ঘটনাক্রমে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর যখন ইউনেস্কো আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে তখন আমি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই ঘোষণাটি এসেছিল তার ভিতরের অনেক তথ্য আমার জানা আছে। তবে এই ঘোষণাটির বেশ কিছু তাৎপর্য আছে, ১৯৯৯ পর্যন্ত ২১ ছিল আমাদের, তারপর একুশ হয়ে গেল সারা বিশ্বের।
২০০০ সালে হেরাল্ড ট্রিবিউন আমার কাছ থেকে একটি লেখা নিয়ে ছেপেছিল ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। সেখানে আমি বলেছিলাম, বাঙালির সংগ্রামী চেতনার সূচনাই হয়েছে ৪৭ এর পরে। এর আগেও সংগ্রাম ছিল। তবে ৪৭ এর পরে এই ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার আন্দোলন নয়, এটা সাংস্কৃতির স্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছিল। এই জন্য ভাষা শুধু ভাব বিনিময়ের মাধ্যম নয়, ভাষা আমার সাংস্কৃতিরও বাহন। বাংলাভাষা হারিয়ে গেলে আমার সাংস্কৃতি হারিয়ে যেত।
বাংলা ভাষাকে রক্ষা করেছি, সাংস্কৃতিকে রক্ষা করেছি, আত্মপরিচয় তুলে ধরেছি। সবকিছু মিলে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র। এইটুকু কথা বললে হয়ত কম বলা হবে, বলতে হবে আরও ভাষিক, নৃতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি ভাষা আন্দোলনের মধ্যে। এবং লক্ষণীয় ব্যাপার, ভাষা আন্দোলনে চলমান পর্যায়ে খোকারা, (আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট নেতা আলী আরশাদ যার ছদ্মনাম খোকা), উনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘সকল ভাষার সমান মর্যাদা’ প্রবন্ধটা সংঙ্কলিত হয়েছিল হাসান হাফিজুরের সম্পাদনায় ভাষা আন্দোলনের উপর প্রথম সঙ্কলনে। সেই প্রবন্ধে কিন্তু তিনি বলেছিলেন, শুধু বাংলা কেন পাকিস্তানের সব মাতৃভাষার স্বীকৃতি দেয়া হোক।
তার প্রবন্ধটি পড়লে এইটুকু বুঝা যায়, শুধু পাকিস্তান কেন গোটা বিশ্বের মাতৃভাষাকে স্বীকৃতি দেয়া হোক। তখন অনেকে ভুল বুঝেছিল যে, কমিউনিস্টরা আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাসী, তারা মূল ইস্যু থেকে দুরে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য খোকার দ্বারা বলিয়ে নিয়েছে।
কিন্তু আমি হতবাক হয়ে লক্ষ্য করি বা বিমুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে লক্ষ্য করি খোকার সেই স্বপ্ন ১৯৯৯ সালে বাস্তবায়িত হলো। ইউনেস্কো কিন্তু সারা পৃথিবীর ছয় হাজার ৯০০টি ভাষাকে স্বীকৃত দিল। ভাষা সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতিকে স্বীকৃত দিল। ভাষা সংশ্লিষ্ট আত্মপরিচয়কে স্বীকৃত দিল।
অর্থাৎ ভাষিক বহুত্ব, সংস্কৃতিক বহুত্ব ও আত্মপরিচয় বহুত্ব সব কিছু মিলিয়ে ইউনেস্কো সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল। আমি মনে করি এবং জোর দিয়ে বলতে চাই, এটা খোকার বাস্তবায়নের বিলম্বিত বাস্তবায়ন।
ভাষা আন্দোলনের আর একটা আন্তর্জাতিক মাত্রা আছে, বৈশ্বিক মাত্রা আছে। আর একটা মাত্রা কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না। আমরা রুখে দাঁড়িয়েছি, প্রতিবাদী হয়েছি, আন্দোলন করেছি বুকের রক্ত দিয়ে। কিন্তু আমাদের গণতান্ত্রিক চেতনা কিন্তু হারিয়েছি। আমরা অনায়াসে বলতে পারতাম, স্লোগান দিয়েছি, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, কিন্তু আমাদের দাবিটি ছিল, উর্দুর পাশাপাশি বাংলার রাষ্ট্রভাষা।
কিন্তু আমাদের দাবির যৌক্তিকতা বেশি থাকতো, কোনভাবে নস্যাৎ করা যেত না সেটা হলো বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। কারণ পাকিস্তানের ৫৪ ভাগ বাংলায় কথা বলতো। ছয় দশমিক চার শূন্য ভাগ উর্দুতে কথা বলতো। কাজেই উর্দুতে সামান্য কয়েকজন মানুষ কথা বলত। যেটা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও ভাষা ছিল না। অথচ এই জিন্নাহই রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে বলে কার্জন হলে ঘোষণা দিয়ে গেলেন।
এটা কেন হলো? আমাদের ভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেক লেখা আছে যারা লেখেছেন তারা আমাদের নমস্বর। আমাদের ইতিহাস উপহার দিয়েছেন। কিন্তু উর্দুকে কেন রাষ্ট্রভাষা করা হলো এই প্রশ্নের উত্তরটি নেই।
উত্তরটা অনেক দীর্ঘ বিস্তৃত। আমি সংক্ষেপে বলি, উর্দুকে মুসলমানি ভাষা ভাবা হতো। আরবি হরফে লেখা। আর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ধর্মের রাজনীতি করেছেন। সেই সুবাধে তিনি উর্দুর সপক্ষে নিজের অবস্থান চিহ্নিত করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিলেন।
এটা মুসলমানি আবেগ, আর মুসলমানি আবেগ থেকে বাংলাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হতো। যেমনটা সেন আমলে বাংলাকে নিকৃষ্ট পক্ষিকুলের ভাষা বলা হয়েছিল। পাকিস্তানিরা নিকৃষ্ট হিন্দুদের ভাষা বলে অবহেলা করেছিল। পাকিস্তানিরা ইমলামের নামেই তো এই কাজগুলো করেছে। তারা ইসলামও জানে না, কোরআনও পড়েনি, পড়লেও বুঝেনি।
কারণ সূরা আর রহমানের দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, খালাকাল ইনসান, চতুর্থ আয়াতে বলা হয়েছে, মানুষের মুখে ভাষা দেয়া হয়েছে। এটা সত্যি মানুষ ভাষা পরিচর্যা করেছে। মানুষ যে কথা বলছে সেটা শ্রষ্টার অবদান। তার ইচ্ছা হলে এখনই আমার মুখটা বন্ধ হয়ে যাবে।
সূরা ইব্রাহিম ও সূরা ফাতেহায়ও বলা হচ্ছে, পৃথিবীর প্রতিটি সম্প্রদায়ের ভাষায় অবতার পাঠানো হয়েছে। অর্থাৎ ভাষিক বহুত্বকে কোরআনে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। আর ভাষার নিকৃষ্টাত্বক ও শ্রেষ্টত্ব কিছুই বলা হয়নি।
বাংলা এবং বাংলিশ এটা তো চমৎকার কৌতুকের মতো। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় যখন শ্রেণিকক্ষে পড়াই, তখন আমি দেখেছি, আমাদের শিক্ষকদেরকে বাংলিশে পড়াতে হতো। বাংলা এবং ইংরেজি দিয়ে। এটার আমি ঘোরতর বিরোধী। যারা বাংলা ও ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলেন, তারা ইংরেজিও জানেন না বাংলাও জানেন না।
যখন ইংরেজিতে টান পরে, তখন বাংলায় আর যখন বাংলায় টান পরে তখন ইংরেজিতে যান। দুটো ভাষাই অসুদ্ধভাবে ব্যবহার করেন। এটা না করাটাই ভাল।
ব্যাপারটা এমন রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে লন্ডনে গেলেন, তখন এক বাঙালি তার কাছে এসে অভিনন্দন জানালেন। বাঙালি বহুদিন বাংলাদেশ ছাড়া। বাঙালি ভাঙা ভাঙা বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে বললেন, ‘আমি তো বাংলা ভাল বলতে পারি না। আপনাকে অভিনন্দন জানাই ইংরেজিতে।’ রবীন্দ্রনাথ উত্তর দিলেন, ‘আপনি বলুন আমি কিছু ইংরেজি বুঝি।’
যখন বলা শেষ হয়ে গেল তখন রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘বুঝলাম তাহলে আপনি বাংলাটা ভুলে গেছেন, ইংরেজিটাও রপ্ত করতে পারেন নাই।’
আমাদের জাতিগত সমস্যা এটা। তবে সাধারণ মানুষের সমস্যা নয়, সাধারণ মানুষ মাটির কাছাকাছি মানুষ। তারা মাটির ভাষায় কথা বলেন। আমরা যারা শিক্ষিত উপর তলার মানুষ তথাকথিত তাদের মধ্যে এই বাংলিশের সমস্যা। শুধু তাই না। ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা, যারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে তারা সঠিকভাবে ইংরেজি-বাংলা বলতে লিখতে পারে না। এটা আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি। ৪৮ বছরের শিক্ষকতায়, ইংরেজি মাধ্যম থেকে যারা আসে তারা কেউ সঠিক ইংরেজি লেখতে পারে না। তারা আবার বাংলা বললে ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা বলে।
এটা আমাদের উচ্চারণগত সমস্যা, ব্যাকরণগত সমস্যা, আমাদের লেখার সমস্যা, বলার সমস্যা। পত্রিকা পত্র খুললে দেখবেন, আমাদের লেখক-লেখিকারা যা লিখে যাচ্ছেন তার ভাষিক ত্রুটি কতটুকু আছে।
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন