গোলাম মাওলা রনি
আপনার কাছে কোনো দিকদর্শন যন্ত্র না থাকায় এবং ঘন কুয়াশায় আকাশের নক্ষত্র দেখতে না পারার কারণে আপনি পূর্ব-পশ্চিম বা উত্তর-দক্ষিণ কিছুই আন্দাজ করতে পারছেন না। এ অবস্থায় আপনার গন্তব্য কোথায় বা আপনি কখন গন্তব্যে পৌঁছবেন, এমন প্রশ্নের যে জবাব আপনি দেবেন, ঠিক সে জবাবটিই বসিয়ে দিতে পারেন আমাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের প্রশ্নটির উত্তরপত্রে
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে দেশবাসীর আবেগ-উচ্ছ্বাস ও শঙ্কা-আশঙ্কার শেষ নেই। জনারণ্যে কেউ কারো সাথে দেখাসাক্ষাৎ কিংবা কুশল বিনিময়ের পরপরই দেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে প্রায়ই একজন অন্যজনকে নানারকম কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন করে থাকেন। রাজনীতির হালচাল ও ভূতভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষের প্রশ্নের ধরন অনেকটা এমন- আগামী সংসদ নির্বাচন কি নিরপেক্ষ হবে, নাকি ৫ জানুয়ারির মতোই একতরফা হবে? বেগম জিয়ার মামলার খবর কী? নির্বাচনের আগে সরকার অবশ্যই ওইসব মামলায় বেগম জিয়ার জেল দিয়ে দেবে- তাহলে বিএনপি কি নির্বাচনে আসবে? জামায়াত ও জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত কী করবে, কারণ এ দুই পার্টির ওপরই রাজনীতির সমীকরণ নির্ভর করছে। ভারত কি আগের মতো আওয়ামী লীগকে সমর্থন করবে, নাকি এ দেশে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর মতো ভারতও সক্রিয় ভূমিকা রাখবে?
যেরূপ ইচ্ছেমতো প্রশ্ন করা হয়, তদ্রুপ উত্তরদাতারাও নিজেদের পছন্দ ও বিশ্বাসমতো নানারূপ মন্তব্য করে থাকেন। সরকার সমর্থকেরা মনে করেন, ভারত তাদের অকৃত্রিম বন্ধু এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে তারা আওয়ামী লীগের পক্ষে থাকবেন। আগামী সংসদ নির্বাচনে জয়-পরাজয়, ভোট, প্রতিদ্বন্দ্বিতা- এসব নিয়ে সরকারি দলের লোকজনের খুব একটা মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।
গত ৯টি বছর একাদিক্রমে ক্ষমতায় থেকে তাদের মধ্যে দুটো বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়েছে- প্রথমত, ক্ষমতায় আরোহণ, ক্ষমতা ভোগ ও ক্ষমতা প্রয়োগই তাদের নিয়তি। দ্বিতীয়ত, সব বিষয় প্রধানমন্ত্রী জানেন। তিনি খুব ভালো করেই জানেন কিভাবে আগামীতেও পুনরায় ক্ষমতায় আসা যাবে। রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠনের যে বিরল অভিজ্ঞতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে, তার সেই অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও কৌশলকে মাতৃক্রোড় বিবেচনা করে সরকারি দল নিশ্চিন্তে পুনরায় ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণের জন্য অপেক্ষা করে আছে।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপিতে রয়েছে বর্তমান রাজনীতি নিয়ে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া। দলের বড় একটি অংশ মনে করে, রাজনীতি একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং সদাপরিবর্তনশীল। যুদ্ধের ময়দানে যেমন ক্ষণে ক্ষণে নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং নবতর রণকৌশলের দরকার পড়ে; তেমনি রাজনীতির ময়দানেও পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যুদ্ধের ময়দানের তুলনায় রাজনীতির ময়দান অধিকতর জটিল, কঠিন, দুরূহ ও দুর্বোধ্য। কারণ, যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতিকে জনগণের মনমানসিকতা ও ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার কথা চিন্তা করতে হয় না। অন্য দিকে, রাজনীতির ময়দানে যুদ্ধকৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের আগে জনগণের কথা ভাবতে হয়। কাজেই এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় যে আপসহীন মনোভাব দেখিয়ে সফলতা পাওয়া গিয়েছিল, সেটি বর্তমান বাস্তবতায় সম্ভব না-ও হতে পারে। অন্য দিকে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের বাস্তবতা যে ২০১৮ সালে একেবারেই নেই, সে কথাও বিএনপি ঘরানার বেশির ভাগ লোক মনে করেন।
বিএনপির মধ্যে ‘কট্টরপন্থী’ একটি গ্রুপ রয়েছে, যারা যেকোনো মূল্যে তাদের অতীত আপসহীন দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে চান না। তাদের মতে, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়া অনেকটা আত্মহত্যার মতো পরিণতি বয়ে আনবে। কারণ, নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপির কোনো দাবিদাওয়া, ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা ইত্যাদি আদায় না করে সরকারের ইচ্ছানুযায়ী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে আগামীতে তিনটি নিশ্চিত পরিণতির জন্য বিএনপিকে মনস্থির করতে হবে।
প্রথমত, এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচনে যাওয়ার অর্থই হলো- আওয়ামী লীগকে টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় বসানোর জন্য একটি সহায়ক শক্তিতে পরিণত হওয়া। দ্বিতীয়ত, একটি নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও তুমুল প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর ফাঁদে পা দিয়ে দলটিকে দেশ-বিদেশে সুনাম-সুখ্যাতির স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দেয়ার রাবার স্ট্যাম্প হিসেবে বিএনপিকে কাজ করতে হবে। তৃতীয়ত, বিএনপি যদি নির্বাচনী ফাঁদে পা দেয়, তবে ভাগ্য খারাপ হলে সংসদে প্রধান বিরোধী দলের পরিবর্তে অন্যতম বিরোধী দল বলে গণ্য হতে হবে। ফলে বিএনপির পরিণতি রূপকথার অলৌকিক পতনের চেয়েও করুণ ও মর্মান্তিক হয়ে পড়বে এবং মুসলিম লীগের পরিণতি বরণ করে জাদুঘর ও ইতিহাসের পাতায় স্থান পেতে হবে।
বিএনপির মধ্যে নিয়তিবিশ্বাসী ও আশাবাদী লোকের সংখ্যাও কম নয়। তারা মনে করেন, বিএনপি বিগত দিনে প্রতিবার অলৌকিক কারণে ক্ষমতায় আরোহণ করেছে। বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীনদের দুর্বলতা, অক্ষমতা, দুর্নীতি, অবিচার ইত্যাদির কারণে সরকারগুলো আপন ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পতিত হয়েছিল এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিয়তিই বিএনপিকে জায়গা করে দিয়েছিল ক্ষমতার মসনদে বসার জন্য।
সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়ার ক্ষমতারোহণ এবং বেগম জিয়ার ক্ষমতালাভের সময় আসমানের গ্রহ-নক্ষত্র বিরাট সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। অতীতের সেই ধারাবাহিকতায় বিএনপির ভাগ্যাকাশের বৃহস্পতি, ইউরেনাস ও মঙ্গল স্ফীত হয়ে খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে। ফলে বিএনপির ক্ষমতালাভ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কারণ, এভাবে চলতে পারে না। বর্তমান সরকার যেভাবে চলছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো দেশে কোনো কালে দীর্ঘমেয়াদে চলেনি বা একই দেশে দ্বিতীয়বার ঘটেনি। জমিনে আল্লাহই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। কোনো জনপদে যদি মন্দ দৃষ্টান্ত স্থায়ী রূপ পেয়ে যায়, তবে লোকজন শুভকর্ম বাদ দিয়ে মিছিল করে মন্দের কাফেলায় যোগ দিতে একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করবে।
বিএনপির উপরিউক্ত ত্রিমত এবং সরকারদলীয় অভিন্ন মতের বাইরে জাতীয় পার্টি, জামায়াত, যুক্তফ্রন্ট ও বাম দলগুলো মূলত শেষ সময়ের রাজনৈতিক মেরুকরণ, পরিবেশ পরিস্থিতি এবং জনমতের দিকে তাকিয়ে বুদ্ধিমানের মতো চুপচাপ রয়েছে। তারা মাঝে মধ্যে বক্তৃতা-বিবৃতির বাণ ছুড়ে বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া অনুধাবনের চেষ্টা করছেন। সরকারি দলের সাথে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক ঐক্য, বিএনপির সাথে জামায়াতের গাঁটছড়া এবং ঐতিহ্যগতভাবে বাম দলগুলোর বিএনপি বর্জন, শেষ পর্যন্ত বহাল থাকবে কি না তা যেমন কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না; তেমনি এমনটি যে অতীতের মতো অবিকল থাকবে তা-ও কেউ বিশ্বাস করছে না। কারণ, দেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অভ্যন্তরীণ মান-অভিমান, তুচ্ছতাচ্ছিল্য এবং একে অপরকে হেয় করার যে কাণ্ডকারখানা প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে বহু শতবার ঘটেছে; তাতে আগামীতে তাদের ঐক্যের ব্যাপারে সন্দেহ করাই স্বাভাবিক।
আওয়ামী লীগের কর্তাব্যক্তিরা জাতীয় পার্টিকে বগলদাবা করতে গিয়ে ভুলে যান, দলটি টানা ৯ বছর দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশ শাসন করেছে। অন্য দিকে, বিএনপিও ভুলে যায় যে, জামায়াত ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন দল। আন্তর্জাতিকভাবে সংগঠিত এবং স্থানীয়ভাবে শপথের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ একটি রাজনৈতিক বিশ্বাস ও শক্তি। এর বাইরে বাম দলগুলোর ব্যাপ্তি জামায়াত ও জাতীয় পার্টির মতো না হলেও দলগুলোর নীতি, আদর্শ ও বিশ্বাস নিয়ে কটাক্ষ করার কোনো সুযোগ নেই।
অধিকন্তু, বাম দলগুলোর নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক জ্ঞান, দলের জন্য ডেডিকেশন ও ডিভোশন এবং সর্বোপরি, ব্যক্তিত্ব দেশের গতানুগতিক রাজনৈতিক ধারা থেকে ব্যতিক্রম এবং অনেকের কাছে প্রশংনীয়। কাজেই তাদেরকে পণ্যের মতো ক্রয় অথবা ইচ্ছেমতো ব্যবহার করা যাবে- এমন অর্বাচীন চিন্তা দেশের রাজনীতির প্রধান নীতিনির্ধারকেরা করেন না বলেই বিশ্বাস করি।
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে জনমনের নানামুখী প্রশ্ন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, আগামী দিনের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ কোনো কথা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।
আমরা হয়তো সবাই জানি, রাজনীতির একটি চিরায়ত আদর্শ ও অনাদিকালের ব্যাকরণ রয়েছে। কোনো দেশ-কাল, সমাজ ও রাষ্ট্র যখন রাজনীতির নীতি-আদর্শ ও ব্যাকরণ মেনে স্বাভাবিক নিয়মে চলে, তখনই সেখানে সৃষ্টি হয় অনুসরণীয় সভ্যতা, প্রতিষ্ঠা পায় ভব্যতা, মানবতা এবং দৃশ্যমান হয় দেশ-জাতি ও সমাজের কুলীনতা। পৃথিবীর অনেক বড় বড় সাম্রাজ্য, রাজবংশ, শাসক দল ও গোষ্ঠী অত্যন্ত সফলতার সাথে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দেশ পরিচালনার ইতিহাস সৃষ্টি করতে পেরেছিল তত দিন পর্যন্ত, যত দিন তারা রাজনীতির ব্যাকরণ মেনে চলেছে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি, রাষ্ট্র পরিচালনা ও শাসনপদ্ধতি কোন কালের কোন ব্যাকরণ অনুযায়ী চলছে, তা বর্তমানের শাসক দল দেশী-বিদেশী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, জ্ঞান-বিজ্ঞানের পুরোধা ও ইতিহাসবিদদের কাছে স্পষ্ট করতে পারেনি। ফলে চলমান সময়টি মহাকালের ইতিহাসে এমন একটি নজির সৃষ্টি করবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে, আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম এবং অনির্দিষ্ট গন্তব্যের পানে ছুটেছিলাম।
ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে অনেকে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। আমি স্বাভাবিকভাবে বলি- আসলে কিছুই জানি না। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলার মতো কোনো জ্ঞান আমার নেই। তবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাকে যে অতি সামান্য জ্ঞান দিয়েছেন তাতে বুঝতে পারছি, আমরা রাজনীতির সঠিক পথে নেই এবং সে পথে ওঠার কোনো চেষ্টাও করছি না। আমাদের রাজনৈতিক গন্তব্য কেমন হতে পারে, তা বোঝানোর জন্য সাধারণত একটি উদাহরণ দিয়ে থাকি।
ধরুন, আপনি সড়কপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম রওনা করেছেন। চলতিপথে দাউদকান্দি গিয়ে আপনি পড়ন্ত বিকেলে মনের আনন্দে ইচ্ছে করে অথবা ব্রেক ফেল করে নিজের ড্রাইভ করা গাড়িটি ফসলি জমিতে নামিয়ে দিলেন অথবা গাড়িটি সেখানে পতিত হলো। এরপর আপনি পুনরায় গাড়িটি মহাসড়কে উঠানোর ব্যবস্থা না করে ফসলি জমির মধ্য দিয়ে চালাতে আরম্ভ করলেন এবং মনে মনে ভাবলেন- এটাই ভালো, আশপাশে গাড়ি নেই, হর্ন নেই, দুর্ঘটনার আশঙ্কা নেই। এভাবে চলতে চলতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে এলো। প্রচণ্ড কুয়াশা পড়ল, বুঝতে পারলেন না আপনি কোথায় রয়েছেন।
এমনকি আপনি কি চট্টগ্রাম অভিমুখে এগোচ্ছেন, না বিপরীত দিকে ঢাকার পথে ফিরছেন, তাও বুঝতে পারছেন না। আপনার কাছে কোনো দিকদর্শন যন্ত্র না থাকায় এবং ঘন কুয়াশায় আকাশের নক্ষত্র দেখতে না পারার কারণে আপনি পূর্ব-পশ্চিম বা উত্তর-দক্ষিণ কিছুই আন্দাজ করতে পারছেন না। এ অবস্থায় আপনার গন্তব্য কোথায় বা আপনি কখন গন্তব্যে পৌঁছবেন, এমন প্রশ্নের যে জবাব আপনি দেবেন, ঠিক সে জবাবটিই বসিয়ে দিতে পারেন আমাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের প্রশ্নটির উত্তরপত্রে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন