বাংলাকে বলা হতো ‘জান্নাতুল হিন্দ’ তথা ভারতের বেহেশত। কেন বলা হতো? আসুন এক ইউরোপীয় পর্যটকের মন্তব্যেই তা দেখে নেই। ঐ সময়ে (১৭৫৬-৫৭ খৃষ্টাব্দ) এক ইউরোপীয় পর্যটক বাংলা এবং ভারত সফর করেন। তিনি বাংলার ব্যপারে বলতে গিয়ে বলেছেন:
"বাংলার অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের পরিমাণ এত বেড়ে গিয়েছিল যে, এখানে পারসিক, আবিসিনিয়ান, চীনা, তুর্কি, ইহুদী, আর্মেনীয় ব্যবসায়ীরা দলে দলে আসতে থাকেন।"
(সূত্রঃ মেজর জেনারেল এম এ মতিন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, সতেরো'শ সাতান্ন থেকে উনিশ’শ সাতচল্লিশ, প্রথম খণ্ড, দি ইউনিভার্সেল একাডেমি, ঢাকা, পৃ: ৩৬)
ফার্সভাষী ঐতিহাসিকরা তাদের লেখনীতে বাংলার নামকরণ করেছিলেন ‘জান্নাতুল বিলাদ’ বা নগর সমূহের জান্নাত। আর মুঘল শাসকরা তো তাদের রাজকীয় ফরমানে বাংলাকে অভিহিত করতেন ‘জান্নাতুল হিন্দুস্থান’ হিসেবে।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও পর্যটক আলেকজান্ডার ডো লিখেছেন;
"বাংলাই বিশ্বের একমাত্র ভান্ডার যেখানে সোনা দানা এসে জমা হতো, কিন্তু এখান থেকে কিছুই বের হতো না!"
কেন বের হতো না? তারও বর্ণনা দিয়েছেন ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ের। তিনি লিখেছেন;
"বাংলা এতই সম্পদশালী ছিল যে, এখানে একটা প্রবাদ চালু ছিল- বাংলায় প্রবেশের দরজা অসংখ্য কিন্তু বের হবার দরজা একটিও নেই! (সূত্র: ঐ)
এত সম্পদের প্রাচুর্য দেখে সারা বিশ্ব থেকে লোকজন ছুটে আসে এই বাংলায়। তারা এসেছিলেন ভাগ্যের সন্ধানে; ভাগ্য ফেরাতে। এসেছিলেন আরব, ফরাসি ও ইউরোপীয় এবং একইসাথে ওলন্দাজ পর্তুগীজরাও। উদ্দেশ্য সবারই এক- অর্থ ও সম্পদ হাতিয়ে নেয়া; বৈধ বা অবৈধ যেভাবেই হোক না কেন। এদেরই একটি দল হলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নামে আসা এক দল ইংরেজ বণিক, তস্কর। রবার্ট ক্লাইভ তাদেরই একজন, বাৎসরিক মাত্র পাঁচ পাউন্ড বেতনে চাকুরি করতে আসা অখ্যাত কেরানি। পরবর্তীকালে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এই তিনি হয়ে উঠেন ইতিহাসখ্যাত! ভারতের ভাগ্য বিধাতা; লর্ড ক্লাইভ।
লর্ড ক্লাইভের পরিকল্পনার ফলস্বরূপ আজ থেকে ২৬১ বছর ১ দিন আগে ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন বৃহস্পতিবার এক লজ্জাকর নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে এই বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছে। এ দেশেরই কিছু কুলাঙ্গার কিন্তু দক্ষ অভিনেতার দারুণ অভিনয়ের ধারাবাহিকতায় এ নাটক মঞ্চস্থ হয়।
নাটকের এক পক্ষে ছিল রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্য (নয়শত ইউরোপীয়, দুই হাজার একশত ভারতীয়) আর অপর পক্ষে ছিল বাংলার পঁয়ষট্টি হাজার (৬৫০০০) সৈন্য মীর জাফরের নেতৃত্বে। সৈন্যবাহিনীর সদস্য সংখার মধ্যে দৃশ্যমান এই বিরাট পার্থক্যের পরেও নিজ দেশের মাটিতে সেই পাঁচ হাজার মাইল দূর থেকে আসা মাত্র নয়শত সাদা চামড়ার ইংরেজদের কুটকৌশল আর তাদেরই ইন্ধনে কিছু দেশীয় গাদ্দারের কারসাজিতে যুদ্ধ নামক নাটকের মঞ্চায়ন হয়।
নাটকের স্ক্রিপ্ট তৈরী করেন জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, নবাবের খালা ঘষেটি বেগম, খালাতো ভাই শওকত জং এদের মত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ও। আরও রয়েছে ইয়ার লতিফ আর গোলাম হোসেন। এরাই মসনদের লোভ দেখিয়ে সামনে টেনে আনেন মীর জাফরকে। নিজের বা নিজেদের আর্থিক স্বার্থের কারণে জুড়ে যান নবাব সিরাজেরই সভাষদ রায় দূর্লভ, উমিচাঁদ’রাও।
মীর জাফর সাথে নেন জামাতা মীর কাশিম আলী খান’কে। ভেতরে ভেতরে আত্মবিক্রয়কারী দল বড় হতে থাকে। এর পরে তারা সকলে মিলে স্ক্রিপ্টে লেখা নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে নাটকের শেষ দৃশ্য পর্যন্ত।
রবার্ট ক্লাইভের সাথে আঁতাত করে এবং তার কাছ থেকে ঘুষ খেয়ে ক্ষমতার মসনদ দেয়া হবে এমন আশ্বাস পেয়ে নবাব সিরাজেরই ঘনিষ্ঠ লোকরা যাদেরকে বলা চলে নবাবের ডান হাত মীর জাফর, মীর কাশিম আলী গং যুদ্ধের ময়দানে পুতুলের মত দাড়িয়ে থেকে যুদ্ধের অভিনয় করে।
পলাশীর যুদ্ধ পর্যবেক্ষন করলে বুঝা যায় আমাদের পরাধীনতার একমাত্র কারণ হলো আমাদের ধর্ম বিশ্বাস, সংস্কৃতি আর ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে একটি বিজাতীয়, ভিনদেশী, ভিন্ন সংস্কৃতি নির্ভর ও অপূর্ণাঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থার অনুবর্তি হয়ে পড়া!
আমরা আমাদের পিছিয়ে পড়ার কারণটাও জানলাম। বিশ্বের স্বর্গ থেকে আধুনিক বিশ্বের একমাত্র নরকে পরিণত হবার কারণটাও জানলাম।
আমার প্রশ্ন হল অধঃপতনের এ কারণ জানার পরেও আমরা কেন তা নিরসনে ব্রতি হলাম না? আমরা কেন আমাদের শিক্ষা সংস্কারের পদক্ষেপ নিলাম না? সরকার ও প্রশাসন এ ব্যপারে পদক্ষেপ নেয়নি। মূল কারণটা জানার পরে আমরা নিজেরাও কি ব্যক্তিগত জীবনে নিজেদের জ্ঞান আর প্রজ্ঞার মানন্নয়নে পদক্ষেপ নিয়েছি? নেইনি।
না নেয়ার কারণ হল গলায় যে গোলামীর জিঞ্জির পরানো আছে সেটাকেই আমরা ফুলের মালা ভেবে বসে আছি! তার মানে আমরা মানসিক গোলামীতে আটকা পড়ে আছি। এভাবে এক এক করে ৯৫৩২৯ দিন তথা ২৬১ বছর পার হয়ে গেল। আজ শুরু হল ২৬২ তম বছরের প্রথম দিন। প্রশ্ন হল এরকম মানসিক গোলামীতে আর কতদিন বাঁধা থাকবো আমরা?
এভাবে আর কতদিন চলবে?
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন