প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন’ বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতারা বিব্রত ও হতবাক হলেও বিএনপি নেতারা একে ‘সত্য স্বীকার করে নেওয়া’ বলে সাধুবাদ জানিয়েছেন। তবে একই সঙ্গে বিএনপি’র নেতারা আবার সিইসি’র ওই বক্তব্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি ‘আস্থা তৈরির সম্ভাব্য আওয়ামী ফাঁদ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ৩১ জুলাই সোমবার থেকে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ শুরু করেছে ইসি। এরই ধারবাহিকতায় গত ১৫ অক্টোবর রোববার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র সাথে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকের সূচনায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেন, ‘জিয়াউর রহমান এ দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে, দলনেতা হিসেবে তিনি ছয় বছর রাষ্ট্রপরিচালনা করেছেন। ১৯৯১ সালে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসেন তিনি’।
বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে প্রকৃত নতুন ধারার প্রবর্তন করেছেন মন্তব্য করাসহ বিএনপি নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের বিভিন্ন সাফল্য তুলে ধরেন সিইসি। তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপি প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামুলক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষা, র্যাব গঠন, দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রনালয়, আইন কমিশন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়িয়ে ৩০ বছর করাসহ নানা উন্নয়ন ও সংস্কারমুলক কাজ পরিচালনা করেছে’।
সিইসির ওই বক্তব্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসার পরই বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার শুরু হয়। ওই বক্তব্যের বিরোধিতা করে ১৬ অক্টোবর সোমবার সংলাপে অংশ নিয়ে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী সিইসি’র পদত্যাগও দাবি করেন।
সিইসি’র ওই বক্তব্য নিয়ে বিএনপি নেতারা বেশ খুশি হলেও তারা একে সম্ভাব্য আওয়ামী ষড়যন্ত্র বলেও সতকর্তা অবলম্বন করছেন। অন্যদিকে ওই বক্তব্যকে সিইসি’র অপ্রাসঙ্গিক ও ইতিহাসের বিকৃতি বলেও দাবি করেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
এ বিষয়ে বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু প্রিয়.কমকে বলেন, ‘শহীদ রাষ্টপতি জিয়াউর বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা, বিগত সরকারগুলোতে বিএনপি সাফল্যের সাথে সরকার পরিচালনা করেছে, ভালো ভালো কাজ করেছে, সিইসি এ সত্য স্বীকার করেছেন, এটা ভাল লক্ষণ। সে সত্য আওয়ামী লীগ নেতারা সব সময় আড়াল করতে চেষ্টা করেন তা সিইসি’র মুখ থেকে বেড়িয়েছে’।
নির্বাচন কমিশনের প্রতি বিএনপি’র আস্থা তৈরি করতে সিইসি এমন মন্তব্য করেছেন কিনা? এ প্রশ্নের জবাবে বিএনপি’র এই নেতা আরও বলেন, ‘যেহেতু আলোচনা চলছে তাই এ বিষয়ে মন্তব্য না করাই ভালো। আমরা যে সুপারিশ করেছি তা বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না সেটা দেখলেই সব পরিস্কার হবে।’
আওয়ামী অপপ্রচারে আড়াল সত্য সিইসি সামনে এনেছেন মন্তব্য করে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল প্রিয়.কমকে বলেন, ‘ বিষয়টি পুরো জাতিই স্বীকার করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ব্যক্তিগতভাবে স্বীকার করলেও দলীয়ভাবে তারা আড়াল করারই চেষ্টা করে। সিইসি সেটা প্রকাশ্যে এনেছে।’
তবে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সৈয়দা আশিফা আশরাফি পাপিয়া সিইসি’র বক্তব্যকে সতকর্তার সাথে বিবেচনার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রিয়.কমকে তিনি বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার আওয়ামী লীগের ইশতেহার কমিটির সদস্য ছিলেন। এখন তিনি সিইসি হয়েছেন। তার ওই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি সঠিক ইতিহাস জাতির সামনে তুলে ধরেছেন ঠিকই কিন্তু বক্তব্যটি বিএনপি’কে খুশি করতে তার চতুরতা, নাকি নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা তৈরির আওয়ামী ফাঁদ তা বিশেষভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই সিইসি ওই বক্তব্য দিয়েছেন এটা নিশ্চিত, নয়তো প্রধান বিচারপতি একটি বক্তব্যের কারণে যেমন সাঁড়াশি আক্রমণের শিকার হয়েছে, সিইসিও ঠিক তেমনই আক্রমণের শিকার হতেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা এ বিষয়ে একদম চুপ।’
এদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ওই বক্তব্যের মাধ্যমে ইতিহাস বিকৃতি করেছেন বলে দাবি আওয়ামী লীগ নেতাদের। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ কমিটির সহ-সম্পাদক সুভাষ সিংহ রায় প্রিয়.কমকে বলেন, ‘অপ্রাসঙ্গিক ও মনগড়া বক্তব্যের মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন। এটা নিরপেক্ষতার নিদর্শন নয়, বরং বিএনপির মার্কেটিং করেছেন।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ওই বক্তব্য আস্থা তৈরির আওয়ামী ষড়যন্ত্র কিনা? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তিনি যদি আওয়ামী লীগের সাথে পরামর্শ করেও এটা করে থাকেন তবে তার মাধ্যমে তো তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন। তিনি তো সেটাও পারেন না’!
আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বর্ষীয়ান নেতা নূহ-উল আলম লেনিন প্রিয়.কমকে বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ওই বক্তব্যে দিয়ে ইতিহাসের বিকৃতি করেছেন। তার এ বক্তব্য অপ্রাসঙ্গিক, অসত্য ও ব্যক্তিগতভাবে বিব্রতকর।
এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে এক অনুষ্ঠানে সিইসি’র ওই বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে এটি সিইসি নুরুল হুদার একটি কৌশল হতে পারে। বিএনপির এখন খুশি খুশি ভাব। এটা যেন নির্বাচন পর্যন্ত বজায় থাকে। আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে নিরপেক্ষতা প্রত্যাশা করি, অনুগ্রহ নয়।’
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ‘তিনি (সিইসি) এটি প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেননি। বলেছেন ভেতরে। আমরাও মিটিংয়ে যাব। তখন আমরা জানতে চাইব তিনি আসলে কী বলেছেন।’
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন