আবদুল লতিফ মন্ডল
সম্প্রতি একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তার দল কোনো শর্ত দিয়ে সংলাপে বসতে চায় না। তাছাড়া তিনি সাক্ষাৎকারে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার উপযোগিতা, বিএনপির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোটবদ্ধতা, আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির আশাবাদ, নির্বাচনী সহায়ক সরকারের রূপরেখা প্রদান, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ইত্যাদি বিষয়ে তার মতামত ব্যক্ত করেছেন। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রশ্নে তিনি বলেছেন, আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি আরও প্রকট হওয়ায় নির্দলীয় সরকারব্যবস্থার উপযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিএনপির দশম সংসদ বর্জন প্রশ্নে তিনি বলেছেন, তখন সুপরিকল্পিতভাবে এমন একটা অবস্থা তৈরি করা হয়, যাতে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করে। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটবদ্ধতা প্রসঙ্গে তার বক্তব্য হল, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নির্বাচনী অংশীদারিত্বের কোনো চুক্তি নেই। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার চুক্তি আছে।
আগামী সংসদ নির্বাচন অবাধ হলে তার দল জাতীয় সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করবে বলে তিনি তার সাক্ষাৎকারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। নির্বাচনী সহায়ক সরকারের রূপরেখা প্রদান প্রশ্নে তিনি বলেছেন, সব হোমওয়ার্ক প্রস্তুত। তার দল ক্ষমতায় গেলে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম বন্ধ করবে বলে তিনি সাক্ষাৎকারে নিশ্চয়তা দিয়েছেন।
দশম সংসদ নির্বাচনের আগে মূলত যে বিষয়টি নিয়ে বড় দু’দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা হয়নি তা হল সংসদ নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর ১৯৯১ সালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের শাসনামলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে সরকার গঠন করলে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অনিয়ম ও ভোট কারচুপির অভিযোগ আনে এবং অন্য দুটি বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে সংসদ নির্বাচনকালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। দাবির মুখে বিএনপি সরকার ১৯৯৬ সালের মার্চে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। এ সরকার পদ্ধতির অধীনে তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আগের মেয়াদে (২০০৯-১৩) এ ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটানো হয়। এতে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। সংসদ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ সরকারকে দাবি মানাতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোট এবং জোটের বাইরে ৯টি সমমনা দল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলে ওই নির্বাচন অংশগ্রহণহীন নির্বাচনে রূপ নেয়। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন পেয়ে পুনরায় সরকার গঠন করলে দেশে গণতন্ত্র পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
বিএনপি সংসদ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারব্যবস্থার দাবি থেকে কিছু সময়ের জন্য সরে এসে নির্বাচনী সহায়ক সরকারের কথা বলেছিল। দলটি দেশবাসীর কাছে সহায়ক সরকারের রূপরেখা উপস্থাপনের কথা বললেও এ যাবৎ তারা তা উপস্থাপন না করে পুনরায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবিতে ফিরে এসেছে এবং এ দাবিতে তারা অনড় রয়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের সম্ভাবনাকে একাধিকবার নাকচ করে দিয়েছে। সর্বশেষ গত ৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচন নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে অংশ নেয়া সব রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। তাতে কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে নেবে, না নিলে না নেবে, সেটা তাদের দলের সিদ্ধান্ত, আমাদের কিছু বলার দরকার নেই।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালে ক্ষমতাসীন দল ও সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দলের এরূপ সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান আবার দেশে সহিংসতা-সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে ভেবে জনগণ দুশ্চিন্তা ও শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। কারণ দেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দলের সহিংসতা-সংঘাত কী ভয়ানক হতে পারে তা তারা ইতিপূর্বে দেখেছে। দীর্ঘ আড়াই দশকের বেশি সময় ধরে জনগণ দুই বড় দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের হিংসাত্মক রাজনীতি দেখে আসছে। তারা দেখেছে, ১৯৯৪-৯৫ সালে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে কীভাবে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল এবং এতে দেশের অর্থনীতি কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। জনগণ দেখেছে, ২০০৬ সালের শেষদিকে ইয়াজউদ্দীন আহম্মদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ ২০০৭ সালে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়ার পর কীভাবে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যা শেষ পর্যন্ত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতায় আসাকে সহজ করে তোলে। জনগণ দেখেছে, অংশগ্রহণহীন দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি শুরু করে এবং অবরোধকে জোরদার করতে ঘন ঘন হরতাল কর্মসূচির ডাক দেয়। এ সময় সহিংসতায় দেশের অর্থনীতি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অনেক তাজা প্রাণ ঝরে পড়ে।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে চলমান জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া বিরোধী দলগুলোর আরকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবিতে পরিণত হয়েছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় সংসদ বহাল রেখে সংসদ নির্বাচনের বিতর্কিত বিধান প্রবর্তন করে। এতে বলা হয়, মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে আরও বিধান করা হয় যে, সংসদের মেয়াদ অবসানের পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকালে সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ পদে বহাল থাকবেন। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংলাপে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দেয়। তারা যুক্তি দেখান, যেসব দেশে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চালু রয়েছে, সেসব দেশে জাতীয় সংসদ বহাল রেখে সংসদ নির্বাচনের বিধান নেই। সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুসারী হয়ে বাংলাদেশ এমন কিছু করতে পারে না যা বিশ্বে প্রচলিত সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে বেমানান।
আগামী সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু করতে উপর্যুক্ত ইস্যুগুলোকে বড় সমস্যা হিসেবে মেনে নিয়ে তা সমাধানে সরকারকেই পথ খুঁজতে হবে। বিএনপি এবং জাতীয় সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা সে পথের সন্ধান দেবে। বিএনপি পূর্বশর্ত ছাড়াই সংলাপে বসতে রাজি আছে। এটি নিঃসন্দেহে আলোচনা অনুষ্ঠানের জন্য একটি শুভ লক্ষণ। তাই কোনোরকম শর্ত ছাড়াই আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল আলোচনার টেবিলে বসে আলোচ্যসূচি ঠিক করুক। এতে শুভ ফল আসবেই।
সব ক্ষেত্রে না হলেও আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের নজির আমাদের আছে। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে গণআন্দোলনে তৎকালীন সরকারের পতন হলে ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সরকার ও বিরোধী দলের সমঝোতায় ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বরে সংবিধান সংশোধনের (দ্বাদশ সংশোধন) মাধ্যমে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পুনর্বহাল করা হয়। অবসান ঘটে রাষ্ট্রপতি সরকার পদ্ধতির। চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল পূর্বশর্ত ছাড়াই আলোচনায় বসে আগামীতে একটি অংশগ্রহণমূলক ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছতে পারলে তা ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আরেকটি উদাহরণ সৃষ্টি করবে।
সবশেষে যা বলতে চাই তা হল, দেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা, আন্তর্জাতিক মহলের সুপারিশ এবং সর্বোপরি গণতন্ত্রের যাত্রা অব্যাহত রাখতে একটি অংশগ্রহণমূলক ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এটি করতে নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলকে পূর্বশর্ত ছাড়াই সংলাপে বসে খোলা মন নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছতে হবে। এর বিকল্প নেই। আর এ সংলাপের উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন