শেখ আদনান ফাহাদ
বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন আজ। মহান এই নেতার পৃথিবীতে আগমন উপলক্ষে প্রতিবছর ১৭ মার্চ জাতীয় শিশু দিবস পালন করা হয় বাংলাদেশে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী আলাদা বাণী দেন। প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শিশুদের সম্পৃক্ত করেও অনেক কর্মসূচি পালন করা হয়। কিন্তু দেশের সব শিশু কি সমানভাবে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে পারছে?।
হরেক রকমের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য এমনিতেই দেশের শিশুরা একই রকমভাবে জাতির পিতাকে জানতে পারছে না। একদিকে মূলধারার সাধারণ স্কুল ব্যবস্থা, অন্যদিকে মাদ্রাসা ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। তদুপরি দেশব্যাপী গজিয়ে উঠা কিন্ডার গার্টেনগুলো তো আছেই। জাতির পিতা সম্পর্কে সব স্কুলে বাচ্চারা সত্য ইতিহাস যথাযথ গুরুত্ব সহকারে জানার কথা। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নাকের ডগায় খোদ রাজধানী ঢাকাতেই একটি কিন্ডার গার্টেনের পাঠ্যবইতে বঙ্গবন্ধুকে এমন অবমাননাকরভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ আছে বলে মনে হচ্ছে না।
মিরপুরের টোলারবাগে অবস্থিত একটি কিন্ডার গার্টেনে স্টেপ ৩ (কেজি) ক্লাসে পড়াশুনা করে আমার এক পরিচিত জনের ছেলে। স্কুল থেকে ‘আমার বাংলা পড়া’ শীর্ষক একটা বই দেয়া হয়েছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। বইটিতে ‘ছবি দেখা ও পড়া’ নামের একটি চ্যাপটার রয়েছে। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘বাংলার ও বাংলাদেশের অনেক স্বাধীনতাকামী মহান ব্যক্তির জন্ম হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ঈসা খান, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, তিতুমীর, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ জিয়াউর রহমান ও আতাউল গণি ওসমানী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য’।
উল্লেখিত বাক্যে শব্দ ব্যবহার ও বাক্যগঠন সংক্রান্ত ভুল রয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হল, বইটিতে শিশুদের সামনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খুবই সাদামাটাভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অনেকে বাঙালি অতীতে এসেছেন, এখন আছেন এবং ভবিষ্যতে আসবেন। অনেকে অনেক কিছু করবেন, করছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সমতুল্য কেউ হতে পারবেন না, হওয়ার সুযোগ নেই। বিশ্বে বাঙালির একমাত্র রাষ্ট্র বাংলাদেশ দিয়ে গেছেন তিনি।
বিবিসির জরিপে বাঙালিদের ভোটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে বিশ্বসেরা ভাষণগুলোর মধ্যে স্থান দিয়েছে ইউনেস্কো। কিউবার কিংবদন্তী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, মুজিবকে দেখেছি’। বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন সেই ১৯৪৭ সাল থেকে। পাকিস্তান যুগে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সে আমলের ২৪ বছরের মধ্যে ১৪ বছর তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন, অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করেছেন। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক কর্মতৎপরতায় ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হলেও বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্নে জাগিয়ে ঐক্যবদ্ধ করেছেন ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে।
একটি পরাধীন জাতিকে তিনি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রস্তুত করেছেন, ভেতো বাঙালি থেকে বীর বাঙালি বানিয়েছেন, শহীদ হতে শিখিয়েছেন, স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তিকে ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে, নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু তাই বাংলাদেশের বাঙালি জাতির পিতা। শুধু বাঙালির হৃদয়ে নয়, সংবিধান মোতাবেকও তিনি জাতির পিতা। এমন একজন মহান মানুষকে, বিশ্বজয়ী নেতাকে অন্যদের সঙ্গে সাদামাটাভাবে উপস্থাপনের উদ্দেশ্য হল তাঁকে ছোট করা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাকে পদদলিত করা।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে গেলে সবার আগে যার নাম আসবে তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাসের ক্রমধারায় অনেকের নাম আসবে, সবার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা। বঙ্গবন্ধুর পরেই যার নাম আসবে তাঁরা হলেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এবং ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের নাম। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারগণ, তিন বাহিনী প্রধানগণ, মুক্তিযুদ্ধে তৎপর নানা বাহিনীর প্রধানদের নামও আসতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এই অবিচ্ছেদ্য নামগুলো বাদ দিয়ে বাচ্চাদের জন্য লেখা একটি বইতে শহীদ হিসেবে নাম আসল জিয়াউর রহমানের!
জিয়াউর রহমান কী ছিলেন? একজন সেক্টর কমান্ডার, একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করার সুযোগ দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারাই জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ চরিত্র হয়ে উঠার রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিলেন। ওই দিনের আগে জিয়াউর রহমানকে সাধারণ মানুষ কেউই চিনতেন না। মার্চের শেষ সপ্তাহে জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মেজর হিসেবে জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ নেতারা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করে ভাবছিলেন কীভাবে একজন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা পাওয়া যায়। বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা যদি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে পাঠ করেন, তাহলে মানুষ আরও উজ্জীবিত হবে। এই ভাবনা থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি মেজর জিয়াউর রহমানকে কালুরঘাটে নিয়ে আসা হয়। তিনিও মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সেটি পাঠ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমান সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন। এর জন্য তিনি বীর উত্তম খেতাব পেয়েছেন। এরকম বীর উত্তম খেতাব আরও কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা পেয়েছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরে জিয়াউর রহমান যা করেছেন, তাতে তাঁর যুদ্ধকালীন সব কাজ কলঙ্কিত হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর আমলে প্রমোশন নিয়েছেন, শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা হয়েছেন। সেই বঙ্গবন্ধুকেই হত্যার অন্যতম নির্দেশদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। খুনি কর্নেল ফারুক আর শাহরিয়ারকে জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের আগে বলেছিলেন, ‘আমি সিনিয়র অফিসার হয়ে সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নিতে পারি না, তোমরা জুনিয়র অফিসাররা করতে চাইলে কর’। সাংবাদিক এন্থনি মাস্কারেনহাস এর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারিতে খুনি দুই কর্মকর্তার পুরো বক্তব্য ধারণ করা আছে।
ইউটিউবে সার্চ দিলেই সেই ভিডিও আসবে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে খুনিদের বাঁচানোর জন্য ইন্ডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াতের আমির গোলাম আযমকে পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন করেছেন। শুধু গোলাম আযম নয়, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে দিয়েছেন, সরকারি দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। মূলত আজকের বাংলাদেশে যত সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সমস্যা দেখা যাচ্ছে, তার পেছনে দায়ী অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হলেন জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধপন্থী কত অফিসারকে জিয়াউর রহমান হত্যা করেছেন তার কোনো হিসেব নেই। বঙ্গবন্ধুর বেঁচে যাওয়া দুই মেয়ে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাকে বাবার কবর জিয়ারত করতে দেননি, ৩২ নং বাড়িতে আসতে দেননি ৬ বছর। ছাত্রসমাজের হাতে অস্ত্র এবং নগদ টাকা তুলে দিয়ে ছাত্র রাজনীতিকে কলুষিত করেছেন। জিয়াউর রহমানকে হাইকোর্ট একজন অবৈধ সামরিক শাসক হিসেবে রায় দিয়েছে। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম নির্দেশদাতা হিসেবে ভূমিকা রেখেছিলেন। তাকেও ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য গুলি করে হত্যা করে।
বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করার জন্য, তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করার জন্য স্বাধীনতা বিরোধী স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক শক্তি কৌশলে জিয়াউর রহমানকে সামনে এনেছে। জিয়াউর রহমানও ক্ষমতার শীর্ষে যেতে প্রতিটি সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন। তৎকালীন মিডিয়া একদিকে বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করেছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিবেশ তৈরি করেছে। অন্যদিকে জিয়াউর রহমানকে মহিমান্বিত করা হয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বদলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। বাঙালিকে বিভক্ত করা হয়েছে।
এমন একজন মানুষকে বাচ্চাদের একটি বইতে বলা হয়েছে শহীদ! আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতাকামী হিসেবে যেনতেনভাবে স্থান দেয়া হয়েছে। শুধু বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা বলে জিয়াউর রহমানকে জাতির পিতা এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক তালিকায় স্থান দিতে হবে? অন্যান্য সেক্টর কমান্ডার কিংবা বীর উত্তমদের তো আমরা স্মরণই করি না।
ঢাকার মিরপুরের এই কিন্ডার গার্টেনের মত হাজার হাজার শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সারা দেশে আছে। এসব শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকার অনুমোদিত পাঠ্যবই এর বাইরে তাদের নিজেদের তৈরি বই পড়ানো হচ্ছে কি না, সরকার কি খবর নিচ্ছে? মাদ্রাসা বা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কী পড়ানো হচ্ছে, আল্লাহ মালুম! মিরপুর এই রাজধানীতেই।
স্কুলটির পাশেই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। মিরপুরে কত বড় বড় আওয়ামী লীগ নেতা রয়েছেন, কত এমপি আছেন। জয়বাংলা স্লোগানে গলা ফাটানোর কত লোক আছেন। কিন্তু কারও নজরে পড়েনি মিরপুরের সেই কিন্ডার গার্টেনের পাঠ্য বইটি। খবর নিয়ে জানলাম, সেই শিশুর পিতা আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জানিয়েছেন। কিন্তু কেউ কোনো একশন নেননি। অথচ বঙ্গবন্ধুর নামে এরা স্লোগান দিয়ে মাঠ গরম করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে যারা অবমাননা করে তাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারেন না।
বঙ্গবন্ধু কী ছিলেন, কে ছিলেন, তাঁর আদর্শ কী, বাংলাদেশের জন্য তিনি কেন মহাগুরুত্বপূর্ণ, এগুলো নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে হলে সবার আগে আওয়ামী লীগের সকল নেতা-কর্মীর এগুলো জানতে ও মানতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকের চলাফেরা দেখলে তো মনে হয় না, এরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের লোক। আমি তো মনে করি, এদেশের প্রতিটি সৎ, নিষ্ঠাবান ও পরিশ্রমী নাগরিকই জাতির পিতার আদর্শের লোক।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন