বাংলাদেশের গ্রামে ৫১ আর শহরের ৮৪ শতাংশ মানুষ বিদু্ৎ সুবিধা পায়। আর যারা বিদু্ৎ সুবিধা পায় না, তাদের ৯০ শতাংশই গ্রামের বাসিন্দা। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ অঞ্চলে বিদু্ৎ পৌঁছেছে, যা এশিয়ার ৯টি স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) মধ্যে সবচেয়ে কম।
বাংলাদেশের গ্রামে ৫১ শতাংশ আর শহরের ৮৪ শতাংশ মানুষ বিদু্যৎ সুবিধা পায়। আর যারা বিদু্ৎ সুবিধা পায় না, তাদের ৯০ শতাংশই গ্রামের বাসিন্দা। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ অঞ্চলে বিদু্ৎ পৌঁছেছে, যা এশিয়ার নয়টি স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) মধ্যে সবচেয়ে কম।
ইউনাইটেড ন্যাশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আঙ্কটাড) 'এলডিসি ২০১৭'-তে এই কথা বলা হয়েছে। বুধবার একযোগে সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। আঙ্কটাডের পক্ষে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ উপলক্ষে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
এবারের প্রতিবেদনের বিষয় হলো রূপান্ত্মরমুখী জ্বালানি প্রাপ্যতা। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ২০১৪ সালের বিদ্যুৎ-সুবিধার তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। তবে সিপিডি বলছে, গত তিন বছরে দেশের বিদু্ৎ পরিস্থিতির অগ্রগতি হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদু্ৎ প্রাপ্যতার সুবিধা নিশ্চিত করতে এশিয়ার নেপাল ও ভুটান বেশ এগিয়ে আছে। তবে এলডিসিগুলোকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য বিদু্ৎ-সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রতিবছর সাড়ে তিন গুণ হারে বেশি মানুষকে বিদু্যৎ-সুবিধা দিতে হবে। তবে বাংলাদেশকে প্রতিবছর ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হারে বিদু্যৎ-সংযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।
বিদু্যৎ প্রাপ্যতার এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে এলডিসিগুলোর জন্য চারটি সুপারিশ করেছে আঙ্কটাড। এগুলো হলো শক্তিশালী বিদু্যৎ-কাঠামো ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সুশাসন ও অর্থায়ন নিশ্চিত করা, উন্নয়নের কৌশল হিসেবে জ্বালানি খাতকে প্রাধান্য দেয়া এবং আন্ত্মর্জাতিক সহায়তা নেয়া।
সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্ত্মাফিজুর রহমান বলেন, ২০৩০ সালে এসডিজি লক্ষ্য অর্জন এবং ২০৪১ সালে যে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতটিকে বিবেচনা করতে হবে। কেননা, জ্বালানি খাতে সঙ্গে তিনটি বিষয় সম্পৃক্ত। এগুলো হলো অর্থনৈতিক রূপান্ত্মর, অন্ত্মর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থা এবং পরিবেশগত ভারসাম্য। জ্বালানি উৎপাদন হতে হবে সুলভ মূল্যে, সুশাসনের সঙ্গে এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করে।
অনুষ্ঠানে আঙ্কটাডের প্রতিবেদন তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, 'গত তিন বছরে বিদু্যৎ খাতে অনেক উন্নতি হয়েছে।' তারপরও প্রতিবেদনে তিন বছর আগের পরিস্থিতি বর্তমান পরিস্থিতির সাথে খুব বেশি অসামাঞ্জস্য হবে না বলেও মন্ত্মব্য করেন ফাহমিদা।
এই প্রতিবেদনের বেশ কিছু তথ্য অবশ্য বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যেমন এখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ বিদু্যৎ সংযোগের আওতায় এসেছে। যদিও সরকারের সব শেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ এখন বিদু্যৎ সুবিধার আওতায়।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'এসডিজির (জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে বিশ্বব্যাংক এশিয়ার স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে বিদু্ৎ ও জ্বালানি খাতে নিয়ে যে লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছিল সেই লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে বিদু্ৎ খাতে নেপাল ও ভূটানের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। বিদু্ৎ সংযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে তারা লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে। লাওকে (একটি দেশের নাম) লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে আর ১০ শতাংশেরও কম বিদু্ৎ সংযোগ দিলেই চলবে। তবে সেক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
'২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে বাংলাদেশকে প্রতিবছর কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হারে নতুন বিদু্ৎ সংযোগ দিতে হবে।'
২০০৯ সালে তীব্র বিদু্যৎ সংকটের মধ্যে দায়িত্ব নেয়া আওয়ামী লীগ সরকার বিদু্যৎ খাতে ব্যাপক উন্নয়নের পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি নানা উদ্যোগ নিয়েছে। প্রথমবারের মতো পারমাণবিক বিদু্ৎ, গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে কয়লাভিত্তিক বড় বড় বিদু্যৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে।
সরকারের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদন হবে। এর মধ্যে আমদানি ও নিজস্ব গ্যাসে ৩৫ শতাংশ, আমদানিনির্ভর কয়লায় ৩৫ শতাংশ, তেল, বিদু্ৎ আমদানি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বাকি ৩০ ভাগ বিদু্ৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি বেশ কিছু প্রকল্প এরই মধ্যে উৎপাদনে চলে এসেছে।
গত ১৮ অক্টোবর দেশে ইতিহাসের সর্বোচ্চ বিদু্যৎ উৎপাদন হয়েছে। সেদিন নয় হাজার ৫০৭ মেগাওয়াট বিদু্যৎ সরবরাহ করা হয় সারা দেশে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদু্ৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ২৭টি থেকে বেড়ে হয়েছে ১০৮টি। আর উৎপাদন ক্ষমতা ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বেড়ে ১৫ হাজার ৩৫১ মেগাওয়াট হয়েছে।
আট বছর আগে যেখানে দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশ বিদু্যৎ সুবিধার আওতায় ছিল, এখন তা বেড়ে ৮০ শতাংশ হয়েছে।
জ্বালানি নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে গৃহস্থালির কাজে ৬৬ শতাংশ, শিল্পখাতে ১৫ শতাংশ, বাণিজ্যিকখাতে দুই শতাংশ, কৃষিতে তিন শতাংশ ও পরিবহনে ১৩ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার হয়। কিন্তু বাংলাদেশকে ২০৩০ সালের মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে শিল্পখাতে জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
জ্বালানির বিষয়ে সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্ত্মাফিজুর রহমান বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে মধ্যম ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত আয়ের দেশে পৌঁছতে হলে জ্বালানি খাতে উন্নয়ন অবশ্যই জরম্নরি। এছাড়া উৎপাদনশীল খাতে জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সুশাসন ও বড় বিনিয়োগ। তবে রাষ্ট্রের একার পক্ষে বিনিয়োগ সম্ভব নয়। এজন্য বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে মত দেন তিনি।
প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও আন্ত্মর্জাতিক তহবিলগুলো থেকে অর্থ আনার জন্য উদ্যোগ নেয়ার বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, জলবায়ু পরিবর্তনের বড় শিকার বাংলাদেশ। এজন্য উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রম্নতি অনুসারে অর্থছাড় নিশ্চিত করতে হবে।
বিদু্যতের বিষয়ে তিনি বলেন, গ্রামাঞ্চলে এখনো প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ বিদু্যতের বাইরে রয়ে গেছে। যেখানে আফ্রিকার দেশগুলোতে এই হার ৫০ শতাংশ।
তবে বিদু্যতের উৎপাদন অনেক বেড়েছে উলেস্নখ করে সিপিডির এই গবেষণা পরিচালক বলেন, উৎপাদন বাড়লেও এখন পর্যন্ত্ম ব্যবসায়ীরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী বিদু্যৎ পাচ্ছে না। বিদু্যৎকে উৎপাদনশীলতার কাজে লাগোনোর জন্য পদক্ষেপ নেয়া জরম্নরি।
প্রতিবেদনে বিদু্যতের সক্ষমতা বাড়ানো, সুশাসন নিশ্চিত ও অর্থায়নে স্বচ্ছতা, জ্বালানি ও উন্নয়নের নীতিমালার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন এবং সর্বজনীন বিদু্যৎ নিশ্চিত করতে উৎপাদন খরচ কমানোর সুপারিশ করা হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন