শেখ আদনান ফাহাদ
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ নামক রাজনৈতিক সংগঠন যখন জন্ম নিচ্ছিল তখন বাংলাদেশের জাতির পিতা, তৎকালীন যুবক রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবুর রহমান জেলখানায় বন্দি। বন্দি অবস্থায়ই শেখ মুজিবকে সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ দেয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমান সেই ২৯ বছর বয়সেই পূর্ব বাংলায় জনগণের এমনই জনপ্রিয়তা এবং বিশ্বাস-ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন যে বন্দি মুজিবকেই গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখে পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী মুসলিম লীগের যাত্রা শুরু হয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে সে সময় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বলা যায় আন্দোলন চাঙ্গা করতে নিজে যেচে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন শেখ মুজিব। সে স্মৃতিচারণ করে শেখ মুজিব ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ছাত্র প্রতিনিধিদের ধারণা, আমি গ্রেপ্তার হলে আন্দোলন চলবে, কারণ আন্দোলন ঝিমিয়ে আসছিল। একে চাঙ্গা করতে হলে, আমার গ্রেপ্তার হওয়া দরকার। আমি তাদের কথা মেনে নিলাম। পাঁচ মিনিট পরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের গ্রেপ্তারের হুকুম দিলেন’ (রহমান, ২০১৬, পৃষ্ঠা ১১৭) ।
কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায়ই আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু কারাগারে বন্দি শেখ মুজিবই ছিলেন মুসলিম লীগ ও সরকার বিরোধী আন্দোলন ও রাজনৈতিক তৎপরতার প্রাণ।
১৯৪৯ সালের মার্চ মাসের শেষ দিকে অথবা এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে ঘোষণা করা হল যে, টাঙ্গাইলে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। শেখ মুজিবের ভাষায়, ‘আমরা ঠিক করলাম, শামসুল হক সাহেবকে অনুরোধ করব মুসলিম লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়তে। শামসুল হক সাহেব শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন, কিন্তু টাকা পাওয়া যাবে কোথায়? হক সাহেবেরও টাকা নাই, আর আমাদেরও টাকা নাই। তবু যেই কথা সেই কাজ, শামসুল হক সাহেব টাঙ্গাইল চলে গেলেন, আমরা যে যা পারি জোগাড় করার চেষ্টা করলাম। কয়েক শত টাকার বেশি জোগাড় করার সম্ভব হয়ে উঠল না। ছাত্র ও কর্মীরা ঘড়ি, কলম বিক্রি করেও কিছু টাকা দিয়েছিল, (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ১১৫)।
শামসুল হক সাহেব মুসলিম লীগের প্রার্থী খুররম খান পন্নীকে পরাজিত করে এমএলএ নির্বাচিত হন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে মুসলিম লীগের কোনো প্রার্থীর সেটাই প্রথম পরাজয়। এক ঐতিহাসিক ঘটনা পাকিস্তান, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে। মুসলিম লীগের পতন এবং নতুন রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আওয়ামী মুসলিম লীগের উত্থানের বার্তা নিয়ে এসেছিল সে নির্বাচন। মুসলিম লীগের প্রার্থী কেন পরাজিত হয়েছিল, সে বিষয়ে শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘১৯৪৭ সালে যে মুসলিম লীগকে লোকে পাগলের মত সমর্থন করেছিল, সেই মুসলিম লীগ প্রার্থীর পরাজয় বরণ করতে হল কি জন্য? কোটারি, কুশাসন, জুলুম, অত্যাচার এবং অর্থনৈতিক কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ না করার ফলে। ইংরেজ আমলের সেই বাঁধাধরা নিয়মে দেশ শাসন চলল। স্বাধীন দেশ, জনগণ নতুন কিছু আশা করেছিল, ইংরেজ চলে গেলে তাদের অনেক উন্নতি হবে এবং শোষণ থাকবে না। আজ দেখছে ঠিক তার উল্টো’(অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-১১৯)।
এই পরিস্থিতিতে নতুন রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা জরুরি হয়ে পড়ল। শেখ মুজিবুর রহমান তখনো ছাত্রনেতা। কিন্তু বড়দের রাজনীতিতে তখনই শেখ মুজিবুর রহমানের বিস্তর প্রভাব। বন্দি শেখ মুজিবের কাছে সমমনা রাজনীতিবিদগণ নতুন রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে মতামত জানতে চাইলেন। শেখ মুজিব নিজের মত দিলেন এই বলে যে, ‘আর মুসলিম লীগের পেছনে ঘুরে লাভ নাই, এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরা আমাদের মুসলিম লীগে নিতে চাইলেও যাওয়া উচিত হবে না’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ১২০)।
কারাগারে বন্দি শেখ মুজিবকে আরও জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, তিনি আর ছাত্র রাজনীতি করবেন, না কি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে যোগ দেবেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘ছাত্র রাজনীতি আর করব না, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই করব। কারণ বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এদেশে একনায়কত্ব চলবে’।
এমনই অবস্থায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক। শেখ মুজিবকে করা হয় জয়েন্ট সেক্রেটারি। তবে কারাগারে বন্দি শেখ মুজিব তখনই চেয়েছিলেন, নতুন রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে কোনো সাম্প্রদায়িক প্রত্যয় যুক্ত না থাকুক।
এ বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে। ভাবলাম, সময় এখনও আসে নাই, তাই যারা বাইরে আছেন তারা চিন্তাভাবনা করেই করেছেন’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ১২১)।
পরবর্তীকালে, ১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে পরে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দেওয়া হয়; নাম রাখা হয়: 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ'।
শুরু থেকেই আওয়ামী লীগকে শেখ মুজিবুর রহমান কি এক বিরল দূরদর্শিতায় এবং দৃঢ়তায় আওয়ামী লীগকে আগলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন তার উজ্জল দৃষ্টান্ত ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক তৎপরতা।
যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন নামে খ্যাত আইন পরিষদের সে নির্বাচনে শেখ মুজিব চেয়েছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ এককভাবে পরিষদে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে লড়বে। শেখ মুজিব জানতেন আওয়ামী মুসলিম লীগ একাই মুসলিম লীগকে নাস্তানাবুদ করে দিতে পারবে। কিন্তু মওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মত বড় বড় নেতারাও শেখ মুজিবের মত করে ভাবতে পারেন নি।
মুসলিম লীগ থেকে বিতাড়িত এবং অজনপ্রিয় রাজনীতিবিদগণ ফজলুল হককে সামনে রেখে কৃষক-শ্রমিক পার্টি (কেএসপি) নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম দেয়। এই কেএসপির নাম দিয়ে মূলত আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার উপর ভর করে পাকিস্তানের ক্ষমতাকাঠামোর অংশ হতেই যুক্তফ্রন্ট করার জন্য এক দল রাজনীতিবিদ উঠে পড়ে লেগেছিলেন।
এ বিষয়ে শেখ মুজিব আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য বিরোধী কোন দল আছে কি না? যাদের নীতি ও আদর্শ নাই তাদের সাথে ঐক্যফ্রন্ট করার অর্থ হল কতকগুলি মরা লোককে বাঁচিয়ে তোলা। এরা অনেকেই দেশের ক্ষতি করেছে। রাজনীতি এরা ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য করে, দেশের কথা ঘুমের ঘোরেও চিন্তা করে না’ পৃষ্ঠা ২৪৮)।
যুক্তফ্রন্ট ইস্যুতে শেখ মুজিবুর রহমানের পরামর্শ এবং অবস্থান যদি আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্য নেতৃবৃন্দ শুনতেন তাহলে পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে আরও শক্তিশালী রাজনৈতিক প্লাটফর্ম পেত সংগঠনটি। আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার জন্য অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে পুরো পাকিস্তান আমলে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বুঝে হোক, না বুঝে হোক, সেসব ষড়যন্ত্রে পা দিয়েছেন।
মওলানা ভাসানী এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ছেড়ে ন্যাপ প্রতিষ্ঠা করলেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ ছেড়ে কখনো যান নি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরে অনেক আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা গা ঢাকা দিয়েছিলেন, অনেকে নীরব হয়ে গিয়েছিলেন। শেখ মুজিব বলতে গেলে একাই তখন নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবিতে, আহত-নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। নিজে জেলখানায় দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরের মধ্যে ১৪ বছর জেলে কাটিয়েছেন শেখ মুজিব।
পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিটি রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামে আওয়ামী লীগের প্লাটফর্মে মানুষকে একতাবদ্ধ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ৬৬ সালের ছয়দফা, ১৯৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং চূড়ান্তভাবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের ব্যানারেই সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে এবং সফলতা এসেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের গরীব মানুষের ভাগ্য ফেরাতে শেষ চেষ্টা হিসেবে বাকশাল কায়েম করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু স্বাধীনতার শত্রুরা শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টাকে চিরতরে ব্যর্থ করে দিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে প্রায় পুরো পরিবারসহ হত্যা করে। বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান জাতির জনকের দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম নির্দেশদাতা সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ৬ বছর বঙ্গবন্ধু কন্যাদের দেশে আসতে দেননি।
১৯৮১ সালে দেশে ফিরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়ে শুধু দলকেই নয়, পুরো বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য কমপক্ষে ২০ বার হামলা করেছে বাংলাদেশের শত্রুরা। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছেন জনগণের নেতা শেখ হাসিনা। পরিষ্কার ভিশন নিয়ে এগিয়ে চলেছেন শেখ হাসিনা। একটি মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। শেখ হাসিনার এই বিশাল অর্জনের সংগ্রামে তাঁকে যোগ্য সান্নিধ্য দিয়ে চলেছেন, তাঁর ছেলে, তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।
এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরিরা। বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগের প্রসঙ্গ আসলে তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ হাসিনার নাম অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হবে বাংলাদেশের মানুষের। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের ব্যানারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন আর তাঁর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের ব্যানারে বাংলাদেশকে কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।
লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন