স্বৈরশাসকদের চাটুকারিতা করার জন্য সমাজের এক শ্রেণির পেশাজীবী তৈরিই থাকেন নাকি স্বৈরশাসকরাই তাদের তৈরি করেন? দুটোই সত্যি। এই দুইয়ের মিলমিশেই তৈরি হয় বিশেষ এক চাটুকার শ্রেণি যারা অন্ধের মতো ক্ষমতাসীন সরকারের সমস্ত কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়ে যান। আইয়ুব খান এমন এক বিশেষ সুবিধাবাদী শ্রেণি তৈরি করেছিলেন। তৈরি করেছিলেন ইয়াহিয়া খান। কোনো সরকার যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তখন অনুগত শ্রেণি যতই সরকারের পক্ষে, সরকারের উন্নয়নের পক্ষে দলিল দস্তাবেজ নথিপত্র ডকুমেন্টারি প্রচার করুক, কাজ হয় না। শেষ পর্যন্ত কোনো স্বৈরশাসকই টিকে থাকে না। তবে স্বৈরশাসকের পক্ষে ডগমা ছড়িয়ে কিছুদিনের জন্য কিছু মানুষকে তারা বিভ্রান্ত করে রাখতে পারে বৈকি। ডগমার মোহমন্ত্র দিয়ে অল্প কিছু মানুষকে হিপনোটাইজও করে রাখা যায়। তবে শেষ পর্যন্ত স্বৈরশাসক ও তার অনুগতজীবীদের পরাজয় নিশ্চিত। জনমানসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কোনো স্বৈরশাসক টিকে গেছে পৃথিবীর ইতিহাসে এই দৃষ্টান্ত নেই। মেয়াদান্তে সুস্থ-স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তরের ভাগ্য স্বৈরশাসকদের হয় না। আফসোস, একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সব সরকার আইয়ুব-ইয়াহিয়ার এই নীতি অনুসরণ করে গেছে।
দুই
ডগমা (বদ্ধমত) গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমরা এখন এই ডগমা দেখতে পাই। আওয়ামী লীগের পক্ষের ডগমা। আওয়ামী লীগ জনগণের ওপর নির্ভরশীল দল বলে ব্যাপক ডগমা আছে। ধরে নিচ্ছি এটাই সত্যি। তাহলে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে দেশে রক্তগঙ্গা, রক্তের সাগর, রক্তের মহাসাগর বয়ে যাবে বলে আওয়ামী লীগ নেতারা আশঙ্কা করেন কেন? তারা এমন কী করেছেন যে বঙ্গোপসাগরে পানির পরিবর্তে রক্তের সে াত বয়ে যাবে? বিএনপি ক্ষমতায় আসলে কি বিএনপির কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করার জন্য মিডিয়া বা অন্যান্য ওয়াচডগ থাকবে না? সর্বোপরি বিদেশি শাসক বা বিদেশি কূটনীতিক নয়, আওয়ামী লীগ জনগণের ওপরই নির্ভরশীল বলে যে ডগমা বাজারে চালু আছে সেই জনগণও কি থাকবে না? তাহলে আওয়ামী লীগ এত ভয় পায় কেন? কিসের ভয়? এক বছরে ৭২ হাজার ৮শ’ ৭২ কোটি টাকা পাচারের? সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার সুইস ব্যাংক ভল্টের? টেন্ডার ছাড়া নিজেদের মধ্যে বেসরকারি বিদ্যুৎ প্রকল্প ভাগাভাগি করে নেয়ার? ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন করার? নাকি ভয়, তাদের দ্বারা সংঘটিত আরো বড় অন্যায়ের, যা ক্ষমতা থেকে সরে গেলেই কেবল জনগণ জানতে পারবে? আত্মমর্যাদাশীল আওয়ামী লীগের যে ডগমা তা আমরা ধূলিসাৎ হয়ে যেতে দেখি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভারতের প্রত্যক্ষ প্রভাবে। বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারত প্রভাব খাটালে সেটা কি বাংলাদেশের জন্য মর্যাদাহানির নয়?
যে কাজ বিএনপি করলে অন্যায় হয়, সে কাজ আওয়ামী লীগ করলেও অন্যায়-ই হওয়ার কথা। এক যাত্রায় পৃথক ফল হবে কেন? কিন্তু আমরা দেখছি তাই হচ্ছে। ভারত সফরে বিএনপির নেতারা গেলে সেটা হয় ভারতের অনুগ্রহ লাভের প্রত্যাশায় যাওয়া। আর আওয়ামী লীগ গেলে সেটা হয় মিত্রতার বন্ধন। বিএনপি ঘরের কথা পরকে জানিয়ে দেয় বলে বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। কিন্তু আমরা তো দেখি এই কাজ আওয়ামী লীগই বেশি করে। নাকি ভারতকে আওয়ামী লীগ পর মনে করে না, ঘরই মনে করে। টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে আওয়ামী লীগ অনুগত পেশাজীবীর সংখ্যা জ্যামিতিকহারে বেড়েছে। চাকরি ব্যবসা বাণিজ্য শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি মিডিয়া- সব ক্ষেত্রে এই অনুগতজীবীরা। যে কারণে আওয়ামী লীগ খুলনা ও গাজীপুরের মতো নির্বাচন করে পার পেয়ে যায়। মিডিয়া প্রচার করে দশ পার্সেন্ট অনিয়ম হয়েছে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলকে রাস্তায় দাঁড়াতে দেয় না। মিডিয়া প্রচার করে প্রযুক্তির এই মহা উৎকর্ষের কালে আন্দোলনের জন্য রাস্তায় নামার দরকার কী? দরকার যদি না-ই থাকে তাহলে আওয়ামী লীগ জনসভা মিটিং মিছিল করে কেন ? প্রতিদিন আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠন এবং তাদের সাংস্কৃতিক সংগঠন কোনো না কোনো সভার আয়োজন করছেই। বিএনপির সে সুযোগ নেই। বিএনপিকে দাঁড়াতেই দেয়া হচ্ছে না। বিএনপির কথা যদি বাদও দিই, ধরে নিলাম তারা জনসভা করলে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঘোরতর অবনতি হবে সে কারণে সরকার তাদের মিছিল মিটিং করতে দেয় না। কিন্তু সরকারের অন্যায় সিদ্ধান্ত বিরোধী যে কোনো ন্যায্য আন্দোলনকারীদের তো সরকার রাস্তায় নামতে দিচ্ছে না। কোটা সংস্কার আন্দোলনে ব্যাপক জনসমর্থন দেখে সরকার এ আন্দোলনকে সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে নিয়ে গেল। সরকারের যে কোনো অন্যায় কাজের বিরোধিতাকারী অথবা অন্যায় সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণকারীদের থাম লুয়াং গুহায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়। এ এক প্রতীকী থাম লুয়াং। বাংলাদেশে ভিন্ন মত পোষণকারীদের স্থান এখন এই থাম লুয়াং গুহায়।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে জড়িত শিক্ষার্থীদের ওপর শুধু পুলিশ নয়, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীরাও হামলা চালাচ্ছেন। যারা প্রতিবাদ করছেন তাদের অবস্থানও থাম লুয়াং। প্রতিবাদ করার সুযোগ অবশ্য খুবই সীমিত। ধরুন একজন মানবাধিকার কর্মী প্রতিবাদ করতে চাইছেন, খ্যাতিতে যদি এই মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বা খুশি কবিরের সমতুল্য না হন তাহলেই তিনি আখ্যা পাবেন রাজাকার হিসেবে।
ধরুন একজন শিক্ষক প্রতিবাদ করতে চাইছেন, প্রতিবাদী শিক্ষককে হতে হবে ড. আনিসুজ্জামানের মতো মহীরুহ শিক্ষক। আইনজীবী প্রতিবাদ করতে হলে তাকে হতে হবে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম। আনিসুজ্জামানের মতো শিক্ষক, সুলতানা কামাল বা খুশি কবিরের মতো মানবাধিকার কর্মী, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের মতো আইনজীবী ক’জন আছেন? বাকিরা প্রতিবাদের জন্য দাঁড়ালে তাদের চৌদ্দ পুরুষের ঠিকুজি কুষ্টি উদ্ধারে নেমে পড়ে গোয়েন্দা সংস্থা। জ্ঞাতি গুষ্টি দেশের যেখানে যে প্রান্তে আছে তাদের চূড়ান্ত হেনস্তা করে ছাড়ে। ভিন্ন মত প্রকাশের এমন করুণ দশা এর আগে কখনো দেখেনি বাংলাদেশ। দেখেছে দাবি করে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠরা বলেন, কেন জিয়াউর রহমানের সময় তো বছরব্যাপী কারফিউ চলেছে। এনারা তোষামোদির জোশে দিশেহারা। তারা ভুলে যান সামরিক শাসনামলের সঙ্গে গণতান্ত্রিক শাসনামলের তুলনা করে কার্যত তারা আওয়ামী সরকারকে ছোটই করল।
তিন
১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল একজন। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা যে কয় লাখ তার হিসাব কারো কাছে আছে বলে জানা নেই। হঠাৎ বাংলাদেশের মানুষ কীভাবে এত ধনী হয়ে গেল? রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়া হঠাৎ করে কারো পক্ষে এমন ধনকুবের হওয়া সম্ভব, এটা কোনো অন্ধ অনুগতও বিশ্বাস করবে না। পানামা পেপার্স এবং প্যারাডাইস পেপার্সে যাদের নাম এসেছে ভাবুন একবার তারা কী পরিমাণ লুণ্ঠনের সুযোগ পেয়েছে। লুণ্ঠনকারীদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ক্ষমতা ছাড়তে, সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে, তাই এত ভয়।
জয়া ফারহানা
লেখক : কলাম লেখক
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন