কাশ্মীরের পরীমহল দেখতে দেখতে আমরা যখন ক্লান্ত হয়ে গেলাম, তখন দূর থেকে জোহরের মধুর আজান ভেসে এলো। চাচা বললেন, ‘নামাজ পরীমহলে কোথাও পড়ে নিই।’ আমরাও চাচার কথায় সম্মতি দিলাম। কারণ সব থেকে নামাজ আগে। মহান রাব্বুল আলামিন নামাজের বদৌলতে অনেক বিপদ থেকে রক্ষা করে থাকেন, যার প্রমাণ আমরা পেয়েছি কাশ্মীর সফরে। এদিকে সাদি ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে ফেলল। বিছিয়ে দিলাম বাগানের জমিনে। আমাদের সঙ্গে শরিক হলেন ঘুরতে আসা আরও অনেকে। নামাজ শেষে আলিঙ্গন করলাম। মনে হচ্ছিল আপন কারও সঙ্গে আলিঙ্গন করছি। কাশ্মীরিদের আচার-আচরণ সত্যিই গল্প করার মতো। ভূস্বর্গ কাশ্মীর যেভাবে পরিচিত তেমনি তাদের আপ্যায়ন আর ব্যবহারও স্বর্গীয়। এমন সুন্দর আচরণ পৃথিবীর অন্যত্র পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। কেবল সেই বলতে পারবে, যার সৌভাগ্য হয়েছে কাশ্মীর ভ্রমণের।
বশির চাচা গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চাচা বললেন, সামনে রয়েছে হজরত বাল মসজিদ। সেখানে হুজুর (সা.)-এর চুল মোবারক দেখানো হয় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর। তাই আমাদের গন্তব্য এখন হজরত বাল মসজিদ। আমরা সানন্দে উঠে পড়লাম গাড়িতে। আধাঘণ্টা পথ পেরিয়ে চলে এলাম মসজিদে। অজু করে মসজিদে ঢুকতেই দেখলাম মুসল্লিদের ক্রন্দনের শব্দ। বললাম, কাঁদছে কেন?
এদের অনেকের স্বামী, স্ত্রী ও সন্তান শহীদ হয়েছেন। তাই আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে খুব কাঁদছেন। বিচার চাচ্ছেন আল্লাহর কাছে। মুখটা মলিন হয়ে গেল আমাদের। কতই না কষ্ট তাদের। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র কত দুঃসহ। আসর নামাজের পর দাঁড়িয়ে আছি। প্রচণ্ড ভিড়। চাচা বললেন, ‘এখনই হুজুর (সা.)-এর চুল মোবারক দেখাবে’। আগ্রহভরে অপেক্ষা করছিলাম। মসজিদের ইমাম উঁচু মিনারে দাঁড়িয়ে চুল মোবারক দেখাতে লাগলেন। চারপাশে কান্নার আওয়াজ। মনের অজান্তে আমার চোখ থেকে অনবরত পানি পড়তে লাগল। বুক পুরোটা ভিজে গেছে টের পাইনি তখন। সত্যি এমন মোবারক দৃশ্য যে কাউকে কাঁদাতে বাধ্য। এভাবে অনেকটা সময় চলে গেল। মনে হচ্ছিল স্বর্গীয় কোনো বাগানে দাঁড়িয়ে আছি। ইমাম চুল মোবারক নিয়ে চলে গেলেন কিছুক্ষণ আগে। আমরাও নিচে নেমে এলাম। গন্তব্য এখন বশির চাচার বাসা। চলতে চলতে পথে জিজ্ঞেস করলাম কাশ্মীরি শালের দাম কেমন? চাচা জানালেন কাশ্মীরি শাল সর্বনিন্ম ১০০০ রুপি এবং সর্বোচ্চ ১ লাখ রুপি। পাশেই এক স্থানে থামিয়ে বললেন, এখান থেকেই কিনে নাও কাশ্মীরি শাল। কয়েকটি কিনে নিলাম স্মৃতিস্বরূপ।
কিছুদূর এগোতেই চাচা বললেন, এটা হল শহীদদের কবরস্থান। গাড়ি থামিয়ে দিলেন। ফটকের সামনে দাঁড়াতেই আয়াতটি নজরে পড়ল। ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়, তাদের তোমরা মৃত বল না। বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা বুঝ না।’ (আল কোরআন) শ্রীনগর, কাশ্মীর ঈদগাহের পাশের শহীদদের কবরস্থান। যারা শহীদ হন, সবার দাফন এখানেই করা হয়। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। প্রবেশ করলাম মাকবারায়। ভেতরে যেতেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। মনের অজান্তে শিউরিয়ে উঠলাম। সামনে এগোতেই ৬টি কবর দেখে দৃষ্টি আর ফিরাতে পারিনি। এক সপ্তাহ আগেই শহীদ হয়েছেন এরা ৬ ভাই। প্রতিটি কবর ভালোভাবে দেখলাম। কিন্তু একটি কবরও ২৫ বছরের ওপরে পেলাম না। শহীদ হয়েছেন ৩ বছর থেকে ২৫ বছরের ভেতরই।
বশির চাচা শুনালেন তাদের নির্যাতনের করুণ কাহিনী। যে কেউ কাঁদতে বাধ্য। চোখের পানি আটকে রাখতে পারবেন না হে পাঠক আপনিও। কিন্তু তাদের সাহসিকতা দেখে অবাক হতে হয় রীতিমতো। আল্লাহ তাদের সাহস আর মনোবল দিয়েছেন খুব। এক কাশ্মীরি ভাই বললেন, ‘সারা বছর যদি সরকার কোনো ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়, তা হলেও আমাদের কোনো পরওয়া নেই। আল্লাহতায়ালা আমাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা এমনভাবে করেন, আমরা নিজেরাই অবাক হয়ে যাই’। কবর জিয়ারত শেষে ফিরে আসি আপন গন্তব্যে। রাত শেষে সকাল হতেই চাচার চোখে পানি। জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলেন। বললেন ‘তোমাদের বিদায় দিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আরও কিছুদিন থেকে যাও।’ আমরাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। কোথা থেকে এলো এ মায়া, এ ভালোবাসা। সত্যি মুসলমান একই সুতায় গাঁথা একটি পরিবার। সে যে কেউই হোক আর যে কোনো দেশের বাসিন্দা হোক। বুঝে এলো বশির চাচা ও তার পরিবার দেখে, প্রতিটি কাশ্মীরি ভাইদের আচরণ দেখে। চলে এলাম কাশ্মীর ছেড়ে, জড়িয়ে নিলাম ভালোবাসার বন্ধনে একটি পরিবারকে, পুরো কাশ্মীরকে। কাঁদলাম আমরা, কাঁদল বশির চাচার পরিবার, হয়তো হু হু করে কাঁদল কাশ্মীরের পাহাড়, নদী ও বেহেশতি বাতাস। ভালোবাসাময় স্মৃতির সফরের ইতি হল করুণ চোখের বিন্দু বিন্দু অশ্রু ঝরে।
আহমদ আবদুল্লাহ
লেখক : ভারত, দেওবন্দের শিক্ষার্থী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন