গত ১০ নভেম্বর ফেসবুকের একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের একটি হিন্দু পল্লীতে হামলা চালিয়ে ৩০টির বেশি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। বাংলাদেশের পুলিশ হামলার জবাবে গুলি ছুঁড়লে এক হামলাকারী নিহত হয়। সহিংসতায় ৫৩ জন আহত হয়।
তবে ওই হামলার ব্যাপারে কেবল বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। ১২ নভেম্বর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আশ্বাস দিয়েছে যে হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। ১৩ নভেম্বর ভারতের সহকারি হাইকমিশনার আক্রান্ত গ্রামটি পরিদর্শনও করেন।
ভারত দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারপরও এ ধরনের প্রতিক্রিয়া নজিরবিহীন। কারণ ঘটনাটি ঘটেছে বাংলাদেশের মাটিতে এবং হামলাকারী এবং আক্রান্ত উভয়েই বাংলাদেশী নাগরিক। তাহলে ভারত সরকার কেন ভারতের সংশ্লিষ্টতাহীন একটি বিষয়ে নিজেকে সম্পৃক্ত করল?
রক্ত না মাটি
বাংলাদেশের নাগরিকদের ব্যাপারে ভারত সরকারের উদ্বিগ্ন হওয়ার একটি কারণ পাওয়া যেতে পারে ভারতীয় নাগরিকত্বের ধারণাটিই ক্রমাগত বদলে যাওয়ার মধ্যে। বিস্তৃতভাবে বলা যায়, বিশ্বে নাগরিকত্বের ধারণাটি দু’ধরনের। একটি হলো ‘জাস সলি’। এর আক্ষরিক অর্থ হলো মাটির অধিকার। যে কেউ কোনো এলাকায় জন্মগ্রহণ করলে সে সেদেশের নাগরিক অধিকার লাভ করে। এ ধরনের নাগরিকত্ব লাভের সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হলো যুক্তরাষ্ট্র। এই আইনের ফলেই যুক্তরাষ্ট্রে ‘জন্ম পর্যটন’ বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে জন্মগ্রহণ করলে সন্তান দেশটির নাগরিকত্ব পাবে- এমন আশায় চীনা গর্ভবতী নারীরা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে সন্তান জন্ম দিয়ে থাকে। আরেক ধরনের নাগরিকত্বকে বলা হয় ‘জাস স্যানগুইনিস’।
এর অর্থ হলো রক্তের অধিকার। মা-বাবার পরিচিতিকে এ ধরনের নাগরিকত্বে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ ধরনের ক্ষেত্রে মা বা বাবার নাগরিকত্ব কিংবা নির্দিষ্ট কোনো জাতিগত গ্রুপের সদস্য হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত নাগরিকত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে এই নীতি কড়াকড়িভাবে মেনে চলত জার্মানি। এর ফলে জার্মানির বাইরে জন্মগ্রহণ করলেও কোনো জার্মান জাতিগোষ্ঠীর শিশু জার্মান নাগরিকত্ব পেত।
ভারত ‘জাস সলি’ থেকে ‘জাস স্যানগুইনিস’-এর দিকে যাচ্ছে। এর অর্থ হলো, ব্রিটিশ ভারতের সীমান্তের মধ্যে জন্মগ্রহণকারী যে কেউ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভারতের নাগরিকত্ব পাবে। অবশ্য হিন্দুত্ববাদের উত্থান এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদের দিকে যাত্রার ফলে জাস স্যানগুইনিস বেশি গ্রহণযোগ্য হচ্ছে।
রীতিনীতির পরিবর্তন
ভারত ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত জাস সলি নাগরিকত্বকে স্বীকৃতি দিত। ভারতের মাটিতে জন্মগ্রহণকারী যে কেউ ভারতীয় নাগরিকত্ব পেত। ১৯৮৬ সালে পার্লামেন্টে নতুন নিয়মের ফলে কেবল ভারতের মাটিতে জন্মগ্রহণই গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি। ১৯৮৬ সালের পর নতুন নীতি প্রয়োগ করা হয়: সেটা হলো জাস স্যানগুইনিস তথা রক্তের অধিকার। ভারতীয় হতে হলে ভারতীয় মা-বাবার সন্তান হতে হবে, কেবল ভারতের মাটিতে জন্ম নিলেই হবে না।
তারপর ২০০৩ সালে এই নীতি আরো জোরদার হয়। সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট সংশোধন করে ‘বিদেশী নাগরিক’ ধারণাটির সৃষ্টি করা হয়। এর ফলে ভারতে জন্মগ্রহণকারী কেউ হয়তো ভারতীয় নাগরিক হবে না, কিন্তু বিদেশে জন্ম নিয়েও ভারতীয় হতে পারে। নাগরিকত্ব পাওয়াটা নির্ভর করবে তার মা-বাবার পরিচিতির ওপর, কোথায় জন্ম নিলো তার ওপর নয়।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে জাস স্যানগুইনিস নীতি আরো জোরদার হয়। ওই সময় মোদি সরকার ধর্মের ভিত্তিতে ভারতকে আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত করেন। আশ্রয় প্রার্থীরা যদি মুসলিম না হয়, তবে তাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া হবে। এমনকি সে যদি অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করলেও।
হিন্দু আবাসভূমি
জাস স্যানগুইনিস নীতির আগমন শূন্যতা থেকে ঘটেনি। হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্ববাদকে গুরুত্ব দিয়ে ভারতকে হিন্দু দেশে পরিণত করতে চাওয়া রাজনীতি থেকেই এর উদ্ভব। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলেন নরেন্দ্র মোদি। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তিনি সারা বিশ্বে হিন্দু এলাকাগুলোতে ছুটে গেছেন। মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার হয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিদেশী নাগরিকদের উদ্দেশে দর্শনীয় বক্তৃতা করছেন।
ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই মোদি সরকারের নজিরবিহীন পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশের সহিংসতা বন্ধ করতে আক্রান্ত এলাকায় কর্মকর্তা পাঠানো হয় (অথচ ভারতের মধ্যে সংঘঠিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মন্তব্য গায়ে মাখেনি ভারত)।
হিন্দুদের ওপর শুক্রবারের হামলার পর থেকে হিন্দুত্ববাদের মানদ- অনুযায়ী তারা কার্যত ভারতীয় হয়ে গেছে। এটা হলো জাস স্যানগুইনিস নীতির বিবর্তন এবং ভূমি নয় বরং হিন্দু পরিচিতির ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদের পরিচিতিতে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি।
print
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন