পরাজিত করা।’ জুলিয়েন বেন্দা বলেন, প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরা কখনোই ন্যায় ও সত্যের অনাকাঙ্খিত নীতির দ্বারা প্ররোচিত হয়ে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন না। তাঁরা দূর্নীতির নিন্দা জানায়, দুর্বলকে রক্ষা করে, অন্যায় ও শোষনমূলক শাসনের বিরোধীতা করেন।’
এসব হলো বুদ্ধিজীবীদের ঐতিহাসিক কর্তব্যের কথা। এই কর্তব্যের বিবেচনায় বাংলাদেশে কি কোনো বুদ্ধিজীবীর অস্তিত্ব আছে?
উত্তরটা হলো, নেই। যারা আছেন তারা বুদ্ধিজীবীর ভেক ধরা ‘উঞ্ছজীবী’। সামান্য খাদ্যের বিনিময়ে তাঁরা কোনো পার্টি বা গোষ্ঠিকে নিজেদের বুদ্ধি বন্ধক দেন। পারফরমেন্স বিবেচনায় এদের মধ্যে কেউ কেউ সময়মতো মঞ্জিলে মকসুদে পৌছে যান মন্ত্রীত্ব কিংবা একটা উপদেষ্টার পদ, নিদেনপক্ষে কোনো পরিচালক কিংবা উপ-পরিচালক। এছাড়াও রয়েছে বিবিধ পুরস্কার, ঘন ঘন বিদেশ যাত্রাসহ আকর্ষণীয় গিফট।
বুদ্ধিজীবীদের যুদ্ধ করতে হবে ক্ষমতার বিপক্ষে। এদেশের মানুষের ট্রাজেডি হলো, এদেশের বুদ্ধিজীবী নামধারীরা উল্টো এদেশের মানুষের বিপক্ষেই যুদ্ধ করেন। কারণ, পৃথিবীর আদি থেকে সব ক্ষমতা স্বভাবতই দুর্ণীতির দিকে ধাবিত, তাই ক্ষমতার পক্ষে কাজ করা মানেই গণমানুষের বিপক্ষে কাজ করা। ক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখোমুখি না করে ‘ক্ষমতাহীন’ মানুষের পক্ষে কীভাবে কাজ করা সম্ভব?
বলা বাহুল্য, এদেশে জনগনের ক্ষমতার যে কথা বলা হয় সেটা কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই।
বলা হয়, সাংসদরা জনপ্রতিনিধি। বটে, তারা জনপ্রতিনিধি হয়ে আসেন কিন্তু আসার পর নিজের এবং নিজের আত্মীয়-স্বজনের প্রতিনিধিত্ব করেন। এই ফাঁকে আমজনতা হয়ে পড়ে প্রতিনিধিত্বহীন। এই প্রতিনিধিত্বহীনদের প্রতিনিধিত্ব করাই বুদ্ধিজীবীর কাজ। কিন্তু এদেশে তার উল্টোটিই ঘটছে!
রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন কিংবা জাতি-জনগোষ্ঠীর উপর নির্যাতন-নিপীড়নের বিরোধিতা করতে গিয়ে জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় জেল খেটেছেন ‘জেলখানার কবি’ নাজিম হিকমত। ভারতে কিছুদিন আগে রীতিমতো এক নিরব বিপ্লব ঘটে গেল ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ভাবমর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ার কারণে ভারতের লেখক-বুদ্ধিজীবীরা প্রাপ্ত পদক ও সম্মাননা ফেরত দিয়েছেন। পৃথিবীর নানা প্রান্তের এমন বেশুমার উদাহরন দেয়া সম্ভব। কথা হলো, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর গণতন্ত্র আমাদের দেশেও হুমকির সম্মুখীন। এবার বলুন, আমাদের দেশে কি কোনো বুদ্ধিজীবী আছে?
বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংকট কী?
নানা দিক থেকে নানা উত্তর করা যেতে পারে। তবে ‘বুদ্ধিজীবীদের নিস্ক্রিয়তা’ যে সবচেয়ে বড় সংকটগুলোর একটি এ ব্যাপারে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। পাঠক নিশ্চয়ই একমত হবেন, বাংলাদেশের রাজনীতি জন-কল্যাণের দিকে নির্দেশিত নয়, বরং তা পরিচালিত হচ্ছে ব্যক্তিগত ও দলীয় লাভালাভের বিবেচনায়। বুদ্ধিজীবীদের কাজ ছিল এই রাজনীতিকে জন-কল্যাণের দিকে ঘুরিয়ে দিতে প্রচেষ্টা চালানো। কিন্তু উল্টো তারা সেই ভুল পথকে মসৃণ করতে সেখানে আরও ঘি ঢেলে চলেছেন!
দরবারে দাস্যবৃত্তি দিন দিন বেড়েই চলেছে। ক্ষমতার সামনে ষাষ্টাঙ্গে বশীভূত হয়ে চলে বিবিধ বৈষয়িক সাধ পূরণের চেষ্টা। এদেশে বুদ্ধিজীবীর মানেটা একটু অন্যরকম ‘যিনি বুদ্ধি দিয়ে লেজুড়বৃত্তি করেন!’ তাই এদেশে এখন শুধু বুদ্ধিজীবী বলে কিছু নেই, আছেন অমুক পন্থী বুদ্ধিজীবী-তমুক পন্থী বুদ্ধিজীবী।
স্মর্তব্য যে, কোনো এক নির্বাচনকে সামনে রেখে এদেশে স্বঘোষিত দলদাস বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা এক হাজার একশতে গিয়ে ঠেকেছিল। এক দলের একশত হলে আরেক দলের সহ্য হবে; এক দলের দশ সহ¯্র হলে আরেক দলের এক লক্ষ হবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। দাস সৃষ্টিতে এ দেশ কখনই তেমন নিষ্ফলা ছিল না।
এদেশে বুদ্ধিজীবী হওয়ার ক্ষেত্রে একেক সময়ে একেক রকম চেষ্টার প্রয়োজন হয়। এই মুহুর্তে সোজা পথটি হলো, সরকারকে সমর্থন দেয়ার পাশাপাশি ক্রমাগত ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি বলে যাওয়া। এই বটিকা অনুযায়ী যে কেউ চেষ্টা করে যেতে পারেন, বিফলে মূল্য ফেরত। চেষ্টা অবশ্য থেমে নেই, হাল আমলে এই পথে অনেকেই এখন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী সেজেছেন।
আহমদ ছফার কথা মনে পড়ে ‘আমাদের দেশে যারা মৌলবাদী তারা শতকরা একশ ভাগ মৌলবাদী। কিন্তু যারা নিজেদেরকে প্রগতিশীল বলে দাবী করে তাদের কেউ কেউ দশ ভাগ প্রগতিশীল, পঞ্চাশ ভাগ সুবিধাবাদী, পনেরো ভাগ কাপুরুষ, পাঁচ ভাগ একেবারে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন।’
অনেকেই হয়তো বলবেন, সরকারের বিরুদ্ধে কথা তো হচ্ছে। তা কিছুটা হচ্ছে বটে কিন্তু তারা তো ...তমুক পন্থী বুদ্ধিজীবী। তারা অপেক্ষা করে আছেন অন্য কোনো সরকারের স্তুতি করার জন্য। তাই বলছি, ক্ষমতার বিরুদ্ধে আমাদের কোনো বুদ্ধিজীবি নেই। বড়জোর দলের বিরুদ্ধের বুদ্ধিজীবি আছেন, তাও অন্য একটা দলের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন বলে। আমরা হয় সরকারের স্তুতি শুনি না হয় শুনি বিষোদ্গার।
১৪ ডিসেম্বর আসলে আমরা হাহাকার করি, আমাদেরকে বুদ্ধিজীবীশুন্য করা হয়েছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের কোনো ভাবান্তর নেই যে, অন্য কেউ খুন করার আগেই আমাদের বর্তমান বুদ্ধিজীবীরাও মৃত (যেহেতু তাদের বিবেক মৃত)। বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় একটি উক্তি আছে এমন ‘বুদ্ধিজীবী রুদ্ধ ঘরে সঙ্গীহীন/আত্মরতির সম্মোহনে কাটায় দিন।’
বর্তমান বুদ্ধিজীবীরা আত্মবিক্রির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। আপসকামিতায় আকীর্ণ তাদের জীবন। ইদানিংকালে তাদেরকে রাজনীতিবিদদের মতো ডিগবাজি দিতেও দেখা যায়! বুদ্ধিজীবীতায়ও এখন শেষ কথা বলে কিছু নেই। এখানেও আহমদ ছফাকে হাজির করতে হয়। তিনি বলেছিলেন, ‘একাত্তরে বুদ্ধিজীবীরা যা বলেছিলেন, তা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না। আর এখন যা বলেন তা শুনতে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়াতে পারবে না।’
‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ বইয়ে আহমদ ছফা এদেশের বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে অনেক তেতো সত্য উচ্চারণ করেছেন। ছফার মতে, ‘আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন বিশ্বাসের কারণে নয়, প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন, সেও ঠেলায় পড়ে।’ বুদ্ধিজীবীদের তিনি সুবিধাবাদী হিসেবেই বিচার করেছেন। এদেশে তাঁদেরকে মাঝে মাঝে যে কিঞ্চিৎ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় সেটি ‘পোশাকি ভূমিকা’।
এই ভূমিকা গণমানুষের বিশেষ কোনো কাজে আসে না। বুদ্ধিজীবীরা গণমানুষের ‘ভ্যানগার্ড’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে না পারলে কোনো রাজনৈতিক ভিশনেই জাতি উঠে দাড়াতে পারবে না।
সাইদ রহমান : সাংবাদিক, কলাম লেখক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন