আহমেদ শরীফ
গত ৩০ নভেম্বর আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খাজা মুহম্মদ আসিফ, তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু এবং দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলমার মাম্মাদিয়ারভ এক বৈঠকে তিন দেশ যৌথ প্রতিরক্ষা বিষয়ক কর্মকাণ্ডে মনোনিবেশ করতে এক সমঝোতা স্মারক সই করেন। বৈঠকের ফলাফল নিয়ে এক প্রতিবেদনে পাকিস্তানের দ্যা নেশন পত্রিকা জানায়, তিন দেশ একত্রে সামরিক শিল্প কারখানা চালু করতে চাইছে। এর আগ থেকেই তুরস্ক ও পাকিস্তানের সাথে আজারবাইজানের সামরিক সহযোগিতা থাকলেও তিন দেশ একত্রে বসেনি কখনো, যা কিনা ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে নতুন এক হিসাবের সূচনা করছে।
ওই বৈঠকে আজারবাইজান-জর্জিয়া-তুরস্ক রেললাইনে সংযুক্ত হতে পাকিস্তানকে আমন্ত্রণ জানানো নয়, যা গত ৩০ অক্টোবর উদ্বোধন করা হয়। তবে আজারবাইজান ও পাকিস্তানের মাঝে রয়েছে আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং আরও রয়েছে ইরান, যে দেশগুলির সাথে যুক্ত না হয়ে পাকিস্তানের পক্ষে আজারবাইজান বা তুরস্কের সাথে যুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। পাকিস্তানের এই চ্যালেঞ্জের উত্তর মিলবে আরেক বৈঠকে।
রুশ বার্তা সংস্থা তাস জানায়, ১৬ নভেম্বর সই করা এক চুক্তি মোতাবেক আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আজারবাইজান, জর্জিয়া ও তুরস্ক – এই পাঁচ দেশকে একত্রিত করবে এক পরিবহন করিডোর, যা শুরু হবে আফগানিস্তানের পশ্চিমের হেরাত থেকে; সেখান থেকে তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশখাবাদ এবং তুর্কমেনবাসি বন্দর হয়ে কাস্পিয়ান সাগর পার হয়ে আজারবাইজানের বাকু থেকে জর্জিয়ার ওপর দিয়ে তুরস্কে ঢুকবে। তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারা হয়ে দেশটির ঐতিহাসিক শহর ইস্তাম্বুল চলে যাবে সেই করিডোর। ২০১২ সাল থেকে শুরু হওয়া ‘লাপিস লাজুলি’ নামের এই প্রকল্পে খরচ হবে আনুমানিক দুই বিলিয়ন ডলার। এখানে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, এই পুরো করিডোরে ইরানের কোনো অংশগ্রহণ নেই। তবে আফগানিস্তান থেকে এই করিডোর ইরানে ঢুকবে, নাকি পাকিস্তানে ঢুকবে তা নিয়ে শুরু হতে পারে নতুন প্রতিযোগিতা।
কাস্পিয়ান সাগর, তথা মধ্য এশিয়ার দেশগুলি আরও যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে স্থলবেষ্টিত আফগানিস্তান, যেখানে মার্কিন সামরিক অবস্থানকে টিকিয়ে রেখেছে মধ্য এশিয়া এবং পাকিস্তানের মাঝ দিয়ে যাওয়া কয়েকটা লজিস্টিক্যাল করিডোর। এর মাঝে মধ্য এশিয়ার এয়ার করিডোরটা নির্ভর করছে আজারবাইজান এবং তুর্কমেনিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করার অনুমতির ওপর। আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলি (যেমন– সৈন্য, অস্ত্র এবং গোলাবারুদ) রাস্তা এবং রেল ব্যবহার করার পরিবর্তে এয়ার করিডোরের মাধ্যমে নেয়া হয়ে থাকে। তবে মার্কিনিদের সাথে আজারবাইজানের এই সম্পর্কে সর্বদাই কিছু না কিছু টানাপোড়েনে রয়েছে। ৪ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটন পোস্ট আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে এক প্রতিবেদনে বলে, সেখানে সরকারের সমালোচক সাংবাদিক মেহমান আলিইয়েভকে আটক করা হয়েছে।
এই খবরের জের ধরে ৭ সেপ্টেম্বর মার্কিন সিনেটে পাস করা এক বিলের মাধ্যমে মেহমান আলিইয়েভের আটককারী কর্মকর্তাদের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মধ্য এশিয়ার একনায়কদের টানাপোড়েন নতুন না হলেও, আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলে এর গুরুত্ব রয়েছে। রুশ মিডিয়া স্পুটনিক বলছে যে, এই নিষেধাজ্ঞার দুই দিন পর আজারবাইজানের পার্লামেন্টের অফিশিয়াল পত্রিকায় দেশটি মার্কিনিদের আফগানিস্তান মিশনে লজিস্টিক সহায়তা দেয়া বন্ধ করে দিতে পারে বলে ইঙ্গিত দেয়া হয়।
কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী দেশগুলির বিশাল খনিজ সম্পদের ভাণ্ডারের কারণেও এই এলাকায় এক ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা চলছে। এর কেন্দ্রে রয়েছে তুরস্ক এবং তার সাথে এই অঞ্চলের দেশগুলির সম্পর্ক। তুরস্ক ও আজারবাইজানকে অনেকে ‘এক জাতি, দুই রাষ্ট্র‘ বলে সম্বোধন করে থাকেন। আজারবাইজানের সাথে আর্মেনিয়ার নাগর্নো-কারাবাখ ছিটমহল নিয়ে বিরোধে তুরস্ক আজারবাইজানের পক্ষে থেকেছে সর্বদা।
আজারবাইজান থেকে জর্জিয়া হয়ে তুরস্ক পর্যন্ত রয়েছে দুটা পাইপলাইন। ‘বাকু-তিবিলিসি-চেইহান’ পাইপলাইনের মাধ্যমে কাস্পিয়ান সাগরের তেল তুরস্কের ভূমধ্যসাগরীয় চেইহান বন্দরের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে যায়। আর ‘সাউথ ককেসাশ পাইপলাইন’এর মাধ্যমে আজারবাইজানের গ্যাস তুরস্ক এবং জর্জিয়াতে সরবরাহ করা হয়। তুরস্ক হয়ে পাইপলাইন ইউরোপেও যাচ্ছে। আবার কাজাকস্তান-তুর্কমেনিস্তান থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস পাচ্ছে চীনও। রাশিয়া এই খনিগুলির ওপর নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই হারিয়েছে। এই খনিগুলির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তুরস্ক, রাশিয়া এবং ইরানসহ এই অঞ্চলের প্রভাবশালী দেশগুলির মাঝে শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা।
কাস্পিয়ান সাগরের সমুদ্রসীমা বিষয়ে এখনও সেখানকার পাঁচটা দেশ – রাশিয়া, কাজাকস্তান, তুর্কমেনিস্তান, ইরান এবং আজারবাইজানের মাঝে সমঝোতা হয়নি। গত ডিসেম্বরে মস্কোতে এক আলোচনার পর রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ সাংবাদিকদের বলেন যে, কাস্পিয়ান সাগরের সমুদ্রসীমা নিয়ে সমঝোতার খুব কাছাকাছি আছেন তারা, যদিও বাকি দেশগুলি ল্যাভরভের এই কথা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। কাস্পিয়ানের সমুদ্রসীমা এখানকার খনিজ সম্পদ এবং পরিবহন করিডোরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাস্পিয়ানের নিরাপত্তা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয় ২০০১ সালের জুলাইয়ে, যখন আজারবাইজানের বাকু থেকে ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে খনিজের সন্ধানী সার্ভে জাহাজকে ইরানের নৌবাহিনী বাধা দেয়। সে সময় থেকেই ইরানের সাথে আজারবাইজানের সম্পর্ক বেশ ঠাণ্ডা। আর ইরানের শক্তি প্রদর্শনের পর থেকে কাজাকস্তান ২০০৩ সালে নৌবাহিনী প্রতিষ্ঠা করে এবং এখন তারা বেশ কয়েকটা মিসাইল বোট এবং প্যাট্রোল বোট তৈরি করেছে।
ইরানও কাস্পিয়ান সাগরে একটা ফ্রিগেট এবং ছয়টা মিসাইল বোট তৈরি করেছে। আজারবাইজানের নৌবাহিনী তৈরিতে সহায়তা দিচ্ছে তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তান। তুর্কমেনিস্তানকে সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
কৌশলগত খনিজ, পরিবহন এবং সেগুলির নিরাপত্তা এখন কাস্পিয়ানের আলোচ্য বিষয়। ‘তুর্কি’ বন্ধন ব্যবহার করে তুরস্ক আজারবাইজান ছাড়াও বাকিদের যুক্ত করতে চাইছে। ২০১৩ সালে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তা দিতে এক যৌথ বাহিনী গঠনে তুরস্ক, আজারবাইজান, কাজাকস্তান এবং মঙ্গোলিয়ার মাঝে কথাবার্তা শুরু হয়।
মঙ্গোলিয়ার কারণে এই বাহিনী তৈরি পিছিয়ে গেলেও গেল ডিসেম্বরে ঘোষণা দেয়া হয় যে ২০১৮ সালেই এর তৈরি শুরু হবে। তুরস্ক এই অঞ্চলে শুধু খনিজ এবং পরিবহনের নেটওয়ার্কই তৈরি করছে না, সেই নেটওয়ার্কের নিরাপত্তাও দিতে চাইছে। ইস্তাম্বুল থেকে করাচি পর্যন্ত তুরস্কের এই প্রভাব বিস্তারে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে থাকবে রাশিয়া, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র।
লেখক: ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন