ভিআইপি আসন হিসেবে খ্যাত ভোলা-১ আসন। জেলা সদরের এ আসনকে ঘিরেই চলে গোটা জেলার রাজনীতি। এ আসনের বর্তমান এমপি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য এবং শীর্ষ নেতা হিসেবে ভোলাবাসী তাকে নিয়ে গর্ব করেন। তোফায়েল আহমেদও এমপি নির্বাচিত হয়ে এলাকাকে ঢেলে সাজানোর কাজে হাত দেন। বিভিন্ন সময় নানা প্রকল্প এনে ভোলাকে মডেল জেলা হিসেবে গড়ে তোলার কাজ করেন।
অবশ্য ভোলার উন্নয়নের হাতেখড়ি হয় এ আসনেরই সাবেক এমপি বিজিপির প্রতিষ্ঠাতা নাজিউর রহমান মঞ্জুর মাধ্যমে। তারই ধারাবাহিকতায় তোফায়েল আহমেদ ভোলাকে নিজের মতো করে গড়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। নাজিউর রহমান মঞ্জুর-এর মৃত্যুর পর তারই পুত্র ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বিজেপির হাল ধরেন। তিনিও এ আসনের সাবেক এমপি। তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান হিসাবে এলাকায় তার ব্যাপক পরিচিতি। এছাড়া পিতা নাজিউর রহমান মঞ্জুর-এর ইমেজতো তার সঙ্গে রয়েছেই। আগামী নির্বাচনে তোফায়েল-পার্থ মুখোমুখি হচ্ছেন এটা প্রায় নিশ্চিত। ইতিমধ্যে একাদশ নির্বাচন নিয়ে ভোলার রাজনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠছে।
ভোলার বাংলাস্কুল মোড়ের আওয়ামী লীগ অফিস এখন সরব নেতাকর্মীদের পদচারণায়। তেমনি নতুন বাজারের বিজেপির কার্যালয়ও মুখরিত নেতাকর্মীদের নিয়মিত আড্ডায়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোলা-১ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা নিয়ে হিসাব কষা শুরু করে দিয়েছেন ভোলার রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। ভোলা-১ আসনে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আন্দালিব রহমান পার্থ নিজস্ব ভোটব্যাংক, পিতা নাজিউর রহমান মঞ্জুর ইমেজ, ধানের শীষের জনপ্রিয়তা ও জামায়াতের সমর্থনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আগামী নির্বাচনে ভোলা-১ আসনে তোফায়েল আহমেদ লড়াই করতে হবে পার্থের বিরুদ্ধেই। এ ক্ষেত্রে হিসাব-নিকাশ কি হবে তা নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা।
মনোনয়ন নিয়ে কথা হয় জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম নকীব, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোশারেফ হোসেন ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক নজরুল ইসলাম গোলদারের সঙ্গে। তারা প্রত্যেকেই বলেছেন, তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভোলায় আওয়ামী লীগ আরো বেশি সংগঠিত। তাছাড়া নির্বাচনের আগাম প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেছে। ভোট কেন্দ্র মনিটরিংয়ের জন্য গঠন করা হয়েছে ৮৬টি কমিটি। এদের সহযোগিতা দিচ্ছে ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটিগুলো। এছাড়া ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভোলার নদীভাঙন রোধ, ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, বাগমারা ব্রিজ, শিল্পনগরী স্থাপনের উদ্যোগ, ২৫০ শয্যার হাসপাতাল, টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন এবং ভোলা-বরিশালের মধ্যে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ- সবই তোফায়েল আহমেদের উন্নয়নের স্মারক।
সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার বর্তমান স্বপ্ন ভোলা-বরিশালের মধ্যে সেতু নির্মাণ করা। কাজটি শেষ করতে পারলে ভোলা যেমন দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে, তেমনি ভোলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিপ্লব ঘটবে। এখানে প্রচুর গ্যাসের মজুদ আছে। প্রতিদিন আরো নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। এতে বিনিয়োগ করতে চান দেশের শীর্ষ শিল্প উদ্যোক্তারা। প্রয়োজন শুধু যোগাযোগ ভালো ব্যবস্থার।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের আমলে সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে গ্রামের উন্নয়ন। গ্রামের মানুষ ভালো আছে। ফলে আগামী নির্বাচনে তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে।’ জনগণের ভোটেই আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসবে বলেও জানান তিনি।
ভোলা-১ আসনে বর্তমান প্রায় ৩ লাখ ভোটার মধ্যে নারী এবং পুরুষ ভোটার প্রায় সমানসংখ্যক এর মধ্যে হালনাগাদ ভোটার তালিকায় প্রায় ৫০ হাজার তরুণ ভোটার যুক্ত হয়েছে বলে নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে। ১৯৭৩ সালে এ আসনে প্রথম এমপি হন তোফায়েল আহমেদ। ১৯৭৯ সালে আসনটি চলে যায় সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মরহুম মোশারেফ হোসেন শাজাহানের দখলে। এরশাদ শাসনামলে ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন সাবেক মন্ত্রী জাতীয় পার্টির তৎকালীন মহাসচিব নাজিউর রহমান মনজুর। ১৯৯১ সালে আবার নির্বাচিত হন তোফায়েল আহমেদ। ওই সময় তোফায়েল ভোলা-২ আসনেও জয়লাভ করেন। ১৯৯৬ সালেও জয়লাভ করেন তিনি। ২০০১ সালে নাজিউর রহমান মঞ্জুর প্রচেষ্টা ধানের শীষের ভোট ব্যাংক ও জামায়াতের সমর্থনে ফের ভোলা-১ আসনে বিজয়ী হন বিএনপির সাবেক ধর্মপ্রতিমন্ত্রী মরহুম মোশারেরফ হোসেন শাজাহান। নাজিউর রহমানের মৃত্যুর পর ২০০৮ সালে ৪ দলীয় জোটের শরিক দল বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থ জয়লাভ করেন। সর্বশেষ গত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে ফের এমপি হন তোফায়েল আহমেদ।
জেলা বিজেপির সভাপতি আমিরুল ইসলাম রতন বলেন, ‘২০০৮ সালের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন বিজেপি চেয়ারম্যান পার্থ। জোটের রাজনীতি ধরে রাখতে পার্থ এবারও মনোনয়ন পাবেন। সেই লক্ষ্যে মাঠ গোছানোর কাজ করছি আমরা। ভোলা জেলা বিজেপির সম্পাদক মোতাছিম বিল্লাহ বলেন, এ আসনটি জোটের শরিক দল বিজেপির নেতা আন্দালিভ রহমান পার্থর জন্য নির্ধারিত। সর্বশেষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে ভোলা-১ আসনটিতে আমরা জয়লাভ করেছি। এবারো ২০ দলীয় জোটের পক্ষে বিপুল ভোটে আন্দালিভ রহমান পার্থ এ আসনে জয়লাভ করবে।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ ট্রুমেন বলেন, এবার ভোলার বিএনপি শরিক দলকে কোনো ধরনের ছাড় দেবে না। আমরা বিএনপি থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ার জন্য কেন্দ্রের কাছে জোর দাবি জানাবো। সে ক্ষেত্রে ভোলা-১ আসনে সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন শাজাহানের ছোট ভাই জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম নবী আলমগীরের পক্ষে কাজ করে যাবে ভোলা জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা। জেলা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক রাইসুল আলম জানান, ২০ দলীয় জোট যাকে মনোনয়ন দিবেন তার বাহিরে কাজ করার কোনো ইচ্ছে নেই ভোলা বিএনপির নেতাকর্মীদের। তবে আন্দোলন সংগ্রাম ও জেল জুলুমের সময় জোটের নেতা আন্দালিভ রহমান যেভাবে নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তার প্রতিদান আগামী নির্বাচনে প্রতিফলিত হবে বলেও মনে করছেন জেলা বিএনপির এ সিনিয়র নেতা।
এ আসনে এ বছরই ঘটা করে সম্মেলনের মাধ্যমে দল গোছানোর কাজ শুরু করেছে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টি থেকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন চাইবেন জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আজিম গোলদার। আজিম গোলদার বলেন, ‘আমরা মাঠ গোছানোর কাজ করছি। ভোলায় আমাদের দলের সমর্থনও বেড়েছে।’
এছাড়া ভোলা-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে লবিং করছেন, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ূন, কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মাহাবুবুর রহমান হিরন, ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের মজনু মোল্লা, সাবেক ছাত্রনেতা হেমায়েত উদ্দিন। বিএনপির রয়েছেন সাবেক ছাত্রনেতা শাহাবুদ্দিন লালটু। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য হায়দার আলী লেলিন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পক্ষে জেলা ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদের সভাপতি মাওলানা মুফতি ইয়াছিন নবীপুরী এবং দলের ভোলা জেলা সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মো. মিজানুর রহমান। তবে জামায়াত ইসলামী ভোলার এক শীর্ষনেতা জানান, জামায়াত ভোলা-১ আসন থেকে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে এককভাবে নির্বাচন করলেও জোটগত নির্বাচনের জন্য পরবর্তীতে ৮ম ও ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটের প্রার্থীদেরই সমর্থন দিয়ে এসেছেন। আগামী নির্বাচনেও জোটের প্রার্থীর পক্ষে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে জামায়াত ইসলামী। এক্ষেত্রে গত আন্দোলন সংগ্রামে পাশে থাকা সাবেক এমপি আন্দালিভ রহমান পার্থর পক্ষেই কাজ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন ভোলা জামায়াতের অধিকাংশ নেতাকর্মী।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন