আড়াই বছর বয়সে আমানের লিভার নষ্ট হয়ে যায়। নিজের লিভার দিয়ে ছেলেকে বাঁচিয়ে তোলেন মা। আমান জাওয়াদকে দেখতে গিয়েছিলেন শাখাওয়াত উল্লাহ
মা-বাবা, বড় বোন সুহা আর ভাই আয়ানের সঙ্গে বেড়ে উঠছিল আমান। এবারের জন্মদিনে বেশ বড় করে উৎসব করার কথা ছিল।
সেটা আর হয়ে ওঠেনি। ২০ অক্টোবর জন্মদিনে আমান চলে গিয়েছিল মৃত্যুর দুয়ারে।
আগস্ট মাসে তার শরীরে জন্ডিসের ভাব দেখা দেয়। মা ফারজানা তানজী দেরি না করে পাশের হাসপাতালে নিয়ে যান। এরপর দেশের নামকরা একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করান। সেখানে অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ডাক্তাররা তাকে পিআইসিইউতে (পেডিয়াট্রিক ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট) নিয়ে গেলেন। জানালেন, ‘ওর বাঁচার সম্ভাবনা কম। ’
তখন স্বজনদের একজন জানালেন বঙ্গবন্ধু হাসপাতালের শিশু পুষ্টি ও পরিপাকতন্ত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক বজলুল করিমের কথা।
‘তিনি পিজি হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ডে ভর্তি করাতে বললেন। যে ছেলেকে ওরা আইসিইউতে ভর্তি রাখল, দুই দিন আমাদের শুধু দূর থেকে দেখতে দিয়েছিল, সেখান থেকে নিয়ে এসে পিজি হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ডে ভর্তি করালাম। তারপর তিনি জানালেন আমানের লিভার পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া বাঁচার সম্ভাবনা ৫-১০ শতাংশ। আমার ছেলেটার অবস্থার অবনতিই হচ্ছে শুধু আর আমরা কিছুই করতে পারছি না। ’ বলছিলেন ফারজানা।
আমানের বাবা জামাল উদ্দিন খোঁজ নিতে লাগলেন কোনো চিকিৎসা আছে কি না ছেলেকে বাঁচানোর? ‘বজলুল স্যারই ভরসা দিলেন, তিনি দেশের বড় বড় চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বললেন। আমাদের দেশে বারডেম হাসপাতালের প্রফেসর মোহাম্মদ আলী স্যার প্রথম লিভার প্রতিস্থাপন করেন। তিনি সফলভাবে আরো কয়েকটি লিভার প্রতিস্থাপন করেন, কিন্তু সেগুলো বড়দের। দেশে এখনো শিশুদের লিভার প্রতিস্থাপনের নজির নেই। বজলুল স্যার ভারতের চিকিৎসক প্রফেসর অনুপম সিবালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ’
অনুপম সিবাল দিল্লি অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। ১৯ সেপ্টেম্বর দিল্লি থেকে আসা এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে নিয়ে যাওয়া হলো আমানকে। সঙ্গে মা-বাবা। দুপুরে হাসপাতালে পৌঁছার পরপরই শুরু হয় নানা পরীক্ষা। রাত তিনটায় আসে মা ছেলে দুজনের পরীক্ষার ফলাফল। মা ফারজানা তার লিভার দিতে পারবেন। এরই মধ্যে আমানকে ডায়ালাইসিস করতে হলো।
মা ফারজানা বলেন, ‘তখন পর্যন্ত আমরা জানতামই না একজনের লিভার অন্যজনের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। কিভাবে সাধারণ জন্ডিস থেকে মানুষের লিভার নষ্ট হয়ে যায় এসব কিছুই জানতাম না। আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করেছিলাম লিভার তো প্রতিস্থাপন করতে হবে কিন্তু সেটা কোথায় পাওয়া যাবে? তারা বলল, ডোনার তো আপনারাই দেবেন। ডোনার কোথায় পাই! ওর বাবার রক্তের গ্রুপ মেলে না, আমার সঙ্গে মেলে। আমাকে দিতে বলল। আমার থেকে যে লিভার নেবে আমার মোটেও ভয়ডর লাগেনি। আমার তখন চিন্তা ছেলেকে নিয়ে, আমি মরব না বাঁচব সেই চিন্তাই ছিল না। শুধু চাইতাম আমার যা-ই হওয়ার হোক, ছেলেটা যেন সুস্থ হয়। ’
অবশেষে ২০ সেপ্টেম্বর দুপুরে একই অপারেশন থিয়েটারে মা ও ছেলের অপারেশন শুরু হয়। মায়ের লিভারের ৪০ শতাংশ কেটে ছেলের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। মায়ের অপারেশন শেষ হয় ১২ ঘণ্টায় আর আমানের ১৪ ঘণ্টায়। অপারেশনের পর দুজনকে আলাদা আইসিইউ কেবিনে রাখা হয়। ২১ দিনে কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠার পর দুজনকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমানের ইনফেকশন দেখা দেয়। তাকে আরো আট দিন রাখা হয় হাসপাতালে।
ওর অপারেশন করেন ডা. নিবর গয়াল। ফারজানা বলেন, ‘তিনবার আমাকে কাউন্সিলিং করা হয়, যাতে মনোবল না হারাই। কিন্তু অপারেশনের পর দেখি এই রোগ খুব সচরাচর। আমরা থাকতে সেখানে ফিলিপাইনের ১০ মাসের একটা বাচ্চাসহ কয়েকটি এই অপারেশন হয়। এ পর্যন্ত দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালে প্রায় ৩০০০ লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, এর মধ্যে আড়াই শ শিশু। আমাদের এমন একজনকে দেখানো হয় যাকে ১৯৯৮ সালে লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল ১ বছর বয়সে, সে এখন ডাক্তারি পড়ছে। ’
সাধারণত হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই এই পাঁচ ধরনের ভাইরাস থেকে এই রোগ হয়ে থাকে। কিন্তু আমানের ক্ষেত্রে তা হয়নি, আমানের জ্বর হওয়ার পর তাকে টাইফয়েডের এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন দিয়েছিলেন ১৪টি, বছর খানেক আগে। ধারণা করা হচ্ছে শিশু আমানের শরীরে সেটা সয়নি। ভুল চিকিৎসার ফলে তার ছোট্ট শরীরে বাসা বাঁধে বড় রোগ।
১০ নভেম্বর দেশে ফেরে মা ছেলে। ছয় মাস থাকতে হবে খুব সাবধানে। এ সময় মায়ের লিভার পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। মায়ের লিভার নিয়ে এখন আমান ভালো আছে। সে এখন কাফরুলে তার নানা বাড়িতে ভাই আয়ানের সঙ্গে খেলছে-দৌড়াচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন