রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে নেপিদোতে বৃহস্পতিবার যে দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছে সেটি এ সঙ্কট সমাধানের ক্ষেত্রে কতটা ভূমিকা রাখবে তা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে।
যে দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছে এতে বাংলাদেশের কতটা লাভ হয়েছে সে প্রশ্ন উঠছে বেশ জোরেসোরে। বিস্তারিত কী আছে ঐ দলিলে সেটি কোন পক্ষই প্রকাশ করেনি। তবে দুই দেশ আলাদা-আলাদাভাবে দুটি বিবৃতি দিয়েছে।খবর বিবিসি’র।
এসব বিবৃতি পর্যালোচনার মাধ্যমে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের চাওয়ার অনেক কিছুই পূরণ হয়নি। বিশেষ করে ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবার বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে যে চুক্তি ছিল সেটিকে ভিত্তি করে কিছু হোক সেটি বাংলাদেশ চায়নি।
কিন্তু মায়ানমারের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেখে বিশ্লেষকরা বলছেন বাংলাদেশ সেটি মেনে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
১৯৯২ সালের চুক্তির কথা উল্লেখ করে রিয়াজ বলেন, ‘বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গত দোসরা অক্টোবর বলা হয়েছে এটা অবাস্তব। এখন যদি মায়ানমার মনে করে যে ৯২ সালের চুক্তি হবে ভিত্তি, তাহলে তো বাংলাদেশের কথা গৃহীত হলো না।
এ কারণে সকলের ফিরে যাওয়ার বিষয় নিয়ে আমি আশাবাদী হতে পারছি না। আশাবাদী হতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এখনও পর্যন্ত আশাবাদী হবার মতো কিছু দেখতে পাচ্ছি না।’
বাংলাদেশ চেয়েছিল রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া কবে নাগাদ শেষ হবে সেটির উল্লেখ থাকুক নতুন স্বাক্ষরিত ইন্সট্রুমেন্টে। কিন্তু সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণও চেয়েছিল বাংলাদেশ। সেটিও হয়নি।
রোহিঙ্গাদের সবাইকে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোই বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য। এ ব্যাপারে আলী রীয়াজের সাথে একমত পোষণ করে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবিরও বলছেন, নতুন স্বাক্ষরিত দলিল অনুযায়ী সেটা কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
কবির বলেন, ‘মায়ানমার নিজেই তো ৯২ সালের কাঠামো মানে নি। তারা মানে নি বলেই তো ২২ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আমরা ফেরত পাঠাতে পারিনি। আগেই যেখানে এ কাঠামোর ভেতরে সফলতা পাওয়া যায়নি, এখন সে কাঠামোর ভিত্তিতে কতটা সফলতা পাব এ প্রশ্নের জবাব কিন্তু আমরা জানি না।’
নতুন স্বাক্ষরিত দলিলকে উভয় পক্ষের জন্য বিজয় বলে বর্ণনা করছে মায়ানমার। তবে বিবিসি বার্মিজ ভাষা বিভাগের প্রধান সো উইন থান বলছেন, দলিল স্বাক্ষরিত হলেও মাঠের বাস্তবতা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবার জন্য প্রস্তুত নয়। রোহিঙ্গারা যেসব গ্রামে বসবাস করত সেগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। থান বলেন, এটা এখনো পরিষ্কার নয় যারা ফেরত আসবে তারা কি নিজেদের গ্রামে ফিরে যাবে নাকি অন্য কোথাও ক্যাম্পে তাদের রাখা হবে।
তার বর্ণনা অনুযায়ী, একেবারে গ্রাম পর্যায়েও মায়ানমার সরকারের কাঠামো বিস্তৃত। মায়ানমার সরকার বলছে, সেসব গ্রামগুলোতে কারা বসবাস করতো সে সংক্রান্ত তথ্য প্রমাণ তাদের কাছে আছে। গ্রামে যারা বসবাস করতো তাদের ছবি এবং তালিকা গ্রামের প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠাগুলোর কাছে রয়েছে বলে সো উল্লেখ করেন।
‘এটা সত্যি যে তারা যখন পালিয়ে গিয়েছিল তখন তাদের অনেক কাগজপত্র পুড়ে গেছে। তারা সেগুলো হারিয়ে ফেলেছে। তবে গ্রামের কোন বয়স্ক ব্যক্তি যদি তাদের সনাক্ত করতে পারে যে তারা আগে গ্রামগুলোতে বসবাস করেছে, তাতেও চলবে। সেটিকেই প্রমাণ হিসেবে ধরে নেয়া হবে। এমনটাই বলেছেন সরকারের কর্মকর্তারা।’ বলছিলেন বিবিসির বার্মিজ ভাষা বিভাগের সম্পাদক।
বিশ্লেষকরাও মনে করেন আন্তর্জাতিক চাপের কারণে মায়ানমার এ সংক্রান্ত একটি দলিলে স্বাক্ষর করেছে। তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখাতে চায় যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তারা আগ্রহী। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির মনে করেন, সার্বিকভাবে বাংলাদেশের কতটা লাভ হয়েছে সেটি নিয়ে প্রশ্ন আছে।
কবির বলেন, ‘কূটনীতির বিচারে মিয়ানমার যথেষ্ট বুৎপত্তির পরিচয় ইতোমধ্যেই দিয়েছে। আগামীতে আরও দেখাবে না সেটা মনে করার কোন কারণ নেই। এক্ষেত্রে ওরা আমাদের চেয়ে ভালো হলে আমরা যা চাই সেটা সবসময় নাও পেতে পারি।’ ‘যথেষ্ট ছাড়’ দিয়ে এ ধরনের দলিলে এখনই স্বাক্ষর করার প্রয়োজন ছিল কিনা সেটি ভেবে দেখার অবকাশ আছে বলে অনেকে মনে করেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ দলিল স্বাক্ষরের মাধ্যমে অন্তত একটি কাজ হয়েছে। সেটি হচ্ছে, রোহিঙ্গা ফেরত নেবার প্রক্রিয়া কাগজপত্রে চালু করা। ‘সেটি ইতিবাচক। কিন্তু এ কাজ যে বেশ কঠিন হবে সেটি ইঙ্গিত এরই মধ্যে পাওয়া গেছে’ বলে তারা উল্লেখ করেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন