আমার ছেলের প্রসূন একসময় বিএনপির খুব ভক্ত ছিল। বছরতিনেক আগেও বিএনপি কথায় কথায় হরতাল ডাকতো। আর হরতাল ডাকলেই আর সব স্কুলের মত প্রসূনদের স্কুলও বন্ধ থাকতো। গত তিনবছরে ক্লাশ করে ক্লান্ত হয়ে গেলে প্রসূন প্রায়ই জানতে চাইতো, বাবা বিএনপি আবার কবে হরতাল ডাকবে? তবে এবার পছন্দটা উল্টে গেছে। ৮ ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়ার রায়কে ঘিড়ে দেশজুড়ে যতটা টেনশন, তারচেয়ে কম ছিল না প্রসূনের। তার আশঙ্কা ছিল, রায় যদি খালেদা জিয়ার বিপক্ষে যায়, তাহলে আবারও টানা হরতালের কবলে পড়তে হবে বাংলাদেশকে।
সম্ভাব্য হরতাল এবার প্রসূনকে আনন্দিত করেনি, বরং উৎকণ্ঠিত করেছে। কারণ এবার ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রসূনদের স্কুল থেকে কক্সবাজারের পিকনিক ছিল। প্রসূনের শঙ্কা ছিল, হরতাল ডাকলে তাদের বহুল প্রতীক্ষিত পিকনিকটি ভন্ডুল হয়ে যাবে। বেগম জিয়া ৫ বছরের কারাদন্ড নিয়ে নাজিমউদ্দিন রোডের পুরোনো কারাগারে চলে যাওয়ার পরও বিএনপি যখন হরতাল ডাকলো না, প্রসূন স্বস্তি পেয়েছে, তাদের পিকনিকও হয়েছে। তবে প্রসূন চমকেও গেছে। তার বিস্ময় ছিল, বাবা, এ বিএনপি তো চেনা নয়।
আমার ধারণা শুধু প্রসূন নয়, বিএনপির এই অচেনা আচরণ চমকে দিয়েছে আরো অনেককে, এমনকি সরকারি দলকেও। বিএনপিকে আটকানোর জন্য সরকার নিপূণ ফাঁদ পেতেছিল। কিন্তু ৩০ জানুয়ারি পুলিশের ওপর হামলা, অস্ত্র ভাঙচুর, প্রিজন ভ্যান থেকে আসামী ছিনিয়ে নেয়ার অংশটুকু বাদ দিলে রায়কে ঘিড়ে বিএনপি সত্যি সত্যি অচেনা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। বিএনপিকে আমরা যেভাবে চিনি, বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করা এবং ২০১৫ সালে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে বেগম জিয়ার টানা ৯৩ দিনের অবরোধের সময়কার পেট্রোল বোমা সন্ত্রাসের পর, এবার বিএনপি সত্যিই অচেনা।
৩০ জানুয়ারি সরকারের ফাঁদে পা দেয়ার পর বিএনপির কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে যেতে হয়েছে। বিএনপির কোনো সমাবেশ বা মিছিলের অনুমতির প্রশ্ন আসলেই বলা হয়, বিএনপি সন্ত্রাসী দল, অনৃুমতি দিলেই তারা সন্ত্রাস, সহিংসতা করবে। কিন্তু রায়ের পর বিএনপি অকল্পনীয় সংযমের পরিচয় দিয়েছে। বিএনপি যদি এই সংযম না দেখাতো, তাহলে কী হতে পারতো? তারা যদি আগের মত হরতাল ডাকতো, অবরোধ ডাকতো, সহিংসতা চালাতো; তাদের ওপর আরেক দফা নিপীড়ণ চালানোর যুক্তি খুজে পেতো সরকার। বিএনপি যে সত্যিই একটি সন্ত্রাসী দল, সেই প্রচারণায় আরো শক্ত যুক্তি যুক্ত হতো। গায়ের জোরে দাবি আদায় করতে চাইলে, সরকারের পাল্টা
গায়ের জোরে তাদের আরো অনেক শক্তি ক্ষয় হতো। রাজনীতির খেলাটা আসলে যতটা না মাঠে, তারচেয়ে বেশি টেবিলে। সরকারি দল ফাঁদ পেতেছিল। বিএনপি নিপুণ দক্ষতায় সে ফাঁদ এড়িয়ে পাল্টা ফাঁদ পেতেছে। এখন সেই ফাঁদে পা দিয়েছে সরকার। গত সপ্তাহে আমি লিখেছিলাম ‘সরকারের ফাঁদে বিএনপির পা’। এক
সপ্তাহেই পাল্টে গেছে চিত্র।রায়ের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই বেগম খালেদা জিয়া দলের, জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। রায়ের আগের দিন সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সব বৈঠকেই তিনি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। খালেদা জিয়ার ইচ্ছা ছিল রাজপথে লাখো জনতা রেখে তিনি রায় শুনতে যাবেন। ৩০ জানুয়ারি সরকারের ফাঁদে বিএনপি পা দেয়ায় সে আকাঙ্খা ভেস্তে গেছে। সরকারের ব্যাপক ধরপাকড়ের মুখে রাজপথে নয়, বিএনপি নেতকর্মীরা ছিলেন দৌড়ের ওপর।
বিএনপির কোমর ভেঙ্গে দেয়া গেছে ভেবে সরকার অনেক স্বস্তিতে ছিল। স্বস্তিতে থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতি ছিল নজিরবিহীন। কারাগারে যেতেই হবে, এটা বেগম জিয়া শুরুতে ভাবেননি। শেষ দিকে অবশ্য বুঝে গিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া সবাইকে সান্ত¡না দিয়ে গুলশানের বাসা থেকে বের হন প্রায় একাই। কিন্তু মহাখালী, মগবাজার আসতে আসতেই কয়েক হাজার মানুষ তাঁর গাড়ির চারপাশে মিছিল করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এটা ছিল অপ্রত্যাশিত চমক। তবে পুলিশও যথেষ্ট সংযম দেখিয়েছে। মিছিল-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের কাকরাইল পর্যন্ত মিছিল করতে দিয়েছে। এর বেশি দেয়ার কথাও নয়।রায়ের পরও বিএনপি মানববন্ধন, বিক্ষোভ, অনশন, গণস্বাক্ষর ধরনের অহিংস গান্ধীবাদী কর্মসূচি দেয়। খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেয়ার পরও বিএনপি রাজপথে কিছু করতে পারেনি, এই নিয়ে এক ধরনের আত্মপ্রসাদে ভূগছে সরকারি দল।
কিন্তু সরকারি দলের খুব বেশি আত্মপ্রসাদে ভোগার সুযোগ নেই। কারণ বিএনপি এটাই করতে চেয়েছিল। ভুল না ঠিক, সেটা পরে নির্ধারিত হবে। তবে বিএনপি আলাপ-আলোচনা করেই গান্ধীবাদী পথে পা রেখেছে। তাদের লক্ষ্যটা খুব পরিস্কার। মুক্ত খালেদার চেয়ে বন্দী খালেদা বেশি শক্তিশালী; এই সূত্র কাজে লাগাতে উঠে পড়ে লেগেছে বিএনপি। তারা চায়, বেগম জিয়া কারাগারে যাওয়ায় তাঁর পক্ষে সহানুভূতি তৈরি করা। তাই খালেদা জিয়াকে নির্জন কারাগারে রাখা হয়েছে, সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে না ইত্যাদি বলে বলে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা চলছে। সরকারও রায়ের সার্টিফায়েড কপি দিতে দেরি করে, বিএনপির অহিংস কর্মসূচিতেও বাধা দিয়ে বিএনপির সেই সহানুভূতি কৌশলকেই বেগবান করছে।
বিএনপি মুখে যতই বলুক, খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে যাবো না, আমার ধারণা তারা নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা চাইবে সহানুভূতির ঢেউকে ভোটের বাক্স পর্যন্ত টেনে নিতে। নির্বাচন করতে না চাইলে বিএনপি আবার জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে যেতো। মুখে স্বীকার না করলেও ২০১৪ ও ২০১৫ সালের সহিংস আন্দোলন যে ভুল ছিল, সে রাস্তা থেকে সরে এসে তারা সেটি বুঝিয়ে দিয়েছেন। এখন বিএনপির প্রাণপণ চেষ্টা নিজেদের অতীত কলঙ্ক মুছে ফেলে নিজেদের নিয়মতান্ত্রিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠার। সরকার সেই চেষ্টায় তাদের সহায়তাই করছে।
বিএনপি সহানুভূতি আদায়ের যে ফাঁদ পেতেছে, সরকারি দলও চেষ্টা করছে, সেই ফাঁদ কেটে বেরুতে। বিএনপি দাবি করছে মামলাটি রাজনৈতিক। আর সরকার দাবি করছে দুর্নীতির। তবে মামলাটি খুব পরিস্কার। এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা টাকা এতিমদের জন্য খরচ করা হয়নি। বেগম খালেদা জিয়া টাকাটা মেরে দিয়েছেন,ব্যাপারটা এমন নয়। তবে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার সম্পৃক্ততায় এতিমদের টাকা বেআইনীভাবে স্থানান্তরের। টাকাটা মেরে দেয়া না হলেও, বেআইনী ব্যবহারও অনৈতিক ও বেআইনী। তাই বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে গেলেই সহানুভূতির জোয়ার আসবে, বিএনপি এমনটা আসা করলেও, বাস্তবে তা হয়নি। যতটুকু সহানুভূতি পেয়েছে, তাও বিএনপি দক্ষতার সঙ্গে ভোটের বাক্স পর্যন্ত টেনে নিতে পারবে কিনা, সেটার ওপর নির্ভর করছে অনেককিছু।রাজনীতি এখন রাজপথে নয়, টেবিলে। চলছে কৌশলের খেলা। চলছে ফাঁদ পাতা, ফাঁদ কাটা। হয়তো এভাবেই চলবে নির্বাচন পর্যন্ত। নির্বাচনেই বোঝা যাবে এই খেলায় কে হারলো, কে জিতলো।
প্রভাষ আমিন : সাংবাদিক, কলাম লেখক; বার্তা প্রধান : এটিএন নিউজ।
probhash2000@gmail.com
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন