শেখ আদনান ফাহাদ
নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর পেশা হচ্ছে সাংবাদিকতা। সমাজের সব নেতিবাচকতার বিরুদ্ধে দিবানিশি সজাগ থেকে লড়ে যাবার পেশা হচ্ছে সাংবাদিকতা। সংবাদমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। আর এ চতুর্থ স্তম্ভকেই যারা সোজা রাখেন, তারা হলেন সাংবাদিক। এই সাংবাদিকদের নিয়ে অত্যন্ত অপমানজনক মন্তব্য করেছেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন-প্রত্যাশী আদম তমিজি হক।
তমিজি হকের মন্তব্যগুলো প্রতিটি সাংবাদিক ও সাংবাদিক নেতা যে মনোযোগ দিয়ে পড়বেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঢাকাটাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘শনিবার আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র বিক্রির প্রথম দিন সকালে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে যান তমিজি। আর সেখান থেকে বের হয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে গণমাধ্যমের প্রতি ক্ষোভ ঝাড়েন তিনি। আওয়ামী লীগের এই মনোনয়নপ্রত্যাশী বলেছেন, ‘টাকা ছিঁটালেই সাংবাদিকের অভাব হয় না।’
তমিজির ক্ষোভের কারণ, তিনি ভোটের লড়াইয়ে নামতে চাওয়ার পর গণমাধ্যম তাকে নিয়ে তেমন আলোচনা করেনি। আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আতিকুল ইসলামের নামই প্রচার করেছে।
আনিসুল হকের মৃত্যুর পর ফাঁকা হওয়া মেয়র পদ পূরণে যখন নির্বাচনের কথা চলছে তখন হঠাৎ ভোটে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন হক গ্রুপের ব্যবস্থাপক আদম তমিজি হক। তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার শুরু করেন। তবে মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতে তাকে নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি।
তমিজি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগে আপনারা কোথায় ছিলেন? আজ আমি যখন নমিনেশন ফরম নিতে এসেছি তখন আপনাদের আমার দিকে নজর পড়েছে?’ ‘এতদিন তো আপনারা সবাই আতিকুল ইসলামের পেছনে ছুটেছেন। আজ যখন বুঝেছেন আমি মেয়র হতে যাচ্ছি, তখন আপনারা আমার পিছু নিয়েছেন।’
আনিসুল হকের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায় থেকে সংকেত পেয়ে ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম। তিনি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে সাক্ষাৎ করেও এসেছেন।
তমিজি হকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার কী? খবর নিয়ে শুনলাম, আদম তমিজি হক ঢাকা মহানগর উত্তরের তাঁতি লীগের প্রধান উপদেষ্টা! এই রাজনৈতিক প্রোফাইলের একজন মানুষ রাজধানী ঢাকার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন কি না সেটা সময়ই বলবে। তবে সাংবাদিকদের কাকের সাথে তুলনা করে তিনি মেয়র পদের লড়াইয়ের শুরুতে যে প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে পারেননি সেটা বলাই যায়। সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা নিয়ে যার এমন ধারণা, তিনি হয়তো ভুলে গেছেন সাম্প্রতিককালের অন্যতম জনপ্রিয় চরিত্র আনিসুল হকের উত্তরসূরি নির্বাচিত হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তিনি।
আনিসুল হক সাংবাদিকতা পেশাকে কতখানি শ্রদ্ধা করতেন, সৎ ও দক্ষ সাংবাদিকদের সহযোগিতা কীভাবে নিতেন, সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা তমিজি হকের আছে বলে মনে হচ্ছে না। গাবতলী বাসস্ট্যান্ড কিংবা তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড ক্লিয়ার করাসহ প্রতিটি বড় কাজে আনিসুল হক ঢাকার সিনিয়র সাংবাদিকদের সহায়তা নিতেন। তমিজি হক সাংবাদিক নামে কী ধরনের মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন, তিনিই ভালো জানেন।
তমিজি হককে তার কোম্পানির লোকজন, আত্মীয়-স্বজন, পরিবার এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ছাড়া এ দেশে সাধারণ মানুষ কদিন আগেও চিনত না। বাস, অটোরিকশার পেছনে পোস্টার এবং ফেসবুকের কল্যাণে তমিজি হক এখন কিছুটা পরিচিত। কিছু অনলাইনও তমিজি হকের নামে ‘নিউজ’ প্রচার করেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে কেউ নমিনেশন পেপার কিনতে পারে। কবি রাসেল আশেকীও নমিনেশন পেপার কিনেছেন। কবি রাসেল আশেকী আওয়ামী রাজনীতির সাথে দীর্ঘদিনের সম্পৃক্ততার জের ধরে তিনিও আশা করছেন, আওয়ামী লীগ তাকে নমিনেশন দেবে।
তমিজি হকের বড় রাজনৈতিক ক্যারিয়ার না থাকলেও অর্থবিত্তে কারো চেয়ে কম না তিনি। তাঁতি লীগের উপদেষ্টা হয়েছেন কীভাবে আমরা জানি না। তবে দেশের একজন নাগরিক হিসেবে তিনি মনোনয়নপত্র কিনতেই পারেন। আওয়ামী লীগ কার কাছে নমিনেশনপত্র বিক্রি করবে, এটাও আওয়ামী লীগের ব্যাপার। তবে এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের কী কী কন্ডিশন আছে, সেটাও জানা দরকার। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আকস্মিকভাবেই যেন টাকাওয়ালা মানুষের আনাগোনা বেড়ে গেছে।
ব্যবসায়ী আনিসুল হক জনপ্রতিনিধি হিসেবে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়ে রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি আরও কঠিন করে দিয়েছেন। এদিকে আরেক ব্যবসায়ী নেতা আতিকুল হক ইতোমধ্যে একটা ধারণা শহরে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন যে, তিনিই পেতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের টিকেট। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আতিকুল হকের বিষয়টি স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটাই করছেন না।
ব্যবসায়ী আদম তমিজি হকের মনোনয়ন প্রত্যাশাও দোষের কিছু না। ব্যবসায়ীরাই যখন বেশি কদর পাচ্ছেন, উনি আর বাকি থাকবেন কেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর কার্যালয়ে আওয়ামী লীগ বিটের সাংবাদিকদের সামনে তমিজি হক কোনোভাবেই সাংবাদিকদের নিয়ে এমন আপত্তিজনক মন্তব্য করতে পারেন না। কোনো সচেতন মানুষ এভাবে কথা বলবেন না। তমিজি হক খবর হওয়ার খায়েশে যেসব সাংবাদিকের সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের মতো সবাই নাও হতে পারে। বেশির ভাগ সাংবাদিকই সমাজ ও দেশপ্রেমের অনুভূতি নিয়ে সাংবাদকিতা করেন।
১২ বছর সাংবাদিকতার সাথে সরাসরি সম্পর্ক আর বর্তমানের পরোক্ষ সম্পর্ক মিলিয়ে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, বাংলাদেশে সাংবাদিকতার সাথে জড়িত লোকজনের বেশির ভাগই মেধাবী, দক্ষ ও সৎ। অসৎ মানুষ বাংলাদেশে নেই কোন পেশায়? তমিজি হক পারবেন, পুলিশ নিয়ে এভাবে ঢালাও মন্তব্য করতে? তমিজি হক দেশের কালো টাকার মালিক বা দুর্বৃত্ত আমলা-রাজনীতিবিদদের নিয়ে এভাবে অতি সরলীকরণ করতে পারবেন?
মহান মুক্তিযুদ্ধে কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার পেছনে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা কিংবা মোনাজাত উদ্দিন, মানিক মিয়া, এবিএম মুসা, আতাউস সামাদ ও কামাল লোহানীর মতো সাংবাদিকদের বিষয়ে যদি তমিজি হক জানতেন, তাহলে এভাবে ঢালাওভাবে অপমানজনক মন্তব্য করে এ মহান পেশার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করতেন না।
লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন