মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার
নিঃস্ব ও দরিদ্রদের মাঝে ইফতার এবং জাকাতসামগ্রী বিতরণের বিশাল আয়োজন করেছিল একটি বৃহৎ শিল্প গ্রুপ কর্তৃপক্ষ। সকাল থেকে বিতরণ শুরু করার পরক্ষণে ঘটে যায় একটি মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা।
ইফতার ও জাকাতসামগ্রী গ্রহণের জন্য হাজির হয়েছিল ৩০ হাজারেরও অধিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ। ফলে ব্যাপক ভিড় সৃষ্টি হয় দানপ্রত্যাশী জনগোষ্ঠীর। আর এ ধরনের আয়োজনগুলোতে দানপ্রার্থীদের অধিকাংশই থাকে নারী।
প্রচণ্ড গরম, মানুষের ওপর মানুষ ঠাসা হয়ে ইফতার ও জাকাতসামগ্রী নিতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি ও পদদলিত হয়ে প্রাণ হারিয়েছে ১০ জনের অধিক লোক। আহত হয়েছে আরও অর্ধশতাধিক।
এদের এদের মধ্যে নবীন থেকে প্রবীণ বিভিন্ন বয়সের মানুষ রয়েছে। ভাবতেই অবাক লাগে, স্তব্ধ হয়ে যায় আপাদমস্তক রক্ত সঞ্চালন। জীবনের এত সস্তা মূল্য সেখানে।
ইতিহাসের পাতায় এ ধরনের অসংখ্য ঘটনার দুঃখজনক স্মৃতি থাকার পরও তেমন কোনো প্রস্তুতি না নিয়েই এমন আয়োজনের সূচনা হয়। যদি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাক তো তাহলে এই মৃত্যু এড়ানো যেত।
কে কোন উদ্দেশ্যে এমন আয়োজন করেন স্ব স্ব অভ্যন্তরের কথা তারাই ভালোভাবে জানেন। কিন্তু যদি এটি স্রষ্টার নির্দেশ থাকার ফলে করে থাকেন তাহলে সেখানে বিতরণের নীতিমালাও সংযুক্ত করা আছে। তাই স্রষ্টার মদদ পাওয়ার উদ্দেশ্যে যদি কেউ মানুষকে সাহায্য করে তাহলে এ ধরনের দুর্ঘটনা কখনোই কাম্য নয়। আর এটি তো সাহায্য বা করুণাও নয়, এটি হলো পরস্পরের প্রতি অধিকার।
এ দেশে জাকাতের কাপড় আনতে গিয়ে পদদলিত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগেও এ ধরনের দুঃখজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এবং তার ধারাবাহিকতাও সফলতার সঙ্গে বিরাজমান রয়েছে। তারপরও ঠিক কুকুরের লেজের আদর্শ ধারণ করে নির্লজ্জ থেকে যায় সীমাহীন সম্পদের রক্ষক ও ভক্ষক উঁচুতলার ভিআইপিরা।
অকাতরে মানুষের মৃত্যুর মিছিলের ধারবাহিকতা যেন তাদের জন্য এক অপরূপ জীবন্ত সিনেমা। যারা নিহত হয়েছে তারা দরিদ্র ও নিঃস্ব। আর যদি তারা অজস্র সম্পদের অধিকারীও হয় তাহলেও এখনও তাদের মধ্যে অপরের মুখাপেক্ষিতা বিরাজমান। সুতরাং, একজন মানুষ কোন স্তরে থাকলে অপরের মুখাপেক্ষী হয় তা কারও অজানা থাকার কথা নয়।
যেখানে প্রতিনিয়ত একটি দেশ কেবল উন্নয়নের পথেই ধাবিত হচ্ছে সেখানে পর নির্ভরশীল গণমানুষের সংখ্যাও বরাবর থাকছে। বঞ্চিত ও ক্ষুদার্থ মানুষের জীবনযুদ্ধের তীব্রতাও থাকে আগের মতো।
রামপুরার আস্তানা থেকে প্রতিনিয়ত শুধু গণমানুষের জাদুর মেশিনে উন্নতির গান-গল্প পৌঁছে দেয়া হয়। কিন্তু জীবনাচরণে তার কোনো ছোঁয়া নেই। রামপুরা যেন স্বর্গের একটি শাখা, জান্নাতের এক বিশেষ টুকরো।
মাঝে মাঝে কতিপয় জনসাধারণ আপসোস করে বলে ‘আহ! আমরাও যদি রামপুরার বাসিন্দা হতাম’। কারণ যখন সারা জনপদ জলে থইথই করে তখনও রামপুরা একদম শুকনো। ভূমিকম্প ও তুফানে যখন সবকিছু বিধ্বস্ত তখনও রামপুরা একেবারেই অক্ষত।
যে দেশের পরিচালকরা সমুদ্র জয় থেকে শুরু করে ইচ্ছেমতো সংবিধান সংশোধন করে নিজেদের ক্ষমতার মেয়াদ চিরস্থায়ী করার সক্ষমতা সংরক্ষণ করে, বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণেরও দুঃসাহস করে সাময়িক ক্ষমতাধারী দৃষ্টিহীনরা, উড়ালসেতু দিয়ে সড়ক বিজয় করে স্যাটেলাইট পাঠিয়ে মহাকাশকেও হাতের মুঠোয় বন্দি করে ফেলে। তারা শুধু ব্যর্থ হয় যাদের পুঁজি করে ক্ষমতার আসনে আরোহণ করে তাদের ক্ষুদা মেটাতে। তারা পারে না তাদের জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো পূর্ণ করার পথকে সুগম করে দিতে।
যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতে থাকবে তাদের একমাত্র কাজই যেন আত্মভাগ্যের উন্নয়ন করা, আর পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করে বারবার ক্ষমতার পথকে সুগম করা। মাঝখানে পুঁজি হলো জনসাধারণ।
কিন্তু চিরকাল এমন নাও থাকতে পারে। হয়তো একদিন তারাও বলবে ‘ আমাদের উন্নতি দাও, না হয় উড়ালসেতু ভাঙবো, ক্ষুদা যন্ত্রণার মুক্তি চাই, না হয় স্যাটেলাইট চিবিয়ে খাব’।
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও উপস্থাপক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন