লিয়াকত আলী ভূঁইয়া
লন্ডন গিয়ে মাদাম তুসোয় না যাওয়া মানে দিল্লি সফরে তাজমহল না দেখার শামিল। অনেক বছর পেছনে ফিরে যাচ্ছি। ২০০০ সালে লন্ডন সফরে গিয়েছিলাম। জগদ্বিখ্যাত মোমের জাদুঘর মাদাম তুসো পরিদর্শন ছিল আমার লন্ডন সফরের অন্যতম ভালো লাগার বিষয়। শুধু আমি কেন যেকোনো পর্যটকের কাছেই মাদাম তুসো লন্ডন সফরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান।
মাদাম ম্যারি তুসো নামের এক ফরাসী নারী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিখ্যাত মোমের ভাস্কর্যের জাদুঘরটিতে গিয়ে আমি বিস্মিত ও অভিভুত হয়েছিলাম। সারা বিশ্বের কিংবদন্তিদের ভাস্কর্য নিয়ে এ জাদুঘর। বিশ্বখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক থেকে অভিনেতা, কিংবদন্তি খেলোয়াড়রা যেন জীবন্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাদাম তুসোয়! এ যেন জীবন্ত মানুষের চকচকে জাদুঘর। আব্রাহাম লিংকন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব সাবেক প্রেসিডেন্টের ভাস্কর্য দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। ব্রিটিশ সামাজ্যের শাসকদের গর্বিত ভাস্কর্যও দেখলাম।
আমি তখন চিন্তা করলাম, নিশ্চয়ই আমাদের দেশের জাতির জনকের ভাস্কর্যও এখানে আছে। তার মতো সর্বকালের অন্যতম সেরা স্বাধীনতা সংগ্রামীর ভাস্কর্য না থেকেই পারেই না। আমি খুঁজতে লাগলাম আমাদের প্রিয় নেতার ছবি। কিন্তু খুঁজে খুঁজে শুধু হয়রানই হতে হয়েছিল আমাকে। কোনো ছবিই বাদ দেইনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যটাই পেলাম না খুঁজে। অথচ পেলাম পাকিস্তান-ভারতের অনেককে। যারা নাম ধাম বা কীর্তিতে বঙ্গবন্ধুর চেয়ে এগিয়ে নন। লারা, টেন্ডুলকার, মেসি, রোনালদো, বেকহ্যাম এমনকি ভারতের চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব অমিতাভ বচ্চনের ভাস্কর্যও নাকি সেখানে বসানো হয়েছে। অথচ বঙ্গবন্ধুর মতো একজন বিশ্বখ্যাত নেতা ও রাষ্ট্রনায়কের ভাস্কর্য সেখানে নেই। যেটা আমাকে পীড়া দিয়েছে ভীষণভাবে এবং এখনও দিচ্ছে।
সমস্ত জাদুঘর দেখার পর মন খারাপ নিয়ে ঘোরাফেরা করছিলাম। এরই মাঝে পরিচিত হলাম ৭০ বছর বয়সী এক ব্রিটিশের সঙ্গে। বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে যার অনেক জ্ঞান। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে তার অগাধ জ্ঞান আমাকে যারপর নাই মুগ্ধ করল। তিনি দুইবার বাংলাদেশ সফরে করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু তো বটেই শাইখ সিরাজ সম্পর্কেও তিনি অনেক কথা আমাকে বলেছিলেন। শাইখ সিরাজের অনেক প্রশংসা তিনি আমার কাছে করেছিলেন। তবে এ বিষয়ে নাইবা গেলাম।
ভাবলাম, তাকে আমি প্রশ্ন করব, মাদাম তুসোয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নেই কেন। কী আশ্চর্য! তার আগেই তিনি উল্টো আমাকে প্রশ্নটা করে বসলেন। ‘এখানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নেই কেন?’ ‘আমি বললাম, আমারও তো একই প্রশ্ন।’ আমার মতো তিনিও দেখলাম হতাশ। তিনি বললেন, ‘তোমাদের নেতার ভাস্কর্য এখানে থাকলে বাংলাদশ ও স্বাধীনতার ইতিহাস বিশ্ববাসী জানতে পারত। তোমাদের সম্মান বৃদ্ধি পেত। তার কথা আমার মনে ধরলো। বঙ্গবন্ধুর প্রতি একজন বিদেশির এতটা ভালোবাসা থাকতে পারে, জানা ছিল না। তিনি যেন আমার চেয়েও বঙ্গবন্ধুপ্রেমী!
মাদাম তুসোয় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নেই কেন? গত ১৮ বছর ধরে এ বিষয়টা আমাকে নিরন্তর পীড়া দিয়ে চলেছে। আমি অনেকের কাছেই বিষয়টি বলেছি। অনুরোধ করেছি সেখানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনে কাজ করতে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। কেউ এ ব্যাপারে আন্তরিক হয়নি। আমি এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করছি, তিনি যেন এ বিষয়ে উদ্যোগী হন। তিনি যেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন এ বিষয়টা নিয়ে কাজ করতে। আমার মনে হয় এটা কঠিন কোনো কিছু হবে না। ভালো ভূমিকা রাখতে পারে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসও।
বঙ্গবন্ধু তো বঙ্গবন্ধুই। মাদাম তুসোয় তাঁর ভাস্কর্য নেই বলে যে তাঁর মর্যাদা কমে গেছে বিষয়টা মোটেও সেরকম নয়। মাদাম তুসোয় এমন অনেকেই স্থান পেয়েছেন যারা নানা বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর চেয়ে ঢের পেছনে। কথা হলো, বঙ্গবন্ধুর মতো অবিসাংবাদিত নেতার স্থান হবে না কোন যুক্তিতে?
লিয়াকত আলী ভূঁইয়া: প্রথম সহ-সভাপতি রিহ্যাব
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন