জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভারে প্রবেশাধিকার চেয়ে একাধিকবার আবেদন করেছিল ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠান অবার্থু টেকনোলজিস। প্রতিষ্ঠানটির আহ্বানে সাড়া দেয়নি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বরং চরম ব্যর্থতার কারণে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে ইসি। বর্তমানে কোনো প্রকার বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা ছাড়াই স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করছে ইসি। ইসি’র জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ (এনআইডি) উইং সূত্রে জানা গেছে, এনআইডি সার্ভারে প্রবেশাধিকার চেয়ে একাধিকবার আবেদন করে অবার্থু। ১২ই মে ইসি’র কাছে পাঠানো একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি ইসি’র সার্ভারে সম্পূর্ণ প্রবেশাধিকার চায়।
একই সঙ্গে সকল সফটওয়্যারের লাইফ সাইকেল সম্পর্কে তথ্য চেয়েছে। যা খুবই সংবেদনশীল ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে এনআইডি উইংয়ের পক্ষ থেকে কড়া ভাষায় তিরস্কার করা হয়। পরে অবার্থু তাদের করা আবেদনের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। এর পনের দিনের মাথায় আবার প্রতিষ্ঠানটি সার্ভারে প্রবেশাধিকার চেয়ে আবেদন করে। দ্বিতীয় দফায়ও সাড়া দেয়নি এনআইডি উইং এবং অবার্থুর কাছে সার্ভারে প্রবেশের কারণ জানতে চাওয়া হয়। তারা কারণ উল্লেখ না করেই একমাস পর আবার প্রবেশাধিকার চায় এবং সার্ভারে প্রবেশাধিকার ছাড়া কাজ করা সম্ভব নয় বলে চিঠি দেয় অবার্থু। এমনকি সার্ভারে ঢোকার জন্য নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্কের নাগরিকসহ দশজনের তালিকা পাঠিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু প্রতিবারই সার্ভারে প্রবেশাধিকার প্রদানে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ইসি। ওই সময় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম পরিমাণে স্মার্টকার্ড উৎপাদন হওয়ায় অবার্থুর সঙ্গে চুক্তি শেষ করে ইসি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের (এনআইডি) মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুল ইসলাম বলেন, আমরা কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে সার্ভারে অ্যাকসেস দেইনি। সার্ভারে অ্যাকসেস দিলে তারা হয়তো জিম্মি করতে পারে। কার্ড তৈরির জন্য তাদের সার্ভারে প্রবেশের প্রয়োজন ছিল না। তিনি আরো বলেন, সার্ভার আমাদের হৃৎপিণ্ড। এটা আমরা কোনোভাবেই তাদের হাতে দিতে পারি না। ওই কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে আমরা চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিজেরাই কাজ করছি। তাদের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে উৎপাদনে সক্ষম হয়েছি। তবে বিতরণের সক্ষমতা না থাকায় নাগরিকরা সঠিক সময়ে স্মার্টকার্ড পাচ্ছে না। ইসি সূত্র জানায়, অবার্থু সার্ভারে প্রবেশাধিকার চাওয়ার পাশাপাশি ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছিল। তারা চুক্তির মেয়াদে কাজ করেছে ১৪ শতাংশ। তাদের চুক্তিকালীন সময়ের ৮৬ শতাংশ কাজ বাকি ছিল। কোম্পানিটি চুক্তি অনুযায়ী যথাসময়ে ব্ল্যাঙ্ক স্মার্টকার্ড সরবরাহ করতে পারেনি। ২০১৫ সালের ১৪ই জানুয়ারি স্মার্টকার্ড সরবরাহকারী ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠান অবার্থুর টেকনোলজিসের সঙ্গে ১০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চুক্তি করে ইসি। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৩০শে জুনের মধ্যে ৯ কোটি ভোটারের জন্য স্মার্ট কার্ড উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার কথা ছিল। নির্ধারিত সময়ে তাতে ব্যর্থ হওয়ার পর ওই চুক্তির মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০১৭ সালের ৩০শে জুন পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি উল্লেখ করার মতো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। ফলে ওই কোম্পানির চুক্তি বাড়ানোর আবেদন বাতিল করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কার্যক্রম শুরু করে ইসি। গত ২৭শে আগস্ট থেকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্মার্টকার্ড উৎপাদন শুরু করেছে ইসি। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণভাণ্ডারে স্থাপিত ১০টি মেশিনে কার্ড উৎপাদন করা হচ্ছে। মেশিনগুলো থেকে প্রতিমাসে ৬ লাখ কার্ড উৎপাদন করা হচ্ছে। কিন্তু যত কার্ড উৎপাদন হচ্ছে ততো বিতরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে ত্রাণভাণ্ডারে কার্ডের স্তূপ জমেছে। উৎপাদন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তা চেয়েছে ইসি। কমিশনের নিজস্ব উদ্যোগে স্মার্টকার্ড উৎপাদন-পার্সোনালাইজেশনের কাজে সহায়তার জন্য অর্ধ শতাধিক কর্মকর্তা চেয়ে সমপ্রতি সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। ইসি সূত্রে জানা গেছে, নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কাজ শুরুর পর স্মার্টকার্ডের উৎপাদন বেড়েছে। যা অবার্থুর চেয়ে ছয় সাতগুণেরও বেশি। এই প্রকল্পে যারা কাজ করছে সবাই বাংলাদেশি। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কাজ শুরুর কারণে একদিকে ১৩৭ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। অন্যদিকে দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুসারে, ঢাকায় ২৫ লাখ ২৩ হাজার ৩৫ জন, কুড়িগ্রামে ৯২ হাজার ৬৮২ জন, চট্টগ্রামে ২ লাখ ৮৮ হাজার ৩১২ জন, রাজশাহীতে ১ লাখ ৭২ হাজার ৭০৮ জন, বরিশালে ৭৬ হাজার ১৫৬ জন, ৬৮ হাজার ৭০৭ জন স্মার্টকার্ড হাতে পেয়েছেন। ৭ কোটি ৩৩ লাখ ব্ল্যাঙ্ক স্মার্টকার্ডের মধ্যে পারসোনালাইজেশন সম্পন্ন হয়েছে ১ কোটি ৯২ লাখ কার্ড।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন