মনজুর রশীদ
ছোটবেলায় ‘আমলাতন্ত্র’ শব্দটির অর্থ সেভাবে বুঝতাম না। বড় হতে হতে বুঝলাম এরা সরকারী চাকুরী করা বড় বড় পদবী ও ক্ষমতাধারী মানুষ। এদের কাছে সাধারণ মানুষ সহজে ভিড়তে পারেনা। সব সময় একটা অদৃশ্য প্রাচীর দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের কাছ থেকে তাদেরকে বিস্তর দূরে সরে রাখতে বাধ্য করে। ফলে তাদের নিয়ে যখনই কথা বলা হয়, বা কোন আলোচনা হয় – বাংগালী তাদের চিরায়ত সমালোচনার অভ্যাসগত চর্চার ধারাবাহিকতায় আমলাদেরকে সবসময়ই নেতিবাচকভাবে তুলে ধরতেন। কিন্তু এ সম্পর্কিত অনেক ধারনাই পাল্টে গেল ভার্সিটি জীবনে এসে। সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবারের ‘ব্যুরোক্রেসি’ পড়তে গিয়ে এর আদ্যপান্ত বোঝার কিছুটা সুযোগ পেলাম। মহৎ পেশাগত উদ্দেশ্য সাধনের কল্যাণকর ব্রত নিয়ে নাকি এই ‘আমলাতন্ত্র’ শব্দটির সৃষ্টি।
‘আমলা’ আরবি শব্দ। এর অর্থ আদেশ পালন ও বাস্তবায়ন। শব্দগতভাবে তাই যে সকল সরকারী কর্মকর্তা- কর্মচারী সরকারের আদেশ পালন ও বাস্তবায়ন করে তাদেরকে আমলা বলে। আমলাদের সংগঠনকে বলে 'আমলাতন্ত্র'। অন্যদিকে আমলাতন্ত্রের ইংরেজী প্রতিশব্দ ‘Bureaucracy’, তবে ফরাসি ব্যুরো (Bureau) এবং গ্রিক ক্রেটিন (Kratein) শব্দ থেকে ব্যুরোক্রেসি (Bureaucracy) শব্দের উদ্ভব ঘটেছে। ব্যুরো শব্দের অর্থ লেখার টেবিল এবং ক্রেটিন শব্দের অর্থ শাসন। সুতরাং উৎপত্তিগত ভাবে আমলাতন্ত্রের অর্থ হচ্ছে Desk Government বা দপ্তর সরকার। আক্ষরিক অর্থে আমলাতন্ত্র বলতে আমলা বা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের শাসন বুঝায়। আমলাতন্ত্র হচ্ছে স্থায়ী, বেতনভুক্ত, দক্ষ ও পেশাদার কর্মচারীদের সংগঠন।
আমলাতন্ত্রের আধুনিক আলোচনার অগ্রনায়ক প্রখ্যাত জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েবারের কথা আগেই বলেছি। তিনি সর্বপ্রথম আমলাতন্ত্রকে একটি আইনগত ও যুক্তিসংগত মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং তিনিই আদর্শ আমলাতন্ত্রের উদ্ভাবক। তার মতে রাষ্ট্রীয় কর্মচারীবৃন্দ বা আমলা হচ্ছেন সুদক্ষ, পেশাদারী, অরাজনৈতিক, স্থায়ী এবং অধীনস্ত কর্মকর্তা। তিনি তার লেখায় আরো বলেছেন - আমলাতন্ত্র অসংখ্য ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে ও জটিল শর্তে সুশৃঙ্খলভাবে পরস্পর একত্রিত হওয়াকে বুঝায়। তার এই ধারনাকে গ্রহণ করে অধ্যাপক ফিফনার এবং প্রেসথাস বলেন – ‘আমলাতন্ত্র হলো বিভিন্ন ব্যক্তি এবং তাদের কার্যাবলীকে এমন একটি পদ্ধতিতে সংগঠিত করা যা সুসংহতভাবে গোষ্ঠী শ্রমের উদ্দেশ্য অর্জনে সক্ষম হয়, যার মূল লক্ষ্য দেশের সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষকে সংগঠিতভাবে সেবা প্রদান করা এবং তাদের উন্নয়নে এগিয়ে আসা’। অর্থাৎ সকলের মহৎ পেশাগত উদ্দেশ্য সাধনের কল্যাণকর ব্রত নিয়ে আমলাতন্ত্রের সৃষ্টি এবং শুরু থেকেই আমলারা তার নিজস্ব কর্মগুণ ও পেশাগত দক্ষতার মাধ্যমে জনসাধারণের সামগ্রিক মান উন্নয়নে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করবেন সম্পূর্ণভাবে পেশাদারী ও অরাজনৈতিক মনোভাব নিয়ে – এটাই হল সারকথা। কিন্তু বিশ্বজুড়ে এমন ধারনার অনেক ইতিবাচক প্রয়োগ দেখলেও আমাদের দেশের বাস্তবতায় আমরা কি দেখতে পাই? এখানে আমলাদের বিষয়ে কার্ল মার্ক্স প্রদত্ত মন্তব্যই যেন অনেকখানি যুক্তিযুক্ত। তিনি বলেছিলেন – ‘নিজেদের নাককেই তাঁরা কর্তব্যের অস্ত্র মনে করেন এবং সব ব্যাপারেই সেইসব অস্ত্রের প্রয়োগ ঘটান। এই নাক গলানোর কর্মকাণ্ডই তাঁদের কাছে জাতীয় স্বার্থ এবং নিয়মের অর্থ’।
এখানে আমরা যা দেখতে পাই আমলাতন্ত্রের শিকড়ে ঢুকে পড়েছে ব্যাপকভাবে দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি। প্রতিদিন সেই মাত্রা ভয়াবহ ব্যাপকতা লাভ করছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক আনুগত্যের গরল ও শক্তিশালী বিষ ঢুকিয়ে একে মারাত্মকভাবে কলুষিত করা হচ্ছে দিনের পর দিন । ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের’ নামধারী সামগ্রিক সিভিল-সংস্করণের এই যুগে স্বার্থবাদী ও সুযোগ সন্ধানী বিভিন্ন আমলা পেশাদারীত্বের মুখে বিষ্ঠা ঢেলে, চরম দলীয় আনুগত্য ও অপেশাদারী চরিত্রে অবতীর্ণ হচ্ছেন। আর এর ফল হিসাবে পেশার প্রতি ‘আনুগত্যশীল’ ও ‘অনুভূতিশীল’ নামক যোগ্যতাগুলি চরমভাবে নিষ্পেষিত হতে শুরু করেছে এবং ক্রমান্বয়ে সে যায়গাগুলি দখল করে নিচ্ছে ‘দলের প্রতি’ অতি আনুগত্যশীল ও অনুভূতিশীল নামক যোগ্যতাসমূহ। রাজনৈতিক দুবৃত্বায়নের এই সুযোগে অযোগ্য বা কম যোগ্যতাসম্পন্ন আমলারা বারবার পদোন্নতি নিয়ে তরতর করে সিনিয়রদের ডিঙ্গিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছেন। বিভিন্ন সভা সমাবেশে এদের বড় একটি অংশ রাজনৈতিক নেতাদের মত বক্তব্য দিচ্ছেন, কথা বলছেন বা আচরণ করছেন। যারা তাত্ত্বিকভাবে আমলা বৈশিষ্ট্য ধারণ ও প্রতিপালন করেন, রাজনীতির সঙ্কীর্ণ স্বার্থের বাইরে গিয়ে কিছু করার চেষ্টা করেন, তাদের প্রতিটি পদে বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। এদের অনেকের অনেক ভাল ভাল উদ্যোগ, অনেক সৃষ্টিশীলতা অঙ্কুরেই দম হারায়। বিভিন্ন কালিমা দিয়ে তাদের এগুনোর পথ রুদ্ধ করা হয়, পদোন্নতিতো দূরের কথা – উপরন্তু যেসব পরিণতি গ্রহণ করতে হয় তার মধ্যে চাকুরী থেকে অব্যাহতি দেওয়া, ওএসডি করে বসিয়ে রাখা অথবা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অকর্মণ্য প্রমাণ করতে বসিয়ে রাখা ইত্যাদি। সব শাসনামলেই যেন এই দুষ্টচক্র থেকে কেউ বের হয়ে আসতে পারছেনা, বরং সেই একই প্রক্রিয়া যেন সকলের মধ্যে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি অতি চরম আনুগত্যশীল ও পক্ষপাতদুষ্টতার ফলে এই সমন্বিত প্রতিষ্ঠানের আদর্শ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলি আক্ষরিক অর্থে যেন দলীয় মিশন-ভিশন বাস্তবায়নে অনেকখানি বদ্ধপরিকর, পেশাদারীত্বের প্রসঙ্গটি এখানে তাই দীপ্তিহীন, অনুজ্জ্বল। তাদের দলীয় আনুগত্য পেশাদারীত্বের প্রতি দায়িত্ব পালনের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাতেও কোন সমস্যা ছিল না, যদি তারা পেশাটিকে সে রকম মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিতে সমর্থ হতেন। অবস্থাদৃষ্টে এটি সুস্পষ্ট যে, স্বাধীনতা পরবর্তী কোন শাসনামলেই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সেটি হয়নি।
আমাদের জাতির পিতা বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুরু থেকেই এই আমলাতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারীতার বিরোধী ছিলেন এবং সুষ্ঠ গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার পরিপন্থী মনে করতেন। তার ‘অসমাপ্ত
আত্নজীবনী’র একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়ঃ “আমরা যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তারা এই সমস্ত জঘন্য কাজকে ঘৃণা করি। খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব তাঁর মন্ত্রীত্বে একজন সরকারী আমলাকে গ্রহণ করলেন, এরপর আমলাতন্ত্রের প্রকাশ্য খেলা শুরু হলো পাকিস্তানের রাজনীতিতে। একজন সরকারী কর্মচারী হলেন গভর্নর জেনারেল, আরেকজন হলেন অর্থমন্ত্রী। খাজা সাহেব ছিলেন দুর্বল প্রকৃতির লোক। তিনি অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন, তবে কর্মক্ষমতা এবং উদ্যোগের অভাব ছিল। ফলে আমলাতন্ত্র মাথা তুলে দাঁড়াল। … আমলাতন্ত্রের জোটের কাছে রাজনীতিবিদরা পরাজিত হতে শুরু করল”। বঙ্গবন্ধুর সেই উপলব্ধি এখনো যেন সেই একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে।
সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফ এর একটি লেখায় পড়েছিলাম - আমলাতন্ত্র তাইতো আমাদের দেশে সহজকে কঠিন করে তোলার একটি শিল্প। এটি হলো সেই খেলা, যেখানে সবাইকে গোল হয়ে দাঁড়াতে হয়। খেলার শর্তটিই এমন যে, কিছু করবেন তো ধরা খাবেন। তাই কেউ কিছু করে না, খেলা চলতে থাকে। আর এই খেলার অবধারিত ফল হিসাবে দেখতে পাই শুধুই দুর্নীতি, অনিয়ম, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি ইত্যাদি। আর একারণেই এদের অনেকেই নিজেদের স্বার্থকেই জাতীয় স্বার্থ মনে করে, জাতীয় স্বার্থ তো তাদের আত্মপ্রতিষ্ঠার বাজি। সেই বাজিতে তারা জিতলে দেশ জেতে না, আর দেশের জয় মানে তাদের হার। তাইতো এর ফল হিসাবে আমলাতন্ত্রের চেহারা প্রকাশিত হয়ে পড়ে সাধারণ জনগণের দুঃখ-কষ্টের নানারকম প্রকাশের ভেতর দিয়ে। আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার খুঁটি আদালত ও প্রশাসন তথা কোর্টকাচারী থেকে শুরু করে সরকারী দপ্তরগুলোর ইট-কাঠ-বারান্দা তার নীরব সাক্ষী। কত রকম সংস্কারের রমরমা এই দেশে, কিন্তু এর কি কোনো সংস্কার হবে না?
সব পথ যেখানে থেমে যায়, দুর্গতির সেই আমলাতন্ত্র - তোমাকেতো সালাম না জানালেও আবার বেয়াদবি হয়ে যাবে !
লেখক : গবেষক, সমাজ বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন