রক্তের তলদেশ থেকে উত্থিত মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের নতুন সংবিধান কার্যকর হয় ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর। গত ৪৫ বছরে এই সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শভিত্তিক মানবিক-গণতান্ত্রিক এবং নৈতিক রাষ্ট্র নির্মাণে ব্যর্থ হয়েছে। এই সংবিধান দিয়ে আর মুক্তি-সংগ্রামের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। এই গভীর সত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নির্মাণ অসম্ভব হয়ে পড়বে।
৭২ এর সংবিধান বিদ্যমান থাকা অবস্থায় দু’বার সামরিক শাসন জারি করা হয়। প্রথমবার সামরিক শাসন জারি করেন খন্দকার মোস্তাক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর, সংবিধান ও সংসদ বহাল রেখেই। দ্বিতীয়বার সামরিক শাসন জারি করে সংবিধান স্থগিত করেন এইচ এম এরশাদ। জাতীয় সংসদ ছাড়াও সংবিধান সংশোধন হয়েছে সামরিক ফরমানে। গত ৪৫ বছর ধরে সংবিধানের চেতনায় বা নির্দেশনায় রাষ্ট্র পরিচালিত হয়নি। উপনিবেশিক শাসন, ঊনিশ শতকের ব্রিটিশ প্রণীত আইন বহাল রেখে স্বাধীন দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আকাংখাভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণের কোন উদ্যোগই নেয়া হয়নি।
সংবিধানকে ক্ষমতার স্বার্থে, দলীয় স্বার্থে এমনকি এক ব্যক্তির স্বার্থেও সংশোধন করা হয়েছে– সামরিক ফরমান দিয়ে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। ফলে রাষ্ট্র ক্রমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে আলাদা হয়েছে– বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এই বিচ্ছিন্নতার ছিদ্র দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নির্বাসিত হয়েছে– বঙ্গবন্ধুসহ রাষ্ট্র নির্মাণের স্থপতিদের হত্যা এবং জনগণের আকাংখা-স্বপ্ন নি:শেষ করার নির্মম প্রক্রিয়ার শুরু। সর্বশেষ ১৬তম সংশোধনী নিয়ে শুধু বিচার বিভাগের প্রধান নয় ‘বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি’র মত প্রতিষ্ঠানকে যেভাবে বিতর্কিত করা হল তাতে শুধু বিচার বিভাগ’ই বিনষ্ট হবে না, রাষ্ট্রের অন্যসব প্রতিষ্ঠানও বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
সংবিধানের নির্দেশনা শুধু নির্বাহী বিভাগ বা আইনসভাই লংঘন করেনি– বিচার বিভাগ ও সংবিধান রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানে নিরন্তর ভূমিকা রাখেনি। সামরিক শাসনের সময় বিচার বিভাগের ভূমিকাও সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। নিজেদের সুবিধার্থে ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে’ নিজেরাই নিজেদের মর্যাদা নির্ধারণ করে রায় দিয়েছেন– যা বিচার বিভাগের নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বৈষম্যহীন-ন্যায় সংগত সমাজের যে আকাংখা ও উদ্দেশ্য নিয়ে জনগণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির পত্তন করেছিলেন গত ৪৫ বছরে তা ক্রমাগত হারিয়ে গেছে-দূরবর্তী হয়েছে। ফলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভিত নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের চেতনা ও আদর্শ মানুষের মনন থেকে– রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে বিতাড়িত করায় সমাজ ও রাষ্ট্র অনৈক্যের অমিমাংসিত বিরোধে এবং পক্ষ-বিপক্ষের আপোষহীন বৈপরিত্যে জড়িয়ে পড়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউম হে’র অপসারণ বা বরখাস্তের রায়ে সাংবিধানিক আদালত বলেছেন ‘প্র্রেসিডেন্ট হে’র কর্মকান্ড গণতন্ত্রের চেতনা ও আইনের শাসনের গুরুতর ক্ষতি করেছে’। আদালত এও বলেছে, জনগণের আস্থাকে বিনষ্ট করা যায় না। তেমনি আমাদের দেশে সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক চেতনার ভয়াবহ ক্ষতি করেছে এবং জনগণের আস্থা বিনষ্ট করেছে– যার প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী। বঙ্গবন্ধু হত্যা, মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে বিকশিত রাজনৈতিক চেতনার পরিবর্তন এবং সামরিক শাসন জারি করার ক্ষেত্রে ৪র্থ সংশোধনী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের অনুক‚ল পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছে, এই মৌলিক সত্য অনুধাবনে ব্যর্থ হওয়ার মত বহু পন্ডিতমূর্খ দেশে রয়েছে। একটি মাত্র দল মুক্তিসংগ্রামের বাংলাদেশের সকল মানুষের আকাংখা বা চেতনার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। এসব স্বীকার না করলে সমাজ থেকে সত্যের বিনাশ ঘটবে। আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, ভাষা আন্দেলন, ৬ দফা-১১ দফার আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিসংগ্রাম স্ফুরিত হয়েছে বহুদলীয় গণতন্ত্রের বাতাবরণে।
একদলীয় শাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভার প্রশ্নে ৪র্থ সংশোধনীতে কী কী মৌলিক পরিবর্তন হয়েছিল তা পরখ করা উচিৎ। ৪র্থ সংশোধনীতে একদলীয় শাসনের প্রশ্নে ১১৭ অনুচ্ছেদে নির্দেশনা ছিল রাষ্ট্রে শুধু একটি রাজনৈতিক দল থাকিবে এবং রাষ্ট্রের সকল রাজনৈতিক দল ভাঙ্গিয়া যাইবে। অর্থাৎ একটি রাজনৈতিক দল ছাড়া রাষ্ট্রে আর কোন রাজনৈতিক দল থাকিতে পারিবে না। যে সকল দল তাদের ঘোষিত রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে দীর্ঘদিন লড়াই-সংগ্রামে আত্মদান করেছে, অগনিত নেতা-কর্মী-সংগঠক নির্যাতনের শিকার হয়েছে, কারাগারে গিয়েছে, দেশান্তরী হয়েছে সে সকল দল রাষ্ট্রপতির আদেশে ভেঙ্গে যাবে। যাদের দল তাদের কোন মতামত ছাড়াই রাষ্ট্রীয় আদেশে সেই দল বিলুপ্ত করা হবে– এই ছিল সাংবিধানিকভাবে এক দলীয় শাসন ব্যবস্থার রূপ।
৪র্থ সংশোধনীতে নির্বাহী বিভাগে যে সকল গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়:
এক.
৪র্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতি প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন এটা সংবিধান নিশ্চিত করেছে। প্রত্যক্ষ নির্বাচনের বিধান করেও রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত বিশেষ বিধান শিরোনামে [৩৪(খ) তে] বলা হয়েছে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হইবেন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করিবেন। উক্ত প্রবর্তন হইতে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকিবেন যেন তিনি এই আইনের দ্বারা সংশোধীত সংবিধানের অধীন রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হইয়াছেন’। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন জনগণ এবং সংসদ সদস্যের ভোট ছাড়াই। তারপরও প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন রাষ্ট্রপতি পদে, এটা নাকি ধরে নিতে হবে। যিনি ইতিহাসের মহানায়ক, যার নামে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, যিনি জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে কাটিয়েছেন সেই নেতাকে নির্বাচনবিহীন নির্বাচিত ঘোষণা করার কী উদ্দেশ্য ছিল তা জাতি কোন দিন জানতে পারবে না।
অন্যদিকে সংবিধানে রাষ্ট্রপতির মেয়াদ ৫০ অনুচ্ছেদ পাঁচ বছর নিশ্চিত করেছে। তার পরেও কী কারণে ৪র্থ সংশোধনীতে বলা হয়েছে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করিবেন এবং উক্ত প্রবর্তন হইতে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকিবেন। অর্থাৎ পাঁচ বছরেও মেয়াদের অবসান হবে না। প্রতি পাঁচ বছর পর পর রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে রাষ্ট্রের কী ক্ষতি হতো এর উত্তর কে দেবে?
দুই.
সংসদ সদস্যের বাইরে থেকেও সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করার বিধান করেছিলেন সংবিধানের ৫৮(৩) অনুচ্ছেদে– যা আমাদের সংসদীয় চেতনার পরিপন্থি।
অন্যদিকে, ৪র্থ সংশোধনীতে বিচার বিভাগ নিয়ে যে সকল পরিবর্তন আনা হয়েছিল:
এক.
৭২ এর সংবিধানে বিচার বিভাগে বিচারক নিয়োগে যত অনুচ্ছেদে প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া নিয়োগের নির্দেশনা ছিলো ৪র্থ সংশোধনী তা বিলুপ্ত করে দেয়। ফলে পরামর্শ ছাড়াই এককভাবে রাষ্ট্রপতি বিচারক নিয়োগের অধিকারী হন (যেমন সংবিধানের ৯৫ ও ৯৮ অনুচ্ছেদ)।
দুই.
৭২ এর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে ছিল প্রমাণিত অসদাচরণ ও অসামর্থের কারণে সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোন বিচারককে অপসারণ করা যাইবে না। আর ৪র্থ সংশোধনীতে সংসদ নয়– রাষ্ট্রপতির আদেশে বিচারক অপসারিত করা যাইবে বলে বিধান করা হয়।
তিন.
আদি সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ ছিল অধস্তন আদালতের নিয়োগে সুপ্রীমকোর্টের সুপারিশক্রমে এবং সুপ্রীমকোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দান করিবেন। কিন্তু ৪র্থ সংশোধনী সুপ্রীম কোর্টের সুপারিশ ও পরামর্শ দুটি’ই বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতি এককভাবে নিয়োগদান করার বিধান প্রণয়ন করেন।
চার.
আদি সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদ ছিল বিচার কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃংখলা বিধান সুপ্রীম কোর্টের উপর ন্যাস্ত থাকিবে। কিন্তু ৪র্থ সংশোধনী সুপ্রীম কোর্টের উপর ন্যাস্ততা বাতিল করে রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত করে। অর্থাৎ ৭২ এর সংবিধানে বিচার বিভাগের যেসকল কাজে প্রধান বিচারপতির পরামর্শ বা সুপ্রীম কোর্টের সুপারিশ বা সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যাস্ত ছিলো সব বাতিল করে রাষ্ট্রপতির কর্তৃত্বে নিয়ে আসা হয়। এর মাধ্যমে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের অধীনস্ত হয়ে পড়ে।
৪র্থ সংশোধনী নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের পর আইন সভায় একটি অভূতপূর্ব বিরল সংশোধনী এনেছিল। তা ছিল প্রথম সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি। অর্থাৎ ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ থেকে আরো পাঁচ বছর। প্রথম সংসদের মেয়াদ এমনিতেই আরো তিন বছর বাকি ছিল। কী অদূরদর্শিতায় সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি করতে হল তার ব্যাখ্যা কে দেবে। ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাজনীতি অবরুদ্ধ এবং রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বঙ্গবন্ধুর লাশ ধানমন্ডি ৩২ এর সিড়িঁতে রেখে খন্দকার মোস্তাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বা বাক্শাল’ই সরকার গঠন ও সামরিক শাসন জারি করে। সেই সরকার থাকা অবস্থাই জাতীয় চার নেতাকে কারাগারে হত্যা করা হয়, সেই সরকারই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধে ইনডেমনিটি জারি করে। বঙ্গবন্ধু জাতির নির্মাতা– তাঁর হত্যাকাণ্ড নিছক ফৌজদারী বিচারের বিষয় নয়– এটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। এসব গভীর সত্য উপলব্ধি করেই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নির্মাণ করতে হবে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের ফসল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রুশো বলেছেন, যে মূহুর্তে দেশের সুশাসন-অধিকার-আইনের শাসন প্রধান কাজ বলিয়া বিবেচিত হইবে না তখন বুঝিতে হইবে রাষ্ট্র ধ্বংসের নিকটবর্তী, যে মূহুর্তে নাগরিকগণ রাষ্ট্রের কাজ কর্ম বিষয়ে বলবে, আমাদের কী আসে যায়, সে মূহুর্ত হইতে ধরিতে হইবে রাষ্ট্র বিনষ্ট হইয়াছে।
একটি সমাজের সভ্যতা অপসারিত হয়ে যায় যখন সমাজের মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় উদ্বিগ্ন থাকে। অপারেশন ক্লিনহার্টেও মানুষ মরে– ক্রসফায়ারেও মানুষ মরে– পুলিশের গুলিতে আর পেট্রোল বোমায় মানুষই মরে। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক কারণে কত মানুষ খুন হয়েছে রাষ্ট্র তার হিসাবও দিতে পারবে না অথচ বলা হয়েছে একটি ফুলকে বাচাঁবো বলে জাতি-রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধ করেছিল।
সংবিধানে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ধারণ করা, শাসন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের রূপকল্পভিত্তিক মানবিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের উদ্যোগ নেয়ার জন্যই বাংলাদেশে সাংবিধানিক পর্যালোচনা করা জরুরি।
শহীদুল্লাহ ফরায়জী
পাঠক মন্তব্য
Brother, do not despair. Look at the new generation of students. I see the bright future. They are not getting a good education but I am sure they will self-educate themselves.
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন