নিউইয়র্ক থেকে প্যারিসের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া একটি ফ্লাইট (TWA800) উড্ডয়নের পরপরই আকস্মিকভাবে বার বার দিক পরিবর্তন করছিল। বিমানটি ছিল বোয়িং ৭৪৭-১০০ মডেলের। বোস্টন কন্ট্রোল তার অবস্থা বেগতিক দেখে বিমানটিকে ১৫০০০ ফুট উচ্চতায় চলে যেতে পরামর্শ দেয়। ফলে বিমানটি ১৬০০০ ফুট উচ্চতায় চলে যায়। কিন্তু পাইলট শেষবারের মত শুধু বলল, "Look at the crazy fuel flow.... "। এর ঠিক দুই মিনিট ৩০ সেকেন্ড পর বিধ্বস্ত হয়ে যায় বিমানটি। অর্থ্যাৎ উড্ডয়নের ঠিক ১২ মিনিটের মাথায় নিউইয়র্কের সমুদ্র সৈকত থেকে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে থাকে বিমানের ধ্বংসাবশেষ। ২৩০ জন যাত্রীর সবাই নিহত হয়।
এক যাত্রীর লাগেজ মেলাতে না পারার কারণে ১ ঘন্টা ২মিনিট ফ্লাইটটি ডিলে হয়েছিল। সকাল ৭টার পরিবর্তে ৮টা ২মিনিটে বিমানটি উড্ডয়ন করে। প্রকৃতি হয়তো চাচ্ছিল না বিমানটি ছেড়ে যাক। কারণ সকলের অজান্তে বিমানের ফুয়েলিং সিস্টেম (Fuel Quantity Indication System-FQIS)-এ ঘটে গিয়েছিল একটি বড় ত্রুটি।
যাহোক, মাসব্যাপী উদ্ধার কাজ চলতে থাকল। উদ্ধার করা লাশের অর্ধেকই মস্তকবিহীন পাওয়া গেল। বিমানের মাঝখানে একটি বড় বিস্ফোরণের ফলে বিমানটি দু'টি বৃহৎ খণ্ডে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। বিস্ফোরণটি সেন্ট্রাল ফুয়েল ট্যাংকে ঘটেছিল বলে প্রমাণ পায় অনুসন্ধানী টিম।
বিস্ফোরণের উৎসে বিস্ফোরকের ভূমিকা ছিল কিনা সেটার পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হলো। এরকম আরও নানা বিষয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলতে থাকল। এভাবেই বেশ কিছুদিন কেটে যায়। একসময় সকল বিশেষজ্ঞবৃন্দ একমত হন যে, বিমানটি উড্ডয়নের পরপরই পাইলট এক ধরনের জটিলতা অনুভব করেন। কারণ ফুয়েল ট্যাংকগুলোর মধ্যে একটিতে ফুয়েল রিজার্ভের পরিমাণ কম ছিল। ফলে বিমানের বাম পাশের ফুয়েল ট্যাংক থেকে ডান পাশের ট্যাংকে ফুয়েল ট্রান্সফার করতে হয়েছিল। ফুয়েল ট্রান্সফার করে পরিমাণ এবং ওজনের সমতা আনা হচ্ছিল, কিন্তু মাঝখানের রিজার্ভারটি (ট্যাংক) যে সম্পূর্ণরূপে শূন্য ছিল তা সেন্সর ইন্ডিকেট করেনি। এতে সেন্ট্রাল রিজার্ভ ট্যাংকে ফ্ল্যামেবল ফুয়েল ভ্যাপারের আধিক্যের ফলে একটি বড় বিস্ফোরণ ঘটে। যেখানে হয়তো ত্রুটিপূর্ণ ওয়ারিং সিস্টেমের শর্টসার্কিট থেকে ইগনিশন ঘটে থাকতে পারে।
যাহোক, বিমানটি মাঝ বরাবর দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে সাগরে আছড়ে পড়ে। সাগরে পতিত হবার আগেই প্রায় ৫০০ কিমি ঘণ্টা বেগে ধাবমান বিমানের পিছনের খণ্ডের যাত্রীরা বাতাসের প্রবল বেগে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ছিন্নমস্তক হয়ে যায়। ফলে পিছনের এবং সামনের যাত্রীদের লাশের আকৃতিতে তারতম্য ঘটে।
বিমান দুর্ঘটনা (Aeroplane Crash) তদন্তের উপর ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে একটি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলাম। মূলত এটি ছিল 'Big Case Management'-এর একটি চ্যাপ্টার। তবে, মূল কোর্সের নাম ছিল 'Post Blast Investigation (PBI)। সেই কোর্সে আমাদের ইন্সট্রাক্টর ছিলেন উল্লিখিত বিমান দুর্ঘটনার একজন (এফবিআই) ইনভেস্টিগেটর।
বিশ্বের মোট ৩টি বড় বড় বিমান ক্রাশের তদন্ত পদ্ধতি আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়। সেগুলোর প্রতিটি ঘটনাতেই বিমানের সকল ক্রু এবং যাত্রী নিহত হন। এগুলো বিশ্বের পৃথক ৩টি দেশে ঘটে যাওয়া বিমান দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনার পরপরই গণমাধ্যমে প্রকাশিত অনুমান ভিত্তিক সংবাদ এবং জনশ্রুতিগুলো কর্তৃপক্ষের 'অফিসিয়াল অনুসন্ধান' শেষে ভুল প্রমাণিত হয়। কিন্তু ততদিনে বিশ্ববাসী মুখ ফিরিয়ে নেয় সেই সব বিমান কোম্পানির ফ্লাইটগুলো থেকে। ফলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় তাদের ব্যবসা। বেকার হয়ে পড়ে অনেক কর্মচারী। অনেক ক্ষেত্রে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সকল এয়ারলাইন্সের ভ্রমণকারীরাও। তাদের অনেকেই নিশ্চিত ভ্রমণ পরিকল্পনাও বাতিল করে দেয়।
আমরা যারা সেই কোর্সের শিক্ষার্থী ছিলাম তারাও বিমানের এসব টেকনিক্যাল বিষয়াদি জানার পর আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলাম। এমন কি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিমান ছাড়াই ভিন্ন কোনো বাহনে দেশে ফেরার কথা (মনে মনে) ভাবছিলাম। যদিও আমরা জেনেছিলাম যে, বিমানের টেকনিক্যাল দিকগুলো খুব সুক্ষ্ম ও নির্ভরযোগ্যও বটে এবং পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিমান হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে নিরাপদ বাহন। তবুও সেই তিনটি বিমান দুর্ঘটনার আদ্যোপান্ত জেনে আমরা অনেকটা আতঙ্কিত হয়েছিলাম।
এরকম আতঙ্কের কারণেই প্রতিটি বিমান দুর্ঘটনার পরপরই ধ্বস নামে যে কোনো অঞ্চলের সামগ্রিক এয়ারলাইনন্স ব্যবসাতে। কিন্তু, অনুসন্ধান শেষে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ জানার পর অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে থাকে। অবশ্য ততদিনে পাল্টে যায় পৃথিবীর অনেক সমীকরণ।
তাই নিরাপত্তা এবং ব্যবসায়ীক বিবেচনায় খুব সুক্ষ্মভাবে বিমান দুর্ঘটনার অনুসন্ধান কার্য সম্পন্ন করা হয়। কন্ট্রোল রুমের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবার আগ মূহূর্ত পর্যন্ত পাইলটের কথোপকথন, ক্রাশের ধরণ, ক্রাশ সাইট থেকে উদ্ধার করা বিমানের ধ্বংসাবশেষের ভৌত অবস্থা, যাত্রীদের (লাশের) দৈহিক ক্ষত, ব্ল্যাকবক্স থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি, স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য (যারা ক্রাশ হতে দেখেছে) প্রভৃতি বিষয় খুব সুক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেন বিশেষজ্ঞরা। এভাবেই বের হয়ে আসে যেকোনো বিমান দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ। যদিও বিশ্বের অনেক ঘটনার সুরাহা এখনও হয়নি।
TWA-800 -এর দুর্ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিমানের রিফুয়েলিং সিস্টেম নিয়ে সবাই সচেতন হয়ে উঠে। রিজার্ভারগুলো পুরোপুরি চেক না করে উড্ডয়ন করা নিষিদ্ধ হয়।
আশা করি কাঠমান্ডুতে বিধ্বস্ত আমাদের ইউ এস বাংলা এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজটিতে কি ধরনের গোলযোগ ঘটেছিল তা আমরা জানতে পারবো শিগগিরই। কিন্তু এই মুহুর্তে মর্মান্তিকভাবে হারিয়ে যাওয়া কিছু প্রাণের জন্য আমরা মাগফেরাত কামনা করছি। যারা চলে গেছেন তাদের আত্মা শান্তি পাক, আর আমরা যারা বেঁচে রইলাম তাদের ভবিষ্যৎ বিমান যাত্রা নিরাপদ হোক এই কামনাই করি।
(তথ্যের সুক্ষ্ম বিচ্যুতি ঘটে থাকলে তা আমার টেকনিক্যাল জ্ঞানের স্বল্পতার জন্য ঘটে থাকতে পারে। আশা করি সবাই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)
সানি সারোয়ার
লেখক : অ্যাডিশনাল এসপি, বাংলাদেশ পুলিশ
পাঠক মন্তব্য
TWA crash was due to explosion of central fuel tank. But most of the accidents happen due to pilot's errors and unfavorable weather conditions. Nepal air tragedy happened due to combined error of pilot and ATC staff. Moreover Tibhobon airport is one of the most dangerous airport with record number of air crash.
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন