গোলাম মোর্তোজা
‘উন্নয়ন’ ভাষণে জননিরাপত্তা ও মানব উন্নয়ন অনুপস্থিত
রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ টানা নয় বছর ক্ষমতায় থাকল। নিশ্চিত করেই বলা যায়, কমপক্ষে আরও এক বছর থাকবে। স্বৈরাচার এরশাদের পর এই প্রথম কোনো সরকার টানা নয় বছর ক্ষমতায় থাকল। দ্বিতীয় মেয়াদে বড় রকমের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে সরকার গঠন করলেও, স্বীকার করতে হবে শেখ হাসিনা একটি রাজনৈতিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী।
যদিও দেশ পরিচালনায় রাজনীতি এবং জনগণ বাদ দিয়ে, প্রায় পুরোপুরি প্রশাসনের উপর নির্ভর করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজনৈতিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘একক পরিচালক’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। এমন অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। সেই ভাষণের প্রেক্ষিতে কিছু প্রসঙ্গ এবং পর্যালোচনা।
০১.
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণটি সুলিখিত, সুপঠিত। তার সরকারের এই চার বছরের কর্মকান্ডের মধ্যে সীমিত থাকেননি। নয় বছরের সাফল্যের বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। ভাষণে প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তার অবস্থান থেকে সেটাই বলার কথা। এর মধ্যে নতুনত্বের কিছু নেই। ‘উন্নয়ন’ বলতে বর্তমান সরকার যা বিশ্বাস করে, যা করেছে, প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে সেটাই বলেছেন। এটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক বা আলোচনা-সমালোচনা, থাকবে, সেটাও অস্বাভাবিক নয়। তবে বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে ভাষণে যে সমস্ত বিষয় প্রত্যাশিত ছিল, তেমন অনেক বিষয়ের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করেছি। যেমন-
ক. এদেশে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ সংগঠিত হয়েছিল। সাধারণ জনমানুষের অর্থ নানা কৌশলে কিছু সংখ্যক বিত্তবান আত্মসাত করেছিল। এই বিত্তবানদের অনেকে শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সরকার কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টেই তার প্রমাণ মিলেছিল। অধিকতর তদন্ত করে বিষয়টি সামনে আনা হয়নি। চিহ্নিত দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা বা জনমানুষের অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়নি। ধারণা করা হয়, এক্ষেত্রে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি আত্মসাত করা হয়েছে। বিদেশে পাচার করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণে এত বড় অর্থ কেলেঙ্কারি নিয়ে কোনো কথা নেই।
খ. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে সরকার সব সময় গর্ব করে। রেকর্ড পরিমাণ রিজার্ভ, এক্ষেত্রে সরকারের অবদান কতটা তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, গর্ব সরকার করতেই পারে। তাদের সময়েই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরির মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। তদন্তও একটা হয়েছে। কয়েকবার দিন তারিখ ঠিক করেও সেই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। কাকে বা কাদেরকে যেন বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। চুরি হয়ে যাওয়া অর্থ ফিলিপাইন থেকে ফেরত পাওয়ার প্রায় কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু দেশের মানুষকে বলা হচ্ছে অর্থ ফেরত আনা হবে। অর্থ ফেরত আনার আগে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে না। একটার সঙ্গে আরেকটির কোনো সম্পর্ক না থাকলেও, একটা দিয়ে আরেকটা চাপা দেয়া হচ্ছে। এত বড় অঘটন নিয়েও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে কিছু উল্লেখ করেননি।
গ. ব্যাংকসহ আর্থিকখাতের ঋণ জালিয়াতির নামে লুটপাটের বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে গুরুত্ব পায়নি। সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংকসহ আরও কিছু রাষ্ট্রায়ত্ব মানে জনগণের ব্যাংক চুরি-লুট করে প্রায় দেউলিয়া করে দেয়া হয়েছে। তার দলের নেতার নেতৃত্বে ফারমার্স ব্যাংকে দৃশ্যমান লুটপাট হয়েছে। এসব বিষয়ের প্রতিফলন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে দেখা যায়নি।
ঘ. প্রতি বছর খেলাপি ঋণের পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা করে বাড়ছে। খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার উপরে। এর মধ্যে ৪৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি ফেরত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কেন ভয়ঙ্কর আকারে বাড়ছে, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কিছু বলেননি।
ঙ. সরকারের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্প পদ্মাসেতু। বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির ষড়যন্ত্র বিষয়ক অভিযোগ সরকার যোগ্যতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছে। দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়নি, প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। পদ্মাসেতু এখন দৃশ্যমান হয়েছে। নতুন কিছু টেকনিক্যাল জটিলতা দেখা দিলেও পদ্মাসেতু নির্মিত হবে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
প্রশ্ন হলো, পদ্মাসেতুর বাজেট প্রথমে ছিল ১০ হাজার কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত বেড়ে তা ৩০ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। কোনো নির্মাণ সামগ্রির দামই গত আট দশ বছরে এতটা বাড়েনি। অথচ একটি পদ্মাসেতুতে ব্যয় করা হচ্ছে তিনটি পদ্মাসেতুর অর্থ। এই বাজেট আরও ১০ হাজার মানে আরেকটি সেতু নির্মাণের সমপরিমাণ বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। কেন বাজেট তিন চার গুণ বাড়ল বা বাড়ছে, প্রধানমন্ত্রী ভাষণে তা বলেননি।
চ. রূপপুর নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্রের নিরাপত্তা বিষয়ক বিতর্ক বাদ দিয়েও যদি আলোচনা করি, তবে বাজেটের প্রসঙ্গ আসে। শুরুতে এই নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্রের বাজেট ছিল ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি ডলার। এখন তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ১৪০০ কোটি ডলার। রাশিয়ার যে প্রযুক্তিতে নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্র নির্মিত হতে যাচ্ছে, সেই প্রযুক্তির দাম বাড়েনি। তাহলে বাজেট কেন প্রায় ১ হাজার কোটি ডলার বাড়ল? প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে রূপপুর নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্র নিয়ে কথা থাকলেও, অবিশ্বাস্য অঙ্কের বাজেট বৃদ্ধি বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেই। উল্লেখ্য ১ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি পরিমাণ অর্থ রাশিয়ার থেকে এই প্রকল্পে ঋণ নেয়া হচ্ছে। যে ঋণ বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হবে ৩ থেকে ৪ শতাংশ সুদসহ।
০২.
গুম-অপহরণ যে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে সে বিষয়েও কোনো উদ্বেগ লক্ষ্য করা যায়নি। ‘উন্নয়ন’ বলতে শুধু অবকাঠামোগত নির্মাণকেই বোঝানো হচ্ছে। মানুষের জীবনের ‘নিরাপত্তা বা উন্নয়ন’ বিষয়টি সরকারের কাছে মোটেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে না।
অবকাঠামো নিজে কোনো ‘উন্নয়ন’ নয়। অবকাঠামো ‘উন্নয়ন’র সহায়ক। সেই কারণে অবকাঠামো নির্মাণ খুব জরুরি। কিন্তু তার আগে অনেক বেশি জরুরি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা এবং মানবসম্পদের উন্নয়ন। সরকারের বিবেচনায় মানবসম্পদ উন্নয়ন সবচেয়ে বড়ভাবে অবহেলিত। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও মানবসম্পদ উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি।
০৩.
মানবসম্পদ উন্নয়ন’র প্রধান মাপকাঠি শিক্ষা। যে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষরতার হারের সাফল্য দাবি করেছেন। বিনামূল্যে বই পৌঁছানোটাও কৃতিত্বের কাজ, সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্নফাঁস একটা সার্বজনীন বিষয়ে পরিণত করে, স্বাক্ষরতা যে কোনো কাজে আসবে না, তা বিবেচনা করছে না সরকার। শিক্ষার মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে দুই শিক্ষামন্ত্রী রসিকতার পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। ভাষণে এ বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী কিছু বলেননি।
০৪.
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা সরকার সব সময় বলে, প্রধানমন্ত্রী ভাষণেও বলেছেন। যে চালের কেজি ভারতে ৩৪ থেকে ৩৮ টাকা, বাংলাদেশে তা ৫৮-৬০ টাকা। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে চালের দাম এত কেন? একবার বাড়ল, কিন্তু চালের মৌসুমেও কমল না কেন? দাম বৃদ্ধির সময় খাদ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, চালের দাম ৭০-৮০ টাকা করার ষড়যন্ত্র করছে। সত্যি সত্যি সরু চালের কেজি ৫২ টাকা থেকে ৭৬ টাকা হয়ে গেল। দাম আর কমল না, এখনও সেই দামই থাকল। ষড়যন্ত্র কারা করল, দাম কেন কমল না, এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেই প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে। সর্বোপরি জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বগতি নিয়েও কিছু বলেননি প্রধানমন্ত্রী।
০৫.
প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি নিয়ে সব সময় বলা হয়। সেই সাফল্যের কথা প্রধানমন্ত্রী ভাষণেও বলেছেন। ১৬০০ ডলারের উপরে যে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়, সে দেশের মানুষের একটা অংশ বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের মানুষের একটা অংশ এখনও কেন ২০০ টাকা দিয়ে একটি সোয়েটার বা ৩০০ টাকা দিয়ে একটি কম্বল কিনতে পারেন না? কাগজের সাফল্য আর বাস্তবের বৈষম্যমূলক ফারাক যে কতটা ভয়ঙ্কর, সে বিষয়টিও সরকারের বিবেচনায় নেই।
শীতের সময় মানুষের পাশে গরম কাপড় বা খাদ্য নিয়ে সরকার মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চিন্তা আগে থেকে করেনি। বন্যার সময় ত্রাণ পৌঁছানোরও পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না। এত আর্থিক সামর্থ্য, এত উন্নয়ন, কিন্তু মানুষ বন্যায় ত্রাণ পায় না, শীতে গরম পোশাক পায় না। বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রীর ভাষণেও স্থান পায় না।
০৬.
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার মধ্যেই সকল সাফল্যের গল্প আবর্তিত। ফেরত পাঠানোর কূটনীতিকে সাফল্য নেই। তার চেয়েও ভয়ঙ্কর তথ্য রোহিঙ্গাদের জন্যে সরকার বিশ্বব্যাংক এবং এডিবির থেকে ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করছে। কেন ঋণ নেয়া হবে এ বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী ভাষণে কিছু বলেননি। অথচ এই ঋণ দেশের মানুষকেই শোধ করতেহবে।এমনিতেই বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ঋণ ৪৬ হাজার টাকা।উত্তর বঙ্গের বা হাওড়ের দিন মজুরের নামেও ৪৬ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। অথচ এসব দিন মজুর শীতে একটি কম্বল কিনতে পারেন না। তাকে সাহায্যর জন্যে ভিক্ষারির মত তাকিয়ে থাকতে হয়। রোহিঙ্গাদের জন্যে যে ঋণ নেওয়া হবে, সেই ঋণও শোধ করতে হবে দেশের মানুষকে।
০৭.
প্রধানমন্ত্রী যেদিন ভাষণ দিলেন, সেদিন ৮টি ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। দুই লাখ চাকরি প্রার্থী সারা দেশ থেকে পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন। কেউ পরীক্ষা হলে ঢুকতে পেরেছেন, কেউ পারেননি। কোনো সিট নম্বর নেই। এক বেঞ্চে আট দশজন বসে পরীক্ষা দিয়েছেন। মোবাইল, ক্যালকুলেটর নিয়ে গল্প-গুজব করে পরীক্ষা দিয়েছেন। কোথাও পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে, কোথাও তারপর প্রশ্ন পৌঁছেছে।
নজীরবিহীন বললেও, এই অরাজকতা বোঝানো যায় না। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনাও নয়। এটা হচ্ছে ‘একক পরিচালক’র প্রতিষ্ঠানহীন দেশের বাস্তব চিত্র। ‘একক পরিচালক’র দেশে প্রধানমন্ত্রী যা দেখেন, যা করেন সেটা হয়। অন্য কেউ প্রায় কিছু করেন না, করতে পারেন না বা তাদের করার এখতিয়ার নেই। যশোর রোডের গাছকাটা বন্ধ করার জন্যেও প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানাতে হয়। শিক্ষার দুই মন্ত্রী থাকলেও শিক্ষকদের আশ্বস্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত আসতে হয় প্রধানমন্ত্রীর থেকে।
প্রতিষ্ঠান তৈরি না হলে, মানবসম্পদের উন্নয়ন না হলে, অবকাঠামো অর্থাৎ চার লেন রাস্তা, ফ্লাইওভার বা সেতু আদৌ কোনো উপকারে আসবে না দীর্ঘমেয়াদে। কথাটা চিরন্তন সত্য। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে সরকারের ‘উন্নয়ন’ দর্শনে যা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
গোলাম মোর্তোজা: সম্পাদক, সাপ্তাহিক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন